তিস্তা নদী-পানি বণ্টনের রূপরেখা by মো. খালেকুজ্জামান

পানির অপর নাম যেমন জীবন, তেমনই বাংলাদেশের অপর নাম নদী। হয়তো এই সত্যাটা বাঙালিরা বরাবরই জানত; আর তাই সংগতভাবেই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে বাঙালিদের একটি প্রিয় স্লোগান ছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ এলাকাই নদী-প্লাবন ভূমি। নদীবাহিত পলিমাটির স্তরায়নের মাধ্যমেই কোটি কোটি বছর ধরে বঙ্গীয় বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।


তাই বাংলাদেশের প্রতিটি নদীর স্বাস্থ্যের ওপরই দেশের প্রকৃতি ও অর্থনীতির স্বাস্থ্যও নির্ভরশীল। নদীর গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই প্রতিটি নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠে জীববৈচিত্র্য এবং সমাজ ও সভ্যতার সোপান। সে অর্থে প্রতিটি নদীর অববাহিকার পরিবেশ, প্রতিবেশ, কৃষি, মৎস্যসম্পদ, নৌচলাচল, শিল্প-কারখানা এবং সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই আবর্তিত হয় নদীর প্রবহমানতার ওপর ভিত্তি করেই। তিস্তা নদীর অববাহিকায় বিদ্যমান প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বেলায়ও এ কথাটি সর্বোতভাবে প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে ছোট-বড় কয়েক শ নদী প্রবহমান। প্রতিটি নদীর উৎসমুখ থেকে নিম্নমুখ পর্যন্ত অংশ এবং নদীর দুই পাশের প্লাবনভূমিকে ওই নদীর অববাহিকা বলা হয়, যা কিনা প্রাকৃতিক নিয়মে গঠিত একটা ভূমি-অঞ্চল। নদীর অববাহিকা প্রশাসনিক সীমারেখা মেনে চলে না; তাই বাংলাদেশের অনেক বড় নদীর অববাহিকার বড় অংশই দেশের সীমানার বাইরে অবস্থিত। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মতোই তিস্তা নদীর অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলই ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। একটি দেশের কিংবা মহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই কোনো না কোনো নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। আবার ছোট নদীর অববাহিকা অন্য কোনো বড় নদীর অববাহিকারই অংশ। সে অর্থে তিস্তা নদীর অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকারই অংশ, যা আবার মেঘনা অববাহিকায় গিয়ে মিশেছে। একটি নদীর অববাহিকার উজান অঞ্চলের প্রাকৃতিক এবং নৃগোষ্ঠীর কর্মক্রিয়ার প্রভাব নিম্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়। এ জন্যই পানিবিজ্ঞানে একটা কথা চালু আছে, ‘আমরা সবাই আমাদের নদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে বাস করি।’ সে অর্থে তিস্তা নদীর উজানে কী ঘটছে, তার প্রভাব সেই নদীর নিম্নাঞ্চলেও অনুভূত হচ্ছে এবং বৃহত্তর অর্থে বঙ্গীয় বদ্বীপের গঠন প্রণালিতেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের বড় ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে তিস্তা চতুর্থ বৃহত্তম নদী। এ নদীটি প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ—যার নিম্নাঞ্চলের ১৭২ কিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত। এ নদীর অববাহিকার আয়তন ১২ হাজার ১৮২ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে দুই হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার অর্থাৎ ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। যেকোনো নদীর পানিপ্রবাহের পরিমাণ নিম্নাঞ্চলে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলে। কারণ, নিম্নাঞ্চলে শুধু উজানের ভূ-উপরিস্থিত সব পানিপ্রবাহই বয়ে আসে না, ভাটিতে অবস্থিত অববাহিকা অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিও ভাটি অঞ্চলের নদীতে বাড়তি পানি সরবরাহ করে। তাই উজানের ৯৯ শতাংশ অববাহিকা অঞ্চলের পানিপ্রবাহের পরিমাণ ভাটি অঞ্চলের সর্বশেষ ১ শতাংশ অববাহিকা অঞ্চলের পানির পরিমাণের চেয়েও কম হয়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মে কোনো নদীকে প্রবাহিত হতে দিলে উজানের সমস্ত