মৃদুকন্ঠ-গণতন্ত্রে সোনার পাথরবাটি by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
প্রতিটি পদ্ধতির স্বকীয়তা থাকে। স্বকীয়তার গণ্ডি কখনো সংকীর্ণ, কখনো কিছুটা বিস্তৃত। পদ্ধতি কখনোই সীমা অতিক্রম করে না। গণ্ডি অতিক্রম করলে স্বকীয়তা বজায় থাকে না। পদ্ধতিটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। গণতন্ত্র একটি পদ্ধতি। গণতন্ত্রেরও স্বকীয়তা আছে। স্বকীয়তা বজায় রাখার গণ্ডি রয়েছে। গণতন্ত্রেরও বিচরণ ক্ষেত্রের সীমা-পরিসীমা আছে, যার বাইরে বিচরণ করলে স্বকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
তুলনা হিসেবে রাজতন্ত্রের কথা বলা যায়। রাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তা হলো জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এবং রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজার অবস্থান। রাজা মরণশীল ব্যক্তি হলেও রাজরক্ত অমর থাকবে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে চলমান থাকবে। চলমানতায় কোনো বিরতি বা ছেদ থাকবে না। কোথাও রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা হবেন। নিঃসন্তান হলে ভাই বা ভাইয়ের সন্তান রাজা হবেন। উত্তরাধিকারী এক বছরের শিশুসন্তান হলেও রাজার মৃত্যুর পর সেই অভিষিক্ত হবে রাজা হিসেবে। কোনো রাজতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা নেই যে উত্তরাধিকারী নাবালক হলে তার সাবালক হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বা রাজপরিবারবহির্ভূত কোনো ব্যক্তি রাজা হবেন, তিনি যত গুণী ব্যক্তিই হন না কেন। নাবালক উত্তরাধিকারীর অভিভাবক হতে পারবেন, কিন্তু রাজা হতে পারবেন না। রাজা হবে ওই শিশুটিই। কারণ একটাই। রাজরক্তের চলমানতা। এই চলমানতায় ছেদ পড়বে না। ছেদ পড়লেই রাজতন্ত্র লঙ্ঘিত হবে।
একইভাবে কোনো রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে, গণতন্ত্রের স্বকীয়তা হবে চলমানতা। গণতন্ত্রে ছেদ পড়তে পারবে না। ছেদ পড়ল ওই সময় গণতন্ত্র থাকে না। রাষ্ট্রের রিপাবলিক চরিত্র বিলুপ্ত হয়। এ কারণে গণতন্ত্র হত্যা করে বলপ্রয়োগ করে সামরিক শাসন জারি করার পর গণতন্ত্রে ছেদ পড়ে। কিছুকাল পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও সামরিক শাসনকাল গণতন্ত্রের বিচারে অবৈধ হয়েই থাকবে। জোড়াতালির কোনো অবকাশ নেই। সামরিক শাসন গণতন্ত্রের বিনাশক। গণতন্ত্রের চলমানতায় ছেদ পড়ে সামরিক শাসনে। গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হয় এবং বিরতিকালকে অগণতান্ত্রিকই বলতে হয়।
রাষ্ট্রের রিপাবলিক বা গণতান্ত্রিক চরিত্র বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। গণতন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ নাগরিকদের শাসন। প্রাচীন গ্রিসে নগররাষ্ট্রে নাগরিকরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেতেন। বর্তমানে সিটি স্টেট বা নগররাষ্ট্রের বিবর্তন ঘটে ভূখণ্ড-রাষ্ট্রের প্রচলন ঘটেছে এবং একটি নগরের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে ওই ভূখণ্ডের বিশাল জনগোষ্ঠীর সবাই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন না। তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। এটাই গণতান্ত্রিকতা। এটাই গণতন্ত্রের স্বকীয়তা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই স্বকীয়তায় ছেদ পড়তে পারবে না। চলমানতায় কোনো বিরতি গ্রহণযোগ্য হবে না। রাজতন্ত্রে যেমন রাজার না হলেও রাজরক্তের অবিচ্ছিন্ন চলমানতা থাকে, তেমনি গণতন্ত্রে নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা সরকার পরিচালনায় অবিচ্ছিন্ন চলমানতা অপরিহার্য। এখানে কোনো বিরতি বা ছেদ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিরতিকালে গণতন্ত্র থাকে না। রাষ্ট্রের রিপাবলিক চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়।
গণতান্ত্রিক চলমানতায় 'অন্তর্বর্তীকাল' বলে কোনো কথা নেই। অন্তর্বর্তীকাল অর্থই হলো চলমানতায় ছেদন। চলমানতা বিঘি্নত হলে গণতন্ত্র থাকে না; অন্তত অন্তর্বর্তীকালে। গণতান্ত্রিক চলমানতায় ছেদ পড়তে পারে দুইভাবে। শক্তি প্রয়োগ দ্বারা অথবা সমঝোতায়। গণতান্ত্রিক সরকার হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখল করা সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সমঝোতা দ্বারা অনির্বাচিত 'তত্ত্বাবধায়ক' সরকার গঠন শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র পরিহার করার দৃষ্টান্ত। উভয় ক্ষেত্রেই নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ছেদ পড়ে, যা রাষ্ট্রের রিপাবলিক চরিত্র হরণ করে থাকে। অবশ্য সামরিক আইনের জবরদখল এবং তত্ত্বাবধায়কের সমঝোতার মধ্যে গণতান্ত্রিক চরিত্র হরণের ধরন ও মাত্রার পার্থক্য অনেক। নাগরিকদের কাছে এ দুইয়ের গ্রহণযোগ্যতার পার্থক্যও পর্বতপ্রমাণ।
