আত্মহননের পথ পরিহার করুন by ডা. ওয়াহিদ নবী

মনস্তত্ত্ববিদ মার্টিন সেলিগম্যান বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন একটি গবেষণা করে। তিনি একটি কুকুরকে লোহার খাঁচায় রেখেছিলেন, যার মেঝে ছিল লোহার তৈরি, আর মেঝের মাঝখানে ছিল একটি বেড়া। মেঝের যে অংশে কুকুরটি ছিল, সেখানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। কুকুরটি তখন বিদ্যুতের হাত থেকে বাঁচার জন্য বেড়া টপকে মেঝের উল্টো দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর মেঝের সেই দিকটিতেও বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়।


কুকুরটি তখন বেড়া টপকে মেঝের আগের দিকে চলে আসে বিদ্যুতের হাত থেকে বাঁচার জন্য। একটু পর সেখানেও বিদু্যুৎ দেওয়া হয়। যেদিকেই যায়, সেদিকেই বিদ্যুতের শক পায়। তখন সে লাফালাফি বন্ধ করে দিয়ে অসহায়ের মতো মেঝেতে বসে পড়ে, বিদ্যুতের শক খাওয়া সত্ত্বেও। সেলিগম্যান এই গবেষণার নাম দেন 'শেখা অসহায়ত্ব'। কারণ কুকুরটি শিখে ফেলেছিল, যেদিকেই সে যাক না কেন, বিদ্যুতের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম। নিজেদের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা দেখি, ১৯৯০ সালের পর থেকে, তাহলে একই ধরনের একটা চিত্র দেখতে পাই। প্রথমে বিএনপি সরকার_তাদের ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ সরকার_তাদের ব্যর্থতা। আবার বিএনপি সরকার_তাদের ব্যর্থতা। আবার আওয়ামী লীগ সরকার। এই সরকার অর্ধেকটা সময় পার করেছে শাসনকালের। আমরা এখন কী দেখতে পাচ্ছি? ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন সম্প্রতি লেখা একটি প্রবন্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন সরকারের কার্যাবলি দেখে হতাশ হয়ে। দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও একটি প্রবন্ধে তাঁর হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন ভগ্ন হৃদয়ে। কে না জানে, তাঁরা দুজনই বর্তমান সরকারের হিতাকাঙ্ক্ষী। তাঁরা সর্বান্তকরণে চান, সরকার সফল হোক। আর এই সাফল্য আগামী নির্বাচনে সরকারের জন্য বিজয় নিয়ে আসুক। সরকারকে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, কেন তাঁরা দুজন চিন্তিত। শুধু ভেবে দেখলেই যথেষ্ট হবে না, সময় নষ্ট না করে কর্মপদ্ধতি স্থির করে কাজে নেমে যেতে হবে। মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন ১৯৭৫ এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কথা; এবং আলোচনা করেছেন পরাজয়ের কারণগুলো। তিনি খোলাখুলিভাবেই বলেছেন, একদল গণবিরোধী মানুষ শেখ হাসিনাকে ঘিরে ফেলেছে, যারা, মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই শক্তি প্রধানমন্ত্রী, তাঁর দল বা জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনছে না। মুনতাসীর মামুন দীর্ঘদিন ধরে সেসব কাজের জন্য লড়ছেন, যেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী। শারীরিক নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে মামুন সাহেবকে। ঠিক তেমনিভাবে গাফ্ফার সাহেবের অক্লান্ত লেখনিও ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। সাবধান হওয়ার সময় এসেছে সরকারের। সরকারকে প্রশ্ন করব, তারা কি নিজের ভালো বোঝে না! তারা কি ইচ্ছা করেই নিজের ক্ষতি করছে! অবশ্যই সরকার নিজের ভালো বোঝে এবং ইচ্ছা করে নিজের ক্ষতি করছে না। শুধু তা-ই নয়, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, উপযুক্ততা_সব দিক দিয়েই সরকারের সদস্য-সদস্যারা বর্তমান প্রবন্ধ লেখকের চেয়ে শতগুণ বেশি উপযুক্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তাহলে আমরা এসব কথা বলছি। আমাদের বলার কারণ হচ্ছে, আমরা সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী। আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী এ জন্য যে, আমরা আধুনিকতার অগ্রযাত্রা কায়মনোবাক্যে কামনা করি। জাতি এগিয়ে যাক, দেশ এগিয়ে যাক, রাজনীতি এগিয়ে যাক_এই আমরা চাই। নানা ছলে সময়কে যারা পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তাদের আসল চেহারা মানুষ দেখুক_এই আমরা চাই।
ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি একটি কথা বলেছেন। কথাটি সরকারের জন্য যেমন, তেমনি জাতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। 'দরকার হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান।' আমরা জানি, সরকারের হাতে এখন অনেক কাজ। কিন্তু দলে খারাপ লোক নিয়ে কাজ করলে কাজ এগোবে না। কারা বিভীষণ, দলের সৎ নেতারা অবশ্যই তা জানেন। অতীতে অনেক সাফল্যহীনতায় আওয়ামী লীগ ভুগেছে শুদ্ধি অভিযান এড়িয়ে যাওয়ায়। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড আর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে দলের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। পরের নির্বাচনে জিততে হলে দলকে এখনই চাঙ্গা করে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কর্মসূচি, প্রয়োজন কর্মঠ মানুষ। দরকার হলে একজন সার্বক্ষণিক সাধারণ সম্পাদক নিয়োগের কথা চিন্তা করতে হবে। সরকারি দলে স্থবিরতা একটি সমস্যা। এই স্থবিরতা যাঁরা দূর করতে পারেন, তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হোক। মন্ত্রিত্বের চেয়ে দলের সংগঠনকে যাঁরা বড় মনে করেন, তাঁদের বেছে নেওয়া হোক।
বুদ্ধিজীবীরা, সেক্টর কমান্ডাররা, জোটের অন্য শরিকরা সংবিধানের কোনো কোনো বিষয়ে আপস চাইছেন না। সংখ্যালঘুরাও এসব ব্যাপারে আপস চাইছে না। এসব ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে মনে হয়, সিদ্ধান্তগুলো তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই নেওয়া হয়েছে। দুই সেনানায়ক গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে তারপর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে নিজেদের সুবিধার জন্য কিছু কাজ করেছিলেন। মানুষের দুর্বল অনুভূতিকে তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন। যাঁরা 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' যোগ করেছিলেন বা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের নিজেদের জীবনযাপনে ইসলামী পদ্ধতি খুব একটা প্রতিফলিত হয়নি। এসব কথা জনগণের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল। ভেবে দেখতে হবে, যাদের অসন্তুষ্টি এড়ানোর জন্য নিজেদের মানুষের কথা শোনা হচ্ছে না, তারা কি সন্তুষ্ট থাকবে। তারা কি বর্তমান সরকারকে ভোট দেবে? কিছুদিন আগে টেলিভিশনে এক টকশোতে শুনলাম, বিরোধী দলের এক সদস্যা প্রধানমন্ত্রীকে এই বলে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেন_২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি মাথায় যে আবরণ পরতেন, তা কোথায় গেল? সত্যি বলতে কি, ওই ধরনের পরিচ্ছদ তাঁকে সাহায্য করেনি। জনগণ নেতাদের প্রকৃত রূপ দেখতে চায়, প্রকৃত নীতি-আদর্শের কথা শুনতে চায়। আমার মনে হয়, বিএনপি যদি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি নিয়ে হরতালে নামত, তাহলে জনগণ তাদের স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করত। হঠাৎ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি হাতে পাওয়ায় তাদের লাভ হয়েছে। তারা হরতালের পথেই অগ্রসর হয়েছে। যদি সরকার জনকল্যাণমূলক কাজে অগ্রসর হয়, তাহলে জনগণ ভবিষ্যতে হরতাল প্রত্যাখ্যান করবে। সরকারের এখন উচিত হবে তাদের সুন্দর নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দিকে মনোসংযোগ করা। মানুষ এখন কাজ দেখতে চায়। ভাঙচুর তারা অনেক দেখেছে। তবে সবই নির্ভর করছে সরকার তাদের কী দিচ্ছে, তার ওপর। আমরা আশা করি, ইতিবাচক কাজ সম্পাদন করে মানুষের মন জয় করবে সরকার। বিরোধী দলের দুর্বলতা অবশ্যই জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর হত্যাকাণ্ড, হাওয়া ভবন, একুশ আগস্ট, শাহ কিবরিয়া ও আহসান উল্লাহ হত্যাকাণ্ড এবং বাংলা ভাইসহ অন্যান্য জঙ্গিবাদী কার্যকলাপ ইত্যাদির কথা অবশ্যই জনগণের গোচরে রাখতে হবে। তবে হাতে খুব বেশি সময় নেই। তাই বিমানবন্দর, বাড়ি বা অবসর গ্রহণ জাতীয় কাজগুলো, যেগুলো প্রচুর সময় ও শক্তি ক্ষয় করে, সেগুলো পরিহার করাই ভালো। ক্ষুদ্র সংঘর্ষের আর সময় নেই বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। সরকারের জন্য এখন প্রয়োজন উচ্চাশয় প্রদর্শন করা; এবং সেটাই জনগণ প্রত্যাশা করে।
মনস্তত্ত্বে একটি কথা আছে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় 'ওয়ার্কিং থ্রু', যার বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা 'বারবার ব্যাখ্যা দান' কথাটি ব্যবহার করতে পারি। সরকারকে আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু পুরনো কথাগুলোই আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই। কারণ, আমরা জাগতিক রাজনীতির অগ্রগতি দেখতে চাই । কবিগুরুর ভাষায় : 'আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে/যে কথা শুনায়েছি বারে বারে।'

লেখক : লন্ডনপ্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.