বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক-মুক্তবুদ্ধির চর্চা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য
একদা প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড বলে বিরল সম্মান অর্জনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠের অতীত ঐতিহ্য, বর্তমান পরিস্থিতি, সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
তাঁর সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নূরে আলম দুর্জয়
কালের কণ্ঠ : শিক্ষার মানের দিক থেকে উন্নত বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা বিশাল গ্যাপ লক্ষ করা যায়। এই গ্যাপটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : প্রথমেই বলে রাখা ভালো, উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গ্যাপের কথা বলা হয়, তা বাস্তবভিত্তিক নয়। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমরা যেভাবে পরিচালনা করি, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি, এ বছর আমরা ২৮০ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছি। এ বাজেট দিয়ে আমরা সারা বছর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করব। এবং সেখান থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে যাবে। তাদের যে মানের লেখাপড়া ও গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে, তা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় বলে মনে করি। দেখা যাবে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা পৃথিবীর প্রেস্টিজিয়াস বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জ্ঞানচর্চা করবে এবং কৃতিত্বের সঙ্গে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ও পোস্ট-ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আমাদের গবেষণাগারগুলো এখন অনেক উন্নত। ২৮০ কোটি টাকায় আমরা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করব, তাতে যে স্টুডেন্ট আউটপুট বেরিয়ে আসবে, উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা ব্যয় করছে এবং তা দিয়ে তারা যে আউটপুট, তাতে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আসলে যেটা হয়, আমরা এ অঞ্চলের মানুষ খুব কম টাকায় জীবন নির্বাহ করি, যা উন্নত বিশ্ব চিন্তাও করতে পারবে না। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়কে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করতে যেসব অভিন্ন সূচক ব্যবহার করা হয়, তাতে তারতম্য থাকেই। আমাদের বাজেট কত আর তাদের বাজেট কত? আমাদের ছেলেমেয়েদের আবাসিক সুবিধা আর তাদের আবাসিক সুবিধা? একটা প্রতিযোগিতায় যারা অনেক দূর এগিয়ে আছে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের সূচক অনুযায়ী মাপা হয়, তখন একটা তারতম্য থেকেই যায়। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ওই প্রেস্টিজিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাতারে দাঁড়াতে পারে। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এর প্রমাণ। তবে অবকাঠামোগত অনেক সুযোগ-সুবিধা একেবারেই দুর্বল। এটা আরো প্রসারিত করা প্রয়োজন। যেমন_৩৫ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশকে আমরা আবাসিক সুবিধা দিতে পারি না। একেকটি কক্ষে ছয়-সাত-আটজন করে শিক্ষার্থী থাকে, যেখানে থাকার কথা ছিল দুই থেকে চারজন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটা জরুরি। কেননা ছাত্রছাত্রীরা যদি জ্ঞানচর্চা করতে চায়, তাহলে তাকে স্বচ্ছন্দে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। এটা যদি করতে পারি, তাহলে আমাদের একাডেমিক আউটপুট ও গবেষণা-উৎকর্ষ অনেক বেড়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক উৎকর্ষের (পারফরম্যান্স) ব্যাপারে আপনি কি সন্তুষ্ট? উৎকর্ষ বাড়াতে করণীয় কী?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : আসলে একাডেমিক দুনিয়ায় আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। একজন শিক্ষকের যেমন নেই, একজন শিক্ষার্থীরও নেই। শিক্ষক হিসেবে আমি যখন ক্লাসে লেকচার দিতে যাই, লেকচার দিয়ে আমি কখনোই সন্তুষ্ট বোধ করি না। একজন শিক্ষকের এটা করা উচিতও নয়। ভাবতে হবে, কিভাবে আরো ভালো করে লেকচার দেওয়া যায়। এটাই সর্বশেষ নয়। নিশ্চয়ই এর চেয়ে উচ্চতর মানে যেতে হবে। আজকের একবিংশ শতাব্দীর আহ্বানও তা-ই। পৃথিবীব্যাপী জ্ঞানের রাজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কৃত হচ্ছে। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যে উৎকর্ষ সাধন করেছে, তার চেয়ে আরো বহুগুণ উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। এবং সেই লক্ষ্যে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব_এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রত্যাশা।
কালের কণ্ঠ : বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে কী করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কথা আমরা বলি, দেশভেদে-অঞ্চলভেদে-সংস্কৃতিভেদে তার তারতম্য ঘটবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একই মডেলে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে, তা পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই। পৃথিবীতে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বিশ্ববিদ্যালয় তার জাতিকে একটি পতাকা উপহার দিয়েছে। মাতৃভাষার লড়াইসহ যে বিষয়গুলো আছে, তা স্বতন্ত্র ও একক। এই বৈশিষ্ট্য নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে। তবে আজকের একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা শিক্ষার্থীদের আবাসিক কক্ষে পেঁৗছে দিতে হবে। আজকের পৃথিবী ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। এই জগতে বসবাস করে আমরা নিজেদের বিযুক্ত রাখতে পারব না। আমাদের গ্রন্থাগারকে উন্নত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সম্প্রসারিত করতে হবে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীরা সচরাচর যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, সেগুলো আমাদের শিক্ষার্থীরা কেন পাবে না?
