আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩১)-ইতিহাস পড়াতেন ফাদার গিলেস্পি by আলী যাকের
আজ আমার নটর ডেম কলেজ জীবনের কথা উল্লেখ করতে চাই। কেননা এর পরবর্তী জীবনে আমার লেখাপড়ার প্রতি যদি কোনো ঔৎসুক্য হয়ে থাকে তার বীজ বপন করা হয়েছিল এই নটর ডেম কলেজেই। আমার এই আগ্রহের পেছনে যে তিনজন শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য, তাঁরা হলেন, নটর ডেম কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ ফাদার টি এ গাঙ্গুলী, ফাদার গিলেস্পি ও মিয়া মুহম্মদ আবদুল হামিদ।
ফাদার গাঙ্গুলী আমাদের লজিক পড়াতেন, ফাদার গিলেস্পি বিশ্ব-ইতিহাস এবং হামিদ স্যার বাংলা। হামিদ স্যারকে দিয়েই শুরু করি। তাঁর বাংলা ক্লাস করার জন্য আমরা সবাই উন্মুখ থাকতাম। দারুণ রসিক মানুষ ছিলেন এবং তিনি যখন রবীন্দ্রনাথ কী শরৎ পড়াতেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা গিলতাম। হামিদ স্যার ভীষণ রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। মাঝেমধ্যে তিনি রবীন্দ্র, শরৎচন্দ্র এবং নজরুলের সাহিত্যের ওপর তুলনামূলক ব্যাখ্যাও করতেন আমাদের বোঝার সুবিধার জন্য। তবে তাঁর অভিব্যক্তি ছিল অসাধারণ। শরৎচন্দ্রের 'দত্তা' উপন্যাসটি আমাদের পাঠ্য ছিল। তিনি সেই উপন্যাস পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বই বন্ধ করে হয়তো বলে উঠলেন, 'এই বাক্যটি লক্ষ করো।
তাহলেই বুঝতে পারবে, যে চন্দ্র, সে বসন্তেরই হোক কিংবা শরতের, রবির আলোয় আলোকিত।' অর্থাৎ শরৎচন্দ্রের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়ে গেল। একবার রবীন্দ্রনাথের 'হৈমন্তী' গল্পটি পড়ানোর সময় তিনি গল্পের শেষে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। গল্পের শেষে যখন হৈমন্তীর বাবা বাধ্য হলেন মেয়েকে না নিয়ে ফিরে যেতে এবং হৈমন্তী তাঁর নিজের শোবার ঘরে ফিরে গেলেন, তখন রবীন্দ্রনাথের একবাক্যের যে বর্ণনা, 'ইহার পর ঘরে কবাট পড়িল'_এই বাক্যটি উল্লেখ করে তিনি আমাদের বলেছিলেন, 'দেখো, কী অসাধারণ সমাপ্তি একটি গল্পের! এই বাক্যটি পড়লেই আমরা বুঝতে পারি মেয়েটির দুঃখের গভীরতা। আমাদের বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যায়। এখানে শরৎচন্দ্র হলে আমাদের তিনি সঙ্গে নিয়ে হৈমন্তীর সঙ্গে সঙ্গে তার শোবার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করতেন এবং সবিস্তারে বর্ণনা করতেন যে হৈমন্তী বিছানার ওপর আছড়ে পড়ল। তার বুকের নিচে বালিশ এবং সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।' এ রকম আরো কত যে ঘটনা রয়েছে হামিদ স্যারকে ঘিরে, তা বলে শেষ করা যাবে না। ১৭-১৮ বছরের তরুণদের মন তিনি বুঝতেন এবং প্রথম তিনটি ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই সেই মনগুলো জয় করে নিতেন।
ফাদার গিলেস্পি ইন্টারমিডিয়েট এবং বিএ ক্লাসে বিশ্ব ইতিহাস পড়াতেন। অথচ তাঁর ঠিকই মনে থাকত কোন ক্লাসে কতটুকু পড়িয়েছেন এবং ঠিক সেই জায়গা থেকে আবার পড়ানো শুরু করতেন। রোল কল করার পর রেজিস্টার খাতাটি বন্ধ করে ল্যাকটার্নে ভর করে অবলীলায় বিষয়ের ভেতরে ঢুকে যেতেন। তাঁর সঙ্গে কোনো কাগজপত্র থাকত না। আমাদের ইতিহাস কোর্সের কাল ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। গোটা ইতিহাস ছিল তাঁর নখদর্পণে। ভাবতে অবাক লাগে। ইতিহাস যে গল্পের মতো করে বলা যায়, তা ফাদার গিলেস্পির পড়ানো থেকেই প্রথম জানলাম।