সম্প্রতি বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে, উচ্চ আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করার পর থেকে। উচ্চ আদালত বিচার করছে সম্পূর্ণ আইনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। সেখানে তাত্তি্বকতা নেই। কোনো দল বা গোষ্ঠীর চিন্তাচেতনা নেই। ভালোমন্দ চিন্তার অবকাশ নেই। দেশের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। সাংবিধানিক আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কি না, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য।
আমরা সাধারণ নাগরিকরা বিশেষজ্ঞ নই। আমাদের সুবিধা এখানেই। বিশেষ কোনো জ্ঞান আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে না। সাধারণ জ্ঞানের স্বচ্ছতাই আমাদের দৃষ্টিকে প্রখর করে। সেই স্বচ্ছতা দিয়েই আমরা বিশ্লেষণ করব বিষয়টি।
সংবিধানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামকরণ করা হয়েছে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'। চার মূলনীতিতে রয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রয়েছে। সংবিধানের ১ ধারায়ই রাষ্ট্রটিকে একটি 'প্রজাতন্ত্র' হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি 'রিপাবলিক' শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো 'প্রজাতন্ত্র'। ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র অর্থ কী? নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের রাষ্ট্রশাসন প্রক্রিয়াই হলো প্রজাতন্ত্র। নাগরিক অর্থে প্রজা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর আদিরূপ আমরা দেখতে পাই নগররাষ্ট্রে, যেখানে সব নাগরিক মিলে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিতেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। নগররাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল কয়েক শ বা হাজার। কালের বিবর্তনে রাষ্ট্রের পরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে। নগরের পরিধি পেরিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২(ক) ধারায় রাষ্ট্রসীমা নির্ধারণ করা রয়েছে যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার আগে যেসব এলাকা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল, ওই সব এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে।
সংবিধানে বর্ণিত এলাকা বা ভূখণ্ডে তখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে কমবেশি ১৬ কোটি। কাজেই নগররাষ্ট্রের মতো সব নাগরিক মিলে রাষ্ট্রশাসন সম্ভব নয়। ভূখণ্ডভিত্তিক কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষেই এটা সম্ভব নয়। ওই কারণে রিপাবলিকের বিবর্তিত ধারণা হচ্ছে, 'সকল নাগরিকের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা রাষ্ট্রশাসন।' বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(১) ধারায় ওই ধারণার প্রকাশ ঘটেছে_'প্রজাতন্ত্রে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।' পরবর্তী পর্যায়ে লেজিসলেচার অধ্যায়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান দান করা হয়েছে। এভাবেই সংবিধানে গণতন্ত্র সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যাত। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়লে, বিরতিকালে গণতান্ত্রিকতা ব্যাহত হয় বিধায় ওই সময়টুকু এবং ওই সময়ের বিধিবিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা নির্ধারণের দায়িত্ব উচ্চ আদালতের। অতএব, উচ্চ আদালত সাংঘর্ষিক ঘোষণা করার পর সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল বলে গণ্য হয়। সংবিধানের ৭(২) ধারামতে, 'অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সঙ্গে অসমাঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতখানি অসমাঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে।'
উচ্চ আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘোষণার পর 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' বিধান স্বভাতই বিলুপ্ত হয়েছে। এ নিয়ে বোধকরি মতবিরোধ নেই। গোল বেঁধেছে পরবর্তী করণীয় নিয়ে। উচ্চ আদালত বলছেন, সংসদ চাইলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হতে পারবে। প্রশ্ন উঠেছে, সংসদ চাইলেও অসামঞ্জস্য বিধান অবৈধ নয়? তাহলে বাতিলের পর তা কিভাবে কার্যকর হবে?
উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভূতাপেক্ষ বাতিল করেনি, যদিও অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। প্রশ্ন জাগবে, যে পদ্ধতি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তা অতীতেও যেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। কাজেই ভবিষ্যতের জন্য বাতিল ঘোষিত হলে, অতীতের জন্য বাতিল হবে না কেন? প্রকৃতপক্ষে অতীতের অসংগতিও বাতিলযোগ্য, কিন্তু বাতিল করা হয়নি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। এই দ্বৈত আচরণ কেন এবং দ্বৈত আচরণের ক্ষমতা কি আদালতের আছে?
আদালতের হাত নাকি অনেক লম্বা। মানবজাতির সুদীর্ঘকাল আইন পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে এই আপস। সংসদ আইনপ্রণেতা। প্রশাসন আইনপ্রয়োগকারী। বিচার বিভাগ মিলিয়ে দেখবে কর্ম আইনানুযায়ী হয়েছে কি না। মেলাতে গিয়ে যদি এমন সমস্যার উদ্ভব হয় যে আইনের নিক্তি মেপে রায় দিলে সমাধান হয় না, বরং সমস্যা বেড়ে যায়। তখন উচ্চ আদালতের সহজাত ক্ষমতা হলো 'মার্জনা' করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বেশ কটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এগুলো নির্বাচিত নয় বিধায় গণতান্ত্রিক নয়। বরং সমঝোতার সরকার হিসেবে সবাই মেনে নিয়েছে। সংবিধানের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে এর অসংগতি রয়েছে_এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সবাই মেনে নিয়েছে, এ কথাও সত্য। ঘটে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করলে, তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনও বাতিল হয়ে যায়, সংসদ বাতিল হয়ে যায়; কাজকর্ম বাতিল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া অসংগতি 'মার্জনা' করাই কি শ্রেয় নয়? সম্ভবত আদালত এ কারণেই বাতিল আদেশের ভূতাপেক্ষ কার্যকারণ দেননি। এই মার্জনার কারণে জটিলতা পরিহার করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের ভবিষ্যৎ কার্যকারণ বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক। যে ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেটি ভবিষ্যতে কেন ঘটবে? সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পাঠ করে যেটুকু বোঝা গেল, তা হলো ভবিষ্যতের দুটি নির্বাচনের জন্যও আদালত 'মার্জনা' করেছেন, তবে শর্ত থাকে যে 'যদি সংসদ তেমনি চায়।' অর্থাৎ সংসদ চাইলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন কোনো ধরনের অসংগতিপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের 'ত্রুটি' আদালত অগ্রিম 'মার্জনা' করেছেন। এ মার্জনা গ্রহণ করা যেতে পারে, আবার গ্রহণ না করাও যেতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এত উদার ব্যবস্থা?
