আরব জাগরণ-মিসরের এখন নেতা চাই by ইসান্দর এল আমরানি
এ রকমটা হওয়ার কথা ছিল না। গত শুক্রবার মিসরের ভবিষ্যতের সংবিধানের ওপর সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিরাট কিন্তু শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলছিল। জেনারেলরা চেষ্টা করছে, সামরিক বাজেটসহ সামরিক বিষয়াদি যাতে সংসদীয় নজরদারির বাইরে থাকে। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, সবাই নীরবে বুঝে গেছে, এত কিছুর পর সেনাবাহিনীই থাকবে পর্দার অন্তরালের আসল ক্ষমতায়। কিন্তু তাদের এটা প্রকাশ্যে বলতে হবে, তার জন্য জনগণের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে হবে।
শুক্রবারের প্রতিবাদীদের বেশির ভাগই সেদিন সন্ধ্যায় তাহরির চত্বর ছেড়ে চলে যায়, রাতে রয়ে যায় অল্প কিছু মানুষ। পরের দিন আরও অল্প বিক্ষোভকারী তাহরির চত্বর আবার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং সেখানে অবস্থান নিতে থাকে। তাদের সরিয়ে দিতে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। পুলিশ মাত্রা ছাড়া সহিংসতা চালায় এবং প্রতিবাদীদের মাথা লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে সেদিন কমপক্ষে দুজনের মৃত্যু হয় এবং বেশ কয়েকজনের এক চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরিণামে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং সকালে আবার চত্বর পুনর্দখলের চেষ্টা চলে। রোববার আরও অজস্র মানুষ চলে আসে। পরদিন ভোরের দিকে সেনা-পুলিশের যৌথ অভিযানের ফল একটাই, বিক্ষোভকারীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাওয়া। আবারও সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সর্বোচ্চ পরিষদ (এসসিএএফ) এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তগুলো তাদের জন্যই আরও সমস্যা সৃষ্টি করল।
অনেকের অনুমান ছিল, তাহরিরের রোববারের ঘটনাবলি হয়তো আগামী সপ্তাহের নির্বাচন বানচালের পরিকল্পনার অংশ। ইসলামপন্থীদের জন্য শুক্রবার শক্তি প্রদর্শনের মোক্ষম সময়। হয়তো ইসলামপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাপূর্ণ সংসদ অচিরেই এসসিএএফের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হবে এবং সেনাবাহিনীর নেওয়া অন্তর্বর্তী সময় শেষ হওয়ার আগেই একজন প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত করবে। কিংবা এমনও হতে পারে যে এসসিএএফ আসলে জানে না, কীভাবে এ রকম পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। তাই হয়তো তারা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সহযোগিতা চায়। হয়তো তারা আতঙ্কিত হয়েই ঠিক করেছে, বলপ্রয়োগই একমাত্র সমাধান। সে অনুযায়ী সামরিক শাসনের চরম রূপ দেখানো শুরু করেছে তারা।
এ সমস্যার কি কোনো রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব? প্রতিবাদীরাই বা কী চায়? কারও কাছে এটা হলো ২০১২-এর এপ্রিলের মধ্যেই বেসামরিক সরকার ও প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করা। অন্যরা এখনই সেটা চায়। গত ফেব্রুয়ারিতে যত ভাগ মিসরীয় সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা করেছিল, এখন তার কতটা অবশিষ্ট আছে তা বলা কঠিন। অনেকে চায়, যত দ্রুত সম্ভব সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়ুক। তাদের প্রধান দাবির মধ্যে নির্বাচনের তেমন গুরুত্ব নেই, এমনকি বিভিন্ন জায়গায় তারা দেয়াল থেকে পোস্টারও ছিঁড়ে ফেলছে এই বলে যে দলীয় রাজনীতির সময় এটা নয়।
এ রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের থেকে অনেক ভালো হতো যদি জাতীয় ঐক্যের সরকার সেনাবাহিনীর হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আগে সম্পন্ন করত। রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের কেউ কেউ এমন প্রস্তাব এরই মধ্যে তুলেছে এবং পরিস্থিতির মধ্যে তারও প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে সেনা কর্তৃপক্ষ ভাবতেও পারিনি, তাদের এ রকম বাধার মুখে পড়তে হবে এবং এখনো তারা সপ্তাহ খানেকের পরের নির্বাচনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এসসিএএফ ছাড়াও এ মুহূর্তের বড় আরেকটি বাধা হলো, মুসলিম ব্রাদারহুড। এদের দল ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টি নির্বাচন স্থগিতের যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। কারণ, তারা নির্বাচনে ভালো করবে। উদারনীতিবাদীরা এরই মধ্যে প্রচারণা বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু ইসলামপন্থীরা এখনো তা চালিয়ে যাচ্ছে।
একটা সমস্যা হলো, সামরিক নেতারা হয়তো নিন্দাযোগ্য, কিন্তু রাজনৈতিক নেতারাও তেমন উজ্জ্বল নন। বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ ও সদ্ভাবও নেই। এ অবস্থায় দুজন ব্যক্তি হয়তো উদারপন্থী ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিভক্তির ফয়সালার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতে পারেন। এঁদের একজন হলেন মোহাম্মেদ এল বারাদেই এবং আবদেল মুনিম আবুল ফতুহ। কয়েকটি দল ও আন্দোলন ছাড়া বাকি সবাই সেনা কর্তৃপক্ষকে অপছন্দ করে। অন্যরা সতর্কতার সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, ঘটনা কোন দিকে গড়ায় এবং কীভাবে তারা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিপরীতে সুবিধা নিতে পারে।
এখনো দূরবর্তী মনে হলেও একটা বিকল্প হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়। এর জন্য দরকার হবে রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে এক বা একাধিক শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের শ্রদ্ধাভাজন মানুষের এগিয়ে আসা। তাদের নিয়ে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যারা সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সব দায়দায়িত্ব বুঝে নেবে। এর মানে হচ্ছে একজন স্বাধীন, শ্রদ্ধাভাজন, দৃঢ়ব্যক্তিত্বের মানুষকে প্রধানমন্ত্রী করা এবং অনুরূপ একজনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানানো, যিনি আসবেন নাগরিক সমাজ থেকে। এবং গত নয় মাসে যে সংস্কার শুরু হয়নি, তাঁরা তা শুরু করবেন। এর মধ্যে নিহিত থাকবে এই কথা যে পররাষ্ট্রনীতি অথবা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো সাহসী বা মৌলিক সংস্কারকাজ তাঁরা করবেন না। তাঁদের অগ্রাধিকার থাকবে একটি সংবিধান সভা নির্বাচিত করা, এবং তারপর একটি সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা (কোনো অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট নয়)। বছরের শেষাশেষি একটি সংবিধান সভা নির্বাচিত করা যেতে পারে। নির্বাচিত না হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে এবং নাগরিক সমাজের সংগঠকদের মধ্যে থেকে এই সভার সদস্যদের নেওয়া যেতে পারে।
এ পর্যায়ে দরকার গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে চিন্তা করা। সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল, সবাইকেই নতুনভাবে ভাবতে হবে। নেতৃত্ব ছাড়া বিপ্লব দীর্ঘদিন চলতে পারবে না। এ বছরের ২৫ জানুয়ারিতে নেতৃত্বহীন প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯ নভেম্বর দেখাল যে মিসরের এখন উদ্দীপনাময় নেতা দরকার।
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
ইসান্দর এল আমরানি: মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক এবং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সাবেক সদস্য।
No comments