বনলাউডোগের পদাবলি by জয়নুল আবেদীন
বনলাউডোগ সুন্দরবন-সংলগ্ন একটি গ্রাম। সহস্রাধিক অধিবাসী এ গ্রামের বাসিন্দা। আইলা ও সিডরের জলোচ্ছ্বাসের আগে গ্রামবাসীর কোনো কিছুর অভাব ছিল না। পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, ফসলের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কৃষকের চোখ জুড়িয়ে যেত। এখন আম, কাঁঠাল, সুপারি গাছ নোনার প্রভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। পুকুরের মাছ মরে যাচ্ছে।
বনলাউডোগের মতো বহু গ্রাম খোলপেটুয়া, মালঞ্চ, আঙ্গরপাশা, রায়মঙ্গল, শিবসন প্রভৃতি নদীর পানিতে সকাল-বিকেল ডুবে যায়। শ্যামপুর থানার পদ্মপুকুর ও গাবুরা ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের অধিবাসী জলমগ্ন বাড়িঘরে যেতে পারে না। কোথাও একটু উঁচু স্কুলঘরে কিংবা ভেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়ি ঘরের বাসিন্দা। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল এই বানভাসি মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন ব্যবস্থা নেয়নি। একে ফারাক্কার প্রভাব, অন্যদিকে ধনী দেশগুলোর অধিকতর কার্বন নিঃসরণের ফলে বাংলাদেশ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদী ভাঙন প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলসহ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে দেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে এবং সমগ্র বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের ৩০টি জেলার প্রায় সাত কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ১৯ জেলার সাড়ে চার কোটি মানুষ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে বদলে যাচ্ছে ভূপ্রকৃতি, ভূমিহীন হচ্ছে অসংখ্য মানুষ, ফলে বদলে যাচ্ছে মানুষের পেশা। আশ্রয়হীন ও উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ইতিমধ্যে ৬০ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে বস্তিবাসী হয়েছে। কিছু লোক দেশান্তরিতও হয়েছে। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর ও কঙ্বাজারের দ্বীপাঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়। ১৯ জেলার চার কোটি মানুষের ৫৪ শতাংশ পরিবার কার্যকরভাবে ভূমিহীন। মাত্র ১২ শতাংশ পরিবার ৪৭ শতাংশ জমির মালিক। তাই উপকূলের অধিকাংশ মানুষ হয় দিনমজুর কিংবা ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে মাছ শিকারে যায়। প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ছোবলে প্রাণ হারায় এসব অসহায় মানুষ। ইউএনডিপির প্রাকৃতিক দুর্যোগের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এশিয়ার সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশ। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে বিশ্বে ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেছে আড়াই লাখ মানুষ, যার ৬০ শতাংশ বাংলাদেশের। বর্তমানে ৪০ বছরে তিন হাজার বর্গকিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৪০ বছরে ভোলা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে। পটুয়াখালী, ভোলা, বৃহত্তর খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষের পেশা বদলে যাচ্ছে। ইলিশ, পাঙ্গাশ, কোরাল, রূপচাঁদাসহ সামুদ্রিক মাছ কমে যাওয়ায় মাছের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে। তার ওপর জলদস্যুদের আক্রমণ। আবার ইলিশ মাছও পদ্মা ত্যাগ করে ভারতের নর্মদা ও বার্মার দিকে তাদের রুট পরিবর্তন করছে। ফারাক্কার প্রভাবে জলপ্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমান্বয়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় যেমন পানীয়জলের প্রকট অভাব সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি শাকসবজি ও ফলফলাদির গাছ মরে যাচ্ছে। ফলে পশুপাখি স্থানান্তর হতে শুরু করেছে এবং হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবনের অস্তিত্ব। ইতিমধ্যেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জনসংখ্যার সাড়ে চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি মানুষ অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং অধিকাংশ মানুষ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাবে উদ্বাস্তু হবে। রামপাল ও সমগ্র বাগেরহাট অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যা ধারণার বাইরে। কিয়োটো প্রটোকলে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০১২ সালের মধ্যে ধনী দেশগুলোকে কঠোরভাবে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে এবং তাপমাত্রা স্থির করে দিতে হবে। কেননা বিশ্বের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বাড়লেই গরিব দেশগুলো বিশেষ করে সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। দেশগুলো কল্পনাতীত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, জি-৮ দেশগুলো ২০০ বছর ধরে কার্বন নিঃসরণ করে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর জন্য পির্যয়ের সৃষ্টি করেছে অথচ কার্যত তারা কিছুই করছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ সমুদ্রসংলগ্ন দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। লঙ্ঘিত হচ্ছে জীবন, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, অন্ন-বস্ত্র, জীবিকা, শিক্ষা, সুপেয় পানি, ব্যক্তিনিরাপত্তা, পারিবারিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, চিকিৎসা ও সামাজিক অধিকার। এসব অধিকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধান, আন্তর্জাতিক নাগরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের সনদ। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর অধিকারগুলো থেকে এসব দুর্গত নাগরিক_নারী ও শিশু বঞ্চিত হচ্ছে। তাই জাতিসংঘের কর্তব্য হচ্ছে, ধনী দেশগুলো জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সনদ-১৯৮২, ওজোনস্তর-সংক্রান্ত মন্ট্রিয়ল প্রটোকল-১৯৮৭, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সনদ-১৯৯২, জীববৈচিত্র্য সনদ-১৯৯২, কিয়োটো প্রটোকল ১৯৯৭ ইত্যাদি রক্ষিত হচ্ছে কি না তা দেখভাল করা এবং ধনী দায়ী রাষ্ট্রগুলোকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। কেননা কিয়োটো প্রটোকল ও জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অনিষ্টকর প্রভাব ঠেকাতে_এ রকম উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৫০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে। পরিবেশ বাঁচাতে ধনী দেশগুলোর আয়ের ০.৭ শতাংশ ব্যয় করবে এবং ২০১০ সালের মধ্যে তাদের ঋণ শোধ করবে। কিন্তু যুক্তরাজ্য সামান্য কিছু অর্থ দেওয়া ছাড়া ধনী দেশগুলোর মোড়ল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও অন্য ধনী দেশগুলো কিছুই করেনি। ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে যেসব দেশ যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করেছে, তার দায় বহন করবে বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের দায় ৪৪ শতাংশ, জাপান ১৩ শতাংশ, জার্মানি ৭ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৫ শতাংশ। ইতালি, ফ্রান্স, কানাডা চার-পাঁচ শতাংশ করে এবং স্পেন, অস্ট্রেলিয়া ও কোরিয়া প্রজাতন্ত্র ৩ শতাংশ করে দায় বহন করবে। তারা শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং অনুস্বাক্ষর করেছে। কিন্তু তাদের ঋণ শোধ করছে না। কারণ জাতিসংঘের তাদের বাধ্য করার ক্ষমতা নেই। ধনী রাষ্ট্রগুলোর এককেন্দ্রিক বিশ্বের মোড়ল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এরই মধ্যে চীন শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় দ্বিতীয় এবং ভারত ও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। তাদেরও কার্বন নিঃসরণের দায় বহন করতে হবে। জলবায়ুর অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। নয়া উপনিবেশবাদী বিশ্বের নেতা যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার মিত্ররা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া প্রভৃতি দেশে অন্যায় যুদ্ধে নিরীহ মানুষ, নারী ও শিশু হত্যার জন্য বছরে এক লাখ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। অথচ মানবাধিকারের মেকি প্রবক্তা ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী এসব ধনিকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুত দায় ৫০ বিলিয়ন শোধ করছে না। কবি নজরুলের ভাষায়_'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।' তৃতীয় বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলো একাট্টা হয়ে তাদের ২০০ বছরের কার্বন নির্গমনের দায় শোধ করতে ধনী দেশগুলোর অনূ্যন জাতীয় আয়ের এক শতাংশ দিতে বাধ্য করতে হবে। এটা কোনোক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সাহায্য নয়, তাদের ভয়াবহ ক্ষতির ক্ষতিপূরণ প্রদান মাত্র। আমাদের সরকারেরও ঔদাসীন্য ও অবহেলা আর নয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বেড়িবাঁধ দ্রুত মেরামত করা উচিত। বেড়িবাঁধ সম্ভাব্য জোয়ারের চেয়ে উঁচু এবং প্রশস্ত বাঁধ দিয়ে গাছপালা লাগাতে হবে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ব্রিটেনেও প্রবল ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আছে। তাই বলে কি ব্রিটেনবাসী দেশ ত্যাগ করবে? সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচু নেদারল্যান্ডস সুউচ্চ বাঁধ দিয়ে তার ওপর রাস্তা নির্মাণ এবং গাছপালা লাগিয়ে সুদৃঢ় ব্যবস্থা করেছে। অন্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেরাই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে কাজে লাগাতে হবে। আসন্ন কানকুন সম্মেলনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের দক্ষ, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ ও সরকারি প্রতিনিধিরা যেন সুচতুর ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারেন_বাংলাদেশের জনগণ সেই আশাই পোষণ করে।
লেখক : শিক্ষা গবেষক
লেখক : শিক্ষা গবেষক
No comments