কেন_এর উত্তর এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছি। ১২ ঘণ্টা ও ৩৬ ঘণ্টার হরতাল আমরা দেখেছি। এরপর নাকি ৪৮ ঘণ্টা এবং লাগাতারের পালা। এর অর্থ কী? পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে থাকে। সমস্যা বাংলাদেশে। সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরের প্রতি আস্থার প্রবল সংকট, তা যতই অযৌক্তি হোক না কেন। সম্ভবত এ কারণেই আদালত দুটি নির্বাচনের ভবিষ্যৎ মার্জনার ব্যবস্থা রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব সংসদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। লক্ষণীয়, আদালত ভবিষ্যৎ দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে করার অনুমোদন দেননি, প্রস্তাবনাও করেননি। আস্থা সংকটের ফলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সামলে দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদকে অসংগতিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাময়িক সুযোগ বজায় রেখেছেন। এটাই হতে পারে উচ্চ আদালতের আগাম মার্জনা ঘোষণার প্রাসঙ্গিকতা।
জনগণ গভীর আগ্রহে লক্ষ করছে, রাজনৈতিক নেতারা কি গণতান্ত্রিক ব্যবহার প্রদর্শন করবেন, নাকি এখনো 'অপরিণত' ব্যবহার প্রদর্শন করতে থাকবেন। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশ গণতন্ত্রচর্চায় সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েও নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারছে না। এটা কী আমাদের গণতান্ত্রিক অপরিপক্বতা, নাকি কোনো কোনো দলের ইচ্ছাকৃত অপকৌশল। রিপাবলিক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে থাকতে হবে নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক সরকার। ছেদ পড়ার সুযোগ নেই। ছেদ পড়লেই গণতন্ত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। গণতন্ত্রে অগণতান্ত্রিকতার মিশ্রণ ঘটে। হয়ে দাঁড়ায় সোনার পাথরবাটির মতো! তা ছাড়া অগণতান্ত্রিক সরকারের অশুভ শক্তির সমর্থনে দীর্ঘায়িত হওয়ার যে উদগ্র বাসনা থাকে, তা তো ২০০৭-০৮ দুই বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব, যত শিগগির আমরা গণতান্ত্রিক অপরিপক্বতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব, তত দ্রুত গণতন্ত্র বিষয়ে সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমরা সফলকাম হব।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট
একইভাবে কোনো রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে, গণতন্ত্রের স্বকীয়তা হবে চলমানতা। গণতন্ত্রে ছেদ পড়তে পারবে না। ছেদ পড়ল ওই সময় গণতন্ত্র থাকে না। রাষ্ট্রের রিপাবলিক চরিত্র বিলুপ্ত হয়। এ কারণে গণতন্ত্র হত্যা করে বলপ্রয়োগ করে সামরিক শাসন জারি করার পর গণতন্ত্রে ছেদ পড়ে। কিছুকাল পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও সামরিক শাসনকাল গণতন্ত্রের বিচারে অবৈধ হয়েই থাকবে। জোড়াতালির কোনো অবকাশ নেই। সামরিক শাসন গণতন্ত্রের বিনাশক। গণতন্ত্রের চলমানতায় ছেদ পড়ে সামরিক শাসনে। গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হয় এবং বিরতিকালকে অগণতান্ত্রিকই বলতে হয়।
রাষ্ট্রের রিপাবলিক বা গণতান্ত্রিক চরিত্র বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। গণতন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ নাগরিকদের শাসন। প্রাচীন গ্রিসে নগররাষ্ট্রে নাগরিকরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেতেন। বর্তমানে সিটি স্টেট বা নগররাষ্ট্রের বিবর্তন ঘটে ভূখণ্ড-রাষ্ট্রের প্রচলন ঘটেছে এবং একটি নগরের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে ওই ভূখণ্ডের বিশাল জনগোষ্ঠীর সবাই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন না। তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। এটাই গণতান্ত্রিকতা। এটাই গণতন্ত্রের স্বকীয়তা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই স্বকীয়তায় ছেদ পড়তে পারবে না। চলমানতায় কোনো বিরতি গ্রহণযোগ্য হবে না। রাজতন্ত্রে যেমন রাজার না হলেও রাজরক্তের অবিচ্ছিন্ন চলমানতা থাকে, তেমনি গণতন্ত্রে নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা সরকার পরিচালনায় অবিচ্ছিন্ন চলমানতা অপরিহার্য। এখানে কোনো বিরতি বা ছেদ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিরতিকালে গণতন্ত্র থাকে না। রাষ্ট্রের রিপাবলিক চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়।
গণতান্ত্রিক চলমানতায় 'অন্তর্বর্তীকাল' বলে কোনো কথা নেই। অন্তর্বর্তীকাল অর্থই হলো চলমানতায় ছেদন। চলমানতা বিঘি্নত হলে গণতন্ত্র থাকে না; অন্তত অন্তর্বর্তীকালে। গণতান্ত্রিক চলমানতায় ছেদ পড়তে পারে দুইভাবে। শক্তি প্রয়োগ দ্বারা অথবা সমঝোতায়। গণতান্ত্রিক সরকার হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখল করা সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সমঝোতা দ্বারা অনির্বাচিত 'তত্ত্বাবধায়ক' সরকার গঠন শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্র পরিহার করার দৃষ্টান্ত। উভয় ক্ষেত্রেই নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ছেদ পড়ে, যা রাষ্ট্রের রিপাবলিক চরিত্র হরণ করে থাকে। অবশ্য সামরিক আইনের জবরদখল এবং তত্ত্বাবধায়কের সমঝোতার মধ্যে গণতান্ত্রিক চরিত্র হরণের ধরন ও মাত্রার পার্থক্য অনেক। নাগরিকদের কাছে এ দুইয়ের গ্রহণযোগ্যতার পার্থক্যও পর্বতপ্রমাণ।