কালের কণ্ঠ : ভর্তিপ্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে ভালো শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না বলে অভিযোগ আছে। আপনি কী মনে করেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : আমরা যেটা অনুসরণ করি, সেটা অবশ্যই একটা পদ্ধতি। আরো নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে। আমরা যেটা অনুসরণ করি, সেটা দিয়ে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার চেষ্টা করি। একজন শিক্ষার্থীর এসএসসি ও এইচএসসির ফল এবং ভর্তি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে আমরা শিক্ষার্থী ভর্তি করি। সবার জন্য যেহেতু একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেহেতু এখানে বস্তুনিষ্ঠতা আছে। এটা কেউ বলতে পারবে না যে এ পদ্ধতির কারণে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভর্তি পদ্ধতি যদি আরো উন্নত করা যায়, অবশ্যই আমরা তা দেখব। গতবার অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা গেছে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেছে। আগে যে ভুয়া ভর্তি দেখা যেত, এখন আর সেটার সুযোগ নেই। এদিক থেকে আমরা কিছুদূর এগিয়েছি।
এটা ঠিক, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভর্তি করা যায় না। বিষয়ের আসনসংখ্যা এবং ভর্তিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর মধ্যে পার্থক্য অনেক। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী যে বিভাগে ভর্তি হতে চায়, তাকে সেই বিভাগে ভর্তির সুযোগ আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই। এটা উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে যে একেবারেই করা যায়, তাও কিন্তু নয়। আমাদের যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরো বাড়ানো যায়, তাহলে হয়তো এটা করা যেতে পারে।
এখানে আরেকটি সমস্যা আছে। যেমন_আমাদের ছেলেমেয়েরা বিভাগের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়। দেখা গেল, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে সুযোগ পেল না, কিন্তু অন্য বিষয়ে সুযোগ পেল; অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার সুযোগও পায়, তাহলেও দেখা যায়, অনেক সময়ই তারা আর ওই পদার্থবিজ্ঞানে পড়তে রাজশাহীতে যায় না। এখানে ছাত্রছাত্রীদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি জড়িত।
কালের কণ্ঠ : উচ্চশিক্ষার জন্য একটা সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। এখানে সে রকম পরিবেশ আছে কি? এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি দেশের বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। আমাদের দেশে আয়তনের তুলনায় বেশি মানুষ বাস করে। এর একটা চাপ আছে। সেই চাপ এই বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা, তাতে অত্যধিক চাপ পড়ে। এবং সেই কারণে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা আর না বাড়িয়ে সংখ্যাটি স্থিতিশীল রেখে সবার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। এই ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী ধারণক্ষম একটি ক্যাম্পাস বিন্যস্ত করতে হবে। সেটা যদি করা যায়, অনেক সমস্যার সমাধান করা যাবে এবং জ্ঞানচর্চায় উৎকর্ষ বাড়বে।
কালের কণ্ঠ : ছাত্র নেতৃত্ব অর্থাৎ গণতন্ত্রচর্চার বিকাশের একটা প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ডাকসু। সেটা ২০ বছর ধরে বন্ধ। আপনি উপাচার্যের স্থানে আসার পর সবার মনে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল, ডাকসু নির্বাচন হবে। কিন্তু সেটার দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আসলে কি ডাকসু নির্বাচন সম্ভব হবে?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ডাকসু নির্বাচন হওয়া জরুরি। কিন্তু ডাকসু চালু করতে গিয়ে ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক গতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় কি না, সেটাও আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমরা একটি সুযোগে ডাকসুর নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করব। কিন্তু পাশাপাশি আমরা এটাও নিশ্চিত করতে চাই_ডাকসুর কার্যক্রম শুরু করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন না ঘটানো। দুটো যাতে একসঙ্গে সংঘটিত হয়। সেটার জন্য সময়ের অপেক্ষা; এবং বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বোঝাপড়ার দরকার আছে। মানে, তাদের একটা ঐকমত্যে আসা। আমরা দেখি, দলগুলোর মধ্যে যে বিরোধ-অন্তর্বিরোধ আছে, এগুলো যদি আবার শুরু হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, সেই আশঙ্কাও আমাদের মধ্যে কাজ করে।
কালের কণ্ঠ : এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির একটা ভয়ানক চেহারা দেখা যায়। এ থেকে উত্তরণের কি উপায় আছে বলে মনে করেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ছাত্ররাজনীতি সব সময়ই আমি পজিটিভলি দেখার চেষ্টা করি। ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতি করবে, এটাই স্বাভাবিক। ছাত্ররা নিজস্ব আদর্শ ধারণ করে মতামত দেবে। এমনকি শিক্ষকরাও নিজস্ব আদর্শ ধারণ করে কাজে নিয়োজিত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সব সময়ই মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ বছরের ঐতিহ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব কিছুই উন্মুক্ত। এখানে প্রত্যেকে মতামত ব্যক্ত করে, প্রতিবাদ করে। ছাত্রসংগঠনগুলো নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যায়।
কিন্তু সে ক্ষেত্রে রাজনীতি কেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে? এটা হওয়ার কথা নয়। যেটা সব সময় লক্ষ করি, রাজনীতির সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ যখন যুক্ত হয়ে যায়, তখন সেখানে কিন্তু আর রাজনীতি থাকে না। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে মানুষ যদি রাজনীতি নিয়ে আসে কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ প্রোপাগান্ডা নিয়ে হাজির হয়, তখন আর রাজনীতি থাকে না। সেটা হয়ে ওঠে নিজ স্বার্থের জন্য কাজ করা। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস আছে, রাজনৈতিক আদর্শের কারণে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে সুস্থ রাজনীতি। সেই রাজনীতিতে আমাদের ফিরে যেতে হবে। এবং সে জন্যই ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজন আছে। এতে গণতন্ত্রের সুগভীর ভিত্তি রচিত হবে। আমরা কিছুদিন গণতন্ত্রের চর্চা করি, আবার কিছুদিন পর হোঁচট খেয়ে লুটিয়ে পড়ে। তাতে পুরো রাজনীতিই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের গণতন্ত্রকে অনেক বেশি সুসংহত করা দরকার। দেশে গণতন্ত্রচর্চা যত নিষ্কলুষ হবে, ক্যাম্পাসগুলোতে ততই সুস্থ রাজনীতির চর্চা হবে।
কালের কণ্ঠ : এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ বছর পূর্ণ হলো। এই শতাব্দীতে এসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কী প্রত্যাশা করবে? আর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে কী আশা করবে? আপনার মতামত...
