খুশবন্ত সিং-সব যেন ফিরে ফিরে আসে

শকুন্তলা খোসলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ৭০ বছরের বন্ধুতার সম্পর্কের অবসান ঘটল। শকুন্তলা ছিলেন মরহুম জাস্টিস জি ডি খোসলার পত্নী। এখন থেকে কয়েক বছর আগে জাস্টিস খোসলা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।শকুন্তলা যখন অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১০১ বছরের বেশি।


আমার সঙ্গে জি ডি খোসলার চেয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেই বেশি সখ্য ছিল। ১৯৪০ সালে আমি যখন লাহোরে ওকালতি প্র্যাকটিস করি তখন আমার সঙ্গে জাস্টিস খোসলার প্রথম পরিচয়। জি ডি খোসলা সম্পর্কে আমি প্রথম যে কথা জানতে পারি, তাহলো তিনি শিষ্টাচারের ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। শিষ্টাচারের ব্যাপারে তাঁর সাংঘাতিক নজর ছিল। তিনি ডাইনিং টেবিলে সব সময় ডিনার জ্যাকেট পরিধান করতেন। লোকে রসিকতা করে তাঁকে বাদামি ইংরেজি সাহেবদের নকল করা ভারতীয় ইংরেজ বলে সম্বোধন করত।
আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর জি ডি খোসলা ভারতীয় বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার করার সময় ডিনার জ্যাকেট পরিধান করা বাদ দিলেন। আমি এটাও অনুভব করতে পেরেছিলাম, বিচারকের বেশ ছাড়ার পর তাঁর সে পরিচয়টি ছেড়ে দিয়ে তিনি লেখক হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। এ সুযোগটি তাঁর প্রথম এসেছিল ১৯৪৭ সালে। দেশ বিভাগের পর ব্যাপক মাত্রায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে তিনি লেখার প্রয়াস পেয়েছিলেন।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ স্ট্যার্ন রেকনিং-এ তিনি উত্তর ভারতে হিন্দু এবং শিখদের দ্বারা মুসলমানদের প্রতি সহিংসতাকে সমর্থন দিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেছেন, পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তারই প্রতিক্রিয়া হয়েছে উত্তর ভারতে। ওই বইটি পড়ে আমি ভীষণ ব্যথিত হই এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এই বইয়ের একটি কপি কোনো মুসলমান বন্ধুকে কি দিতে চান? তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন না, তা তিনি করবেন না।
আমি বুঝতে পারিনি, তাঁর ভেতর এতটা ক্ষোভ তৈরি হয়ে আছে। তিনি একটি ছোট গল্প লিখে দ্য ট্রিবিউনকে পাঠানোর আগে আমাকে পাঠিয়ে দেন। তিনি আমার কাছে বলেননি, ওই গল্পে তিনি জাস্টিস সিকরি এবং তাঁর স্ত্রীর কথা লিখেছেন। সিকরি তাঁর বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেন। তিনি তখন ভারত থেকে চলে যান এবং দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর ধারণা ছিল, ধীরে ধীরে এ মামলার কথা সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত তিনি মাফ না চাইছেন, তত দিন পর্যন্ত সিকরি তাঁর পিছু ছাড়েননি।
আমার বিষয়টি ঘটেছিল আরো পরে। দিলি্লর জিমখানা ক্লাবের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য আমি তাঁর পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি তাঁর কাঁধে মৃদু টোকা দিয়ে জানতে চাইলাম দিলি্লর কাহিনী নিয়ে লেখা আমার বইটি কি পড়েছেন? বইটি মাত্র চার সপ্তাহ আগে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি এককথায় জবাব দিলেন, 'বাকওয়াস'। আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমি নিজের উপন্যাসের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য বললাম, ওই উপন্যাসটি সর্বাধিক বিক্রির তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। তিনি তাঁর কথা আবার উচ্চারণ করে বললেন, কিন্তু ওটি বাকওয়াস।
এরপর তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। অনেক দিন পর সংবাদপত্রে তাঁর মৃত্যুর খবর দেখলাম। শকুন্তলা আমাকে বললেন, তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, আমি যেন তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে একটি সভায় শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। আমি তাই করলাম। সেটি ছিল এক অশ্রুপূর্ণ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এরপর প্রতিদিন দুপুরের পর আমি শকুন্তলাকে ফোন করে কথা বলতাম। প্রতিটি গ্রন্থ প্রকাশের সময় আমি তাঁকে নিমন্ত্রণ দিতে থাকি। তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার আমার বাড়িতে চলে আসতেন। আমরা একসঙ্গে বসে লাহোরের স্মৃতিচারণা করতাম। কিন্তু এরপর আমার শ্রবণশক্তি আমাকে বেদনা দিতে শুরু করে। আমার সঙ্গে কথা বলতে হলে অতি উচ্চস্বরে বলতে হয়। এমনই সে জ্বালাতন যে শকুন্তলার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ কম হতে থাকল। গত ৩১ মে সকাল বেলা শকুন্তলার সবচেয়ে ছোট ছেলে আমাকে ফোন করে তাঁর মৃত্যুর খবর জানাল। আমি উদাস হয়ে গেলাম। আমার সব সঙ্গী-সাথি একে একে চলে গেল। আমার এখন মনে হয়, ওরা সবাই আমার সঙ্গে বেইমানি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি করেছে শকুন্তলা খোসলা।
মৃত্যু, তুমি কেন অপরাজেয়?
মৃত্যু, তুুমি এমন এক দৈত্য
যে কিনা গৌরব আর অহংকারে পরিপূর্ণ।
ট্র্যাজেডি হলো তোমার রাজ্যের পরিচায়ক।
দুঃখ যেখানে গভীর
তুমি সেখানেই তত বধির-কালা
(ভূপালের কবি সঞ্জয় যাদবের কবিতার কিয়দংশ)
ভারতের বহুল প্রচারিত দৈনিক ভাস্কর পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ।
মূল হিন্দি থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.