সম্প্রতি বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে, উচ্চ আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করার পর থেকে। উচ্চ আদালত বিচার করছে সম্পূর্ণ আইনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। সেখানে তাত্তি্বকতা নেই। কোনো দল বা গোষ্ঠীর চিন্তাচেতনা নেই। ভালোমন্দ চিন্তার অবকাশ নেই। দেশের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। সাংবিধানিক আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কি না, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য।
আমরা সাধারণ নাগরিকরা বিশেষজ্ঞ নই। আমাদের সুবিধা এখানেই। বিশেষ কোনো জ্ঞান আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে না। সাধারণ জ্ঞানের স্বচ্ছতাই আমাদের দৃষ্টিকে প্রখর করে। সেই স্বচ্ছতা দিয়েই আমরা বিশ্লেষণ করব বিষয়টি।
সংবিধানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামকরণ করা হয়েছে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'। চার মূলনীতিতে রয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রয়েছে। সংবিধানের ১ ধারায়ই রাষ্ট্রটিকে একটি 'প্রজাতন্ত্র' হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি 'রিপাবলিক' শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো 'প্রজাতন্ত্র'। ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র অর্থ কী? নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের রাষ্ট্রশাসন প্রক্রিয়াই হলো প্রজাতন্ত্র। নাগরিক অর্থে প্রজা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর আদিরূপ আমরা দেখতে পাই নগররাষ্ট্রে, যেখানে সব নাগরিক মিলে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিতেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। নগররাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল কয়েক শ বা হাজার। কালের বিবর্তনে রাষ্ট্রের পরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে। নগরের পরিধি পেরিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২(ক) ধারায় রাষ্ট্রসীমা নির্ধারণ করা রয়েছে যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার আগে যেসব এলাকা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল, ওই সব এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে।
সংবিধানে বর্ণিত এলাকা বা ভূখণ্ডে তখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে কমবেশি ১৬ কোটি। কাজেই নগররাষ্ট্রের মতো সব নাগরিক মিলে রাষ্ট্রশাসন সম্ভব নয়। ভূখণ্ডভিত্তিক কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষেই এটা সম্ভব নয়। ওই কারণে রিপাবলিকের বিবর্তিত ধারণা হচ্ছে, 'সকল নাগরিকের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা রাষ্ট্রশাসন।' বাংলাদেশ সংবিধানের ৭(১) ধারায় ওই ধারণার প্রকাশ ঘটেছে_'প্রজাতন্ত্রে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।' পরবর্তী পর্যায়ে লেজিসলেচার অধ্যায়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান দান করা হয়েছে। এভাবেই সংবিধানে গণতন্ত্র সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যাত। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়লে, বিরতিকালে গণতান্ত্রিকতা ব্যাহত হয় বিধায় ওই সময়টুকু এবং ওই সময়ের বিধিবিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা নির্ধারণের দায়িত্ব উচ্চ আদালতের। অতএব, উচ্চ আদালত সাংঘর্ষিক ঘোষণা করার পর সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল বলে গণ্য হয়। সংবিধানের ৭(২) ধারামতে, 'অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সঙ্গে অসমাঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতখানি অসমাঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে।'
উচ্চ আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘোষণার পর 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' বিধান স্বভাতই বিলুপ্ত হয়েছে। এ নিয়ে বোধকরি মতবিরোধ নেই। গোল বেঁধেছে পরবর্তী করণীয় নিয়ে। উচ্চ আদালত বলছেন, সংসদ চাইলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হতে পারবে। প্রশ্ন উঠেছে, সংসদ চাইলেও অসামঞ্জস্য বিধান অবৈধ নয়? তাহলে বাতিলের পর তা কিভাবে কার্যকর হবে?
উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভূতাপেক্ষ বাতিল করেনি, যদিও অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। প্রশ্ন জাগবে, যে পদ্ধতি সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তা অতীতেও যেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। কাজেই ভবিষ্যতের জন্য বাতিল ঘোষিত হলে, অতীতের জন্য বাতিল হবে না কেন? প্রকৃতপক্ষে অতীতের অসংগতিও বাতিলযোগ্য, কিন্তু বাতিল করা হয়নি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। এই দ্বৈত আচরণ কেন এবং দ্বৈত আচরণের ক্ষমতা কি আদালতের আছে?