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ৯০ বছরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ইতিহাস। এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা হচ্ছে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। অর্থাৎ এ অঞ্চলের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধি। সেই বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি এখন দরকার। এই বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে বেগবান করাটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেটা আমরা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে এ দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে, কারা নেতৃত্ব দেবে, সেই নেতৃত্ব নির্মাণ করে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই ক্যাম্পাসে এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশ কিভাবে চলবে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে। আমি সেভাবেই আশা করি। আমাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা নিজেদের এমনভাবে প্রস্তুত করবে যে শুধু সার্টিফিকেটের জন্য নয়; পড়াশোনা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে নিজেদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শুধু এ দেশেই নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও যেন তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
কালের কণ্ঠ : শিক্ষার মানের দিক থেকে উন্নত বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা বিশাল গ্যাপ লক্ষ করা যায়। এই গ্যাপটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : প্রথমেই বলে রাখা ভালো, উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে গ্যাপের কথা বলা হয়, তা বাস্তবভিত্তিক নয়। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমরা যেভাবে পরিচালনা করি, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি, এ বছর আমরা ২৮০ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছি। এ বাজেট দিয়ে আমরা সারা বছর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করব। এবং সেখান থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে যাবে। তাদের যে মানের লেখাপড়া ও গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে, তা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় বলে মনে করি। দেখা যাবে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা পৃথিবীর প্রেস্টিজিয়াস বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জ্ঞানচর্চা করবে এবং কৃতিত্বের সঙ্গে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট ও পোস্ট-ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আমাদের গবেষণাগারগুলো এখন অনেক উন্নত। ২৮০ কোটি টাকায় আমরা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করব, তাতে যে স্টুডেন্ট আউটপুট বেরিয়ে আসবে, উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা ব্যয় করছে এবং তা দিয়ে তারা যে আউটপুট, তাতে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আসলে যেটা হয়, আমরা এ অঞ্চলের মানুষ খুব কম টাকায় জীবন নির্বাহ করি, যা উন্নত বিশ্ব চিন্তাও করতে পারবে না। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়কে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করতে যেসব অভিন্ন সূচক ব্যবহার করা হয়, তাতে তারতম্য থাকেই। আমাদের বাজেট কত আর তাদের বাজেট কত? আমাদের ছেলেমেয়েদের আবাসিক সুবিধা আর তাদের আবাসিক সুবিধা? একটা প্রতিযোগিতায় যারা অনেক দূর এগিয়ে আছে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের সূচক অনুযায়ী মাপা হয়, তখন একটা তারতম্য থেকেই যায়। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ওই প্রেস্টিজিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাতারে দাঁড়াতে পারে। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এর প্রমাণ। তবে অবকাঠামোগত অনেক সুযোগ-সুবিধা একেবারেই দুর্বল। এটা আরো প্রসারিত করা প্রয়োজন। যেমন_৩৫ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশকে আমরা আবাসিক সুবিধা দিতে পারি না। একেকটি কক্ষে ছয়-সাত-আটজন করে শিক্ষার্থী থাকে, যেখানে থাকার কথা ছিল দুই থেকে চারজন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটা জরুরি। কেননা ছাত্রছাত্রীরা যদি জ্ঞানচর্চা করতে চায়, তাহলে তাকে স্বচ্ছন্দে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। এটা যদি করতে পারি, তাহলে আমাদের একাডেমিক আউটপুট ও গবেষণা-উৎকর্ষ অনেক বেড়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক উৎকর্ষের (পারফরম্যান্স) ব্যাপারে আপনি কি সন্তুষ্ট? উৎকর্ষ বাড়াতে করণীয় কী?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : আসলে একাডেমিক দুনিয়ায় আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। একজন শিক্ষকের যেমন নেই, একজন শিক্ষার্থীরও নেই। শিক্ষক হিসেবে আমি যখন ক্লাসে লেকচার দিতে যাই, লেকচার দিয়ে আমি কখনোই সন্তুষ্ট বোধ করি না। একজন শিক্ষকের এটা করা উচিতও নয়। ভাবতে হবে, কিভাবে আরো ভালো করে লেকচার দেওয়া যায়। এটাই সর্বশেষ নয়। নিশ্চয়ই এর চেয়ে উচ্চতর মানে যেতে হবে। আজকের একবিংশ শতাব্দীর আহ্বানও তা-ই। পৃথিবীব্যাপী জ্ঞানের রাজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কৃত হচ্ছে। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যে উৎকর্ষ সাধন করেছে, তার চেয়ে আরো বহুগুণ উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। এবং সেই লক্ষ্যে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব_এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রত্যাশা।
কালের কণ্ঠ : বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে কী করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কথা আমরা বলি, দেশভেদে-অঞ্চলভেদে-সংস্কৃতিভেদে তার তারতম্য ঘটবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একই মডেলে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে, তা পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই। পৃথিবীতে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বিশ্ববিদ্যালয় তার জাতিকে একটি পতাকা উপহার দিয়েছে। মাতৃভাষার লড়াইসহ যে বিষয়গুলো আছে, তা স্বতন্ত্র ও একক। এই বৈশিষ্ট্য নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে। তবে আজকের একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা শিক্ষার্থীদের আবাসিক কক্ষে পেঁৗছে দিতে হবে। আজকের পৃথিবী ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। এই জগতে বসবাস করে আমরা নিজেদের বিযুক্ত রাখতে পারব না। আমাদের গ্রন্থাগারকে উন্নত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সম্প্রসারিত করতে হবে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষার্থীরা সচরাচর যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, সেগুলো আমাদের শিক্ষার্থীরা কেন পাবে না?
কালের কণ্ঠ : ভর্তিপ্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে ভালো শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না বলে অভিযোগ আছে। আপনি কী মনে করেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : আমরা যেটা অনুসরণ করি, সেটা অবশ্যই একটা পদ্ধতি। আরো নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে। আমরা যেটা অনুসরণ করি, সেটা দিয়ে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার চেষ্টা করি। একজন শিক্ষার্থীর এসএসসি ও এইচএসসির ফল এবং ভর্তি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে আমরা শিক্ষার্থী ভর্তি করি। সবার জন্য যেহেতু একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেহেতু এখানে বস্তুনিষ্ঠতা আছে। এটা কেউ বলতে পারবে না যে এ পদ্ধতির কারণে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভর্তি পদ্ধতি যদি আরো উন্নত করা যায়, অবশ্যই আমরা তা দেখব। গতবার অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা গেছে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেছে। আগে যে ভুয়া ভর্তি দেখা যেত, এখন আর সেটার সুযোগ নেই। এদিক থেকে আমরা কিছুদূর এগিয়েছি।
এটা ঠিক, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভর্তি করা যায় না। বিষয়ের আসনসংখ্যা এবং ভর্তিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীর মধ্যে পার্থক্য অনেক। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী যে বিভাগে ভর্তি হতে চায়, তাকে সেই বিভাগে ভর্তির সুযোগ আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই। এটা উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে যে একেবারেই করা যায়, তাও কিন্তু নয়। আমাদের যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরো বাড়ানো যায়, তাহলে হয়তো এটা করা যেতে পারে।
এখানে আরেকটি সমস্যা আছে। যেমন_আমাদের ছেলেমেয়েরা বিভাগের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়। দেখা গেল, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে সুযোগ পেল না, কিন্তু অন্য বিষয়ে সুযোগ পেল; অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার সুযোগও পায়, তাহলেও দেখা যায়, অনেক সময়ই তারা আর ওই পদার্থবিজ্ঞানে পড়তে রাজশাহীতে যায় না। এখানে ছাত্রছাত্রীদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি জড়িত।
কালের কণ্ঠ : উচ্চশিক্ষার জন্য একটা সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। এখানে সে রকম পরিবেশ আছে কি? এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি দেশের বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। আমাদের দেশে আয়তনের তুলনায় বেশি মানুষ বাস করে। এর একটা চাপ আছে। সেই চাপ এই বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা, তাতে অত্যধিক চাপ পড়ে। এবং সেই কারণে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা আর না বাড়িয়ে সংখ্যাটি স্থিতিশীল রেখে সবার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। এই ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী ধারণক্ষম একটি ক্যাম্পাস বিন্যস্ত করতে হবে। সেটা যদি করা যায়, অনেক সমস্যার সমাধান করা যাবে এবং জ্ঞানচর্চায় উৎকর্ষ বাড়বে।
কালের কণ্ঠ : ছাত্র নেতৃত্ব অর্থাৎ গণতন্ত্রচর্চার বিকাশের একটা প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ডাকসু। সেটা ২০ বছর ধরে বন্ধ। আপনি উপাচার্যের স্থানে আসার পর সবার মনে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছিল, ডাকসু নির্বাচন হবে। কিন্তু সেটার দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আসলে কি ডাকসু নির্বাচন সম্ভব হবে?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ডাকসু নির্বাচন হওয়া জরুরি। কিন্তু ডাকসু চালু করতে গিয়ে ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক গতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় কি না, সেটাও আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমরা একটি সুযোগে ডাকসুর নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করব। কিন্তু পাশাপাশি আমরা এটাও নিশ্চিত করতে চাই_ডাকসুর কার্যক্রম শুরু করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন না ঘটানো। দুটো যাতে একসঙ্গে সংঘটিত হয়। সেটার জন্য সময়ের অপেক্ষা; এবং বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বোঝাপড়ার দরকার আছে। মানে, তাদের একটা ঐকমত্যে আসা। আমরা দেখি, দলগুলোর মধ্যে যে বিরোধ-অন্তর্বিরোধ আছে, এগুলো যদি আবার শুরু হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়, সেই আশঙ্কাও আমাদের মধ্যে কাজ করে।
কালের কণ্ঠ : এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির একটা ভয়ানক চেহারা দেখা যায়। এ থেকে উত্তরণের কি উপায় আছে বলে মনে করেন?
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ছাত্ররাজনীতি সব সময়ই আমি পজিটিভলি দেখার চেষ্টা করি। ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতি করবে, এটাই স্বাভাবিক। ছাত্ররা নিজস্ব আদর্শ ধারণ করে মতামত দেবে। এমনকি শিক্ষকরাও নিজস্ব আদর্শ ধারণ করে কাজে নিয়োজিত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সব সময়ই মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ বছরের ঐতিহ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব কিছুই উন্মুক্ত। এখানে প্রত্যেকে মতামত ব্যক্ত করে, প্রতিবাদ করে। ছাত্রসংগঠনগুলো নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যায়।
কিন্তু সে ক্ষেত্রে রাজনীতি কেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে? এটা হওয়ার কথা নয়। যেটা সব সময় লক্ষ করি, রাজনীতির সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ যখন যুক্ত হয়ে যায়, তখন সেখানে কিন্তু আর রাজনীতি থাকে না। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে মানুষ যদি রাজনীতি নিয়ে আসে কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ প্রোপাগান্ডা নিয়ে হাজির হয়, তখন আর রাজনীতি থাকে না। সেটা হয়ে ওঠে নিজ স্বার্থের জন্য কাজ করা। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস আছে, রাজনৈতিক আদর্শের কারণে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে সুস্থ রাজনীতি। সেই রাজনীতিতে আমাদের ফিরে যেতে হবে। এবং সে জন্যই ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজন আছে। এতে গণতন্ত্রের সুগভীর ভিত্তি রচিত হবে। আমরা কিছুদিন গণতন্ত্রের চর্চা করি, আবার কিছুদিন পর হোঁচট খেয়ে লুটিয়ে পড়ে। তাতে পুরো রাজনীতিই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের গণতন্ত্রকে অনেক বেশি সুসংহত করা দরকার। দেশে গণতন্ত্রচর্চা যত নিষ্কলুষ হবে, ক্যাম্পাসগুলোতে ততই সুস্থ রাজনীতির চর্চা হবে।
কালের কণ্ঠ : এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ বছর পূর্ণ হলো। এই শতাব্দীতে এসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কী প্রত্যাশা করবে? আর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে কী আশা করবে? আপনার মতামত...
ড. আরেফিন সিদ্দিক : ৯০ বছরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ইতিহাস। এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা হচ্ছে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। অর্থাৎ এ অঞ্চলের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধি। সেই বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি এখন দরকার। এই বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে বেগবান করাটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেটা আমরা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে এ দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে, কারা নেতৃত্ব দেবে, সেই নেতৃত্ব নির্মাণ করে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই ক্যাম্পাসে এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশ কিভাবে চলবে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে। আমি সেভাবেই আশা করি। আমাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা নিজেদের এমনভাবে প্রস্তুত করবে যে শুধু সার্টিফিকেটের জন্য নয়; পড়াশোনা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে নিজেদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শুধু এ দেশেই নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেও যেন তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
No comments