পড়াতে পড়াতে একেবারে অভিব্যক্তিহীন চেহারায় অনেক হালকা রসিকতাও করতেন। আমরা হেসে কুটিকুটি। এ দেশে প্রবাসী এ জ্ঞানতাপস কয়েক বছর হলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি যখন সাদা গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরে আমাদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলতেন, তাঁকে আমরা 'লিন্ডওয়াল' বলে ডাকতাম। অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার রে লিন্ডওয়ালের সঙ্গে তাঁর চেহারার অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল। একদিন তিনি কৌতূহলী হয়ে এই নামকরণ সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমরা এই সাদৃশ্যের কথা বলায় তিনি মৃদু হেসে আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আমাকে তোমরা ক্রিকেট শেখাবে?' উচ্চ মা্যধমিকের দুই বছরের সামান্য সময়ের মধ্যে তাঁকে আমাদের ক্রিকেট শেখানো হয়নি। বছর দশেক আগে কী একটা কাজে কলেজে গিয়েছিলাম। হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা। বললাম, 'চিনতে পারছেন?' আবারও মৃদু হেসে বললেন, 'ব্যাচ ৬২ না?' ভাবলাম, যে মানুষটি গোটা বিশ্বের কয়েক শ বছরের ইতিহাস করোটির ভেতরে স্বাচ্ছন্দ্যে ধারণ করতে পারেন, তাঁর পক্ষে এই বিরাট বপুর মানুষটিকে ভুলে যাওয়া তো সহজে সম্ভব নয়।
ফাদার গাঙ্গুলী নটর ডেম কলেজের প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থায়ই ঢাকার অঙ্লিারি বিশপ এবং পরে আর্চবিশপ হয়েছিলেন।
লজিক সম্পর্কে আমার পরিচিত অনেকেই প্রথম থেকেই আমার মনে এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অথচ লজিকের মতো এমন সহজ ও মজার বিষয় আর আছে বলে আমি মনে করি না। কী ডিডাকশন, কী ইনডাকশন_উভয় লজিকেই বিশপ গাঙ্গুলীর ছিল অসামান্য বুৎপত্তি। আমার এখনো মনে পড়ে, ভোলানাথ রায়ের বই খুলে তিনি যখন ইনডাকটিভ লজিকের ফ্যালাসি পড়াতেন, বারবারা, চেলারেন্ট, দারি, ফেরিও, চেসারে, কামেস্ত্রেস, ফেস্তিনো, বারোকে আমাদের বুঝতে অথবা স্মরণ রাখতে একটুও অসুবিধা হতো না।
এখনো লজিকের যুক্তিগ্রাহ্যতার কারণেই আমি হয়তোবা যুক্তিহীন কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে পারি না। প্রসঙ্গত, আমার মনে পড়ছে, আমার অভিনীত গ্যালিলিও চরিত্রের একটি সংলাপের কথা। নাটকের শেষে যখন গ্যালিলিও তাঁর প্রিয় ছাত্র আন্দ্রিয়া সার্তিকে স্নেহভরে জিজ্ঞেস করেন, 'আন্দ্রিয়া, বিজ্ঞান আসলে কী? বিজ্ঞান হলো সন্দেহের মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধান। আর এই সন্দেহ বিষয়টিই ধর্মগুরুদের প্রধান ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা সন্দেহের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যদি সত্যকে আবিষ্কার করতে পারে তাহলে তারা আর কোনোকালেই ধর্মগুরুদের মানবে না।'
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
তাহলেই বুঝতে পারবে, যে চন্দ্র, সে বসন্তেরই হোক কিংবা শরতের, রবির আলোয় আলোকিত।' অর্থাৎ শরৎচন্দ্রের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়ে গেল। একবার রবীন্দ্রনাথের 'হৈমন্তী' গল্পটি পড়ানোর সময় তিনি গল্পের শেষে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। গল্পের শেষে যখন হৈমন্তীর বাবা বাধ্য হলেন মেয়েকে না নিয়ে ফিরে যেতে এবং হৈমন্তী তাঁর নিজের শোবার ঘরে ফিরে গেলেন, তখন রবীন্দ্রনাথের একবাক্যের যে বর্ণনা, 'ইহার পর ঘরে কবাট পড়িল'_এই বাক্যটি উল্লেখ করে তিনি আমাদের বলেছিলেন, 'দেখো, কী অসাধারণ সমাপ্তি একটি গল্পের! এই বাক্যটি পড়লেই আমরা বুঝতে পারি মেয়েটির দুঃখের গভীরতা। আমাদের বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যায়। এখানে শরৎচন্দ্র হলে আমাদের তিনি সঙ্গে নিয়ে হৈমন্তীর সঙ্গে সঙ্গে তার শোবার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করতেন এবং সবিস্তারে বর্ণনা করতেন যে হৈমন্তী বিছানার ওপর আছড়ে পড়ল। তার বুকের নিচে বালিশ এবং সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।' এ রকম আরো কত যে ঘটনা রয়েছে হামিদ স্যারকে ঘিরে, তা বলে শেষ করা যাবে না। ১৭-১৮ বছরের তরুণদের মন তিনি বুঝতেন এবং প্রথম তিনটি ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই সেই মনগুলো জয় করে নিতেন।