আদালতের হাত নাকি অনেক লম্বা। মানবজাতির সুদীর্ঘকাল আইন পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে এই আপস। সংসদ আইনপ্রণেতা। প্রশাসন আইনপ্রয়োগকারী। বিচার বিভাগ মিলিয়ে দেখবে কর্ম আইনানুযায়ী হয়েছে কি না। মেলাতে গিয়ে যদি এমন সমস্যার উদ্ভব হয় যে আইনের নিক্তি মেপে রায় দিলে সমাধান হয় না, বরং সমস্যা বেড়ে যায়। তখন উচ্চ আদালতের সহজাত ক্ষমতা হলো 'মার্জনা' করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বেশ কটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এগুলো নির্বাচিত নয় বিধায় গণতান্ত্রিক নয়। বরং সমঝোতার সরকার হিসেবে সবাই মেনে নিয়েছে। সংবিধানের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে এর অসংগতি রয়েছে_এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সবাই মেনে নিয়েছে, এ কথাও সত্য। ঘটে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করলে, তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনও বাতিল হয়ে যায়, সংসদ বাতিল হয়ে যায়; কাজকর্ম বাতিল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া অসংগতি 'মার্জনা' করাই কি শ্রেয় নয়? সম্ভবত আদালত এ কারণেই বাতিল আদেশের ভূতাপেক্ষ কার্যকারণ দেননি। এই মার্জনার কারণে জটিলতা পরিহার করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের ভবিষ্যৎ কার্যকারণ বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক। যে ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেটি ভবিষ্যতে কেন ঘটবে? সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পাঠ করে যেটুকু বোঝা গেল, তা হলো ভবিষ্যতের দুটি নির্বাচনের জন্যও আদালত 'মার্জনা' করেছেন, তবে শর্ত থাকে যে 'যদি সংসদ তেমনি চায়।' অর্থাৎ সংসদ চাইলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন কোনো ধরনের অসংগতিপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের 'ত্রুটি' আদালত অগ্রিম 'মার্জনা' করেছেন। এ মার্জনা গ্রহণ করা যেতে পারে, আবার গ্রহণ না করাও যেতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এত উদার ব্যবস্থা?
কেন_এর উত্তর এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছি। ১২ ঘণ্টা ও ৩৬ ঘণ্টার হরতাল আমরা দেখেছি। এরপর নাকি ৪৮ ঘণ্টা এবং লাগাতারের পালা। এর অর্থ কী? পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে থাকে। সমস্যা বাংলাদেশে। সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরের প্রতি আস্থার প্রবল সংকট, তা যতই অযৌক্তি হোক না কেন। সম্ভবত এ কারণেই আদালত দুটি নির্বাচনের ভবিষ্যৎ মার্জনার ব্যবস্থা রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব সংসদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। লক্ষণীয়, আদালত ভবিষ্যৎ দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে করার অনুমোদন দেননি, প্রস্তাবনাও করেননি। আস্থা সংকটের ফলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সামলে দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদকে অসংগতিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাময়িক সুযোগ বজায় রেখেছেন। এটাই হতে পারে উচ্চ আদালতের আগাম মার্জনা ঘোষণার প্রাসঙ্গিকতা।
জনগণ গভীর আগ্রহে লক্ষ করছে, রাজনৈতিক নেতারা কি গণতান্ত্রিক ব্যবহার প্রদর্শন করবেন, নাকি এখনো 'অপরিণত' ব্যবহার প্রদর্শন করতে থাকবেন। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশ গণতন্ত্রচর্চায় সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েও নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারছে না। এটা কী আমাদের গণতান্ত্রিক অপরিপক্বতা, নাকি কোনো কোনো দলের ইচ্ছাকৃত অপকৌশল। রিপাবলিক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে থাকতে হবে নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক সরকার। ছেদ পড়ার সুযোগ নেই। ছেদ পড়লেই গণতন্ত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। গণতন্ত্রে অগণতান্ত্রিকতার মিশ্রণ ঘটে। হয়ে দাঁড়ায় সোনার পাথরবাটির মতো! তা ছাড়া অগণতান্ত্রিক সরকারের অশুভ শক্তির সমর্থনে দীর্ঘায়িত হওয়ার যে উদগ্র বাসনা থাকে, তা তো ২০০৭-০৮ দুই বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব, যত শিগগির আমরা গণতান্ত্রিক অপরিপক্বতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব, তত দ্রুত গণতন্ত্র বিষয়ে সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমরা সফলকাম হব।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট
No comments