ফাদার গিলেস্পি ইন্টারমিডিয়েট এবং বিএ ক্লাসে বিশ্ব ইতিহাস পড়াতেন। অথচ তাঁর ঠিকই মনে থাকত কোন ক্লাসে কতটুকু পড়িয়েছেন এবং ঠিক সেই জায়গা থেকে আবার পড়ানো শুরু করতেন। রোল কল করার পর রেজিস্টার খাতাটি বন্ধ করে ল্যাকটার্নে ভর করে অবলীলায় বিষয়ের ভেতরে ঢুকে যেতেন। তাঁর সঙ্গে কোনো কাগজপত্র থাকত না। আমাদের ইতিহাস কোর্সের কাল ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। গোটা ইতিহাস ছিল তাঁর নখদর্পণে। ভাবতে অবাক লাগে। ইতিহাস যে গল্পের মতো করে বলা যায়, তা ফাদার গিলেস্পির পড়ানো থেকেই প্রথম জানলাম।
পড়াতে পড়াতে একেবারে অভিব্যক্তিহীন চেহারায় অনেক হালকা রসিকতাও করতেন। আমরা হেসে কুটিকুটি। এ দেশে প্রবাসী এ জ্ঞানতাপস কয়েক বছর হলো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি যখন সাদা গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরে আমাদের সঙ্গে বাস্কেটবল খেলতেন, তাঁকে আমরা 'লিন্ডওয়াল' বলে ডাকতাম। অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার রে লিন্ডওয়ালের সঙ্গে তাঁর চেহারার অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল। একদিন তিনি কৌতূহলী হয়ে এই নামকরণ সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমরা এই সাদৃশ্যের কথা বলায় তিনি মৃদু হেসে আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আমাকে তোমরা ক্রিকেট শেখাবে?' উচ্চ মা্যধমিকের দুই বছরের সামান্য সময়ের মধ্যে তাঁকে আমাদের ক্রিকেট শেখানো হয়নি। বছর দশেক আগে কী একটা কাজে কলেজে গিয়েছিলাম। হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা। বললাম, 'চিনতে পারছেন?' আবারও মৃদু হেসে বললেন, 'ব্যাচ ৬২ না?' ভাবলাম, যে মানুষটি গোটা বিশ্বের কয়েক শ বছরের ইতিহাস করোটির ভেতরে স্বাচ্ছন্দ্যে ধারণ করতে পারেন, তাঁর পক্ষে এই বিরাট বপুর মানুষটিকে ভুলে যাওয়া তো সহজে সম্ভব নয়।
ফাদার গাঙ্গুলী নটর ডেম কলেজের প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থায়ই ঢাকার অঙ্লিারি বিশপ এবং পরে আর্চবিশপ হয়েছিলেন।
লজিক সম্পর্কে আমার পরিচিত অনেকেই প্রথম থেকেই আমার মনে এক ধরনের ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অথচ লজিকের মতো এমন সহজ ও মজার বিষয় আর আছে বলে আমি মনে করি না। কী ডিডাকশন, কী ইনডাকশন_উভয় লজিকেই বিশপ গাঙ্গুলীর ছিল অসামান্য বুৎপত্তি। আমার এখনো মনে পড়ে, ভোলানাথ রায়ের বই খুলে তিনি যখন ইনডাকটিভ লজিকের ফ্যালাসি পড়াতেন, বারবারা, চেলারেন্ট, দারি, ফেরিও, চেসারে, কামেস্ত্রেস, ফেস্তিনো, বারোকে আমাদের বুঝতে অথবা স্মরণ রাখতে একটুও অসুবিধা হতো না।
এখনো লজিকের যুক্তিগ্রাহ্যতার কারণেই আমি হয়তোবা যুক্তিহীন কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে পারি না। প্রসঙ্গত, আমার মনে পড়ছে, আমার অভিনীত গ্যালিলিও চরিত্রের একটি সংলাপের কথা। নাটকের শেষে যখন গ্যালিলিও তাঁর প্রিয় ছাত্র আন্দ্রিয়া সার্তিকে স্নেহভরে জিজ্ঞেস করেন, 'আন্দ্রিয়া, বিজ্ঞান আসলে কী? বিজ্ঞান হলো সন্দেহের মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধান। আর এই সন্দেহ বিষয়টিই ধর্মগুরুদের প্রধান ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা সন্দেহের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যদি সত্যকে আবিষ্কার করতে পারে তাহলে তারা আর কোনোকালেই ধর্মগুরুদের মানবে না।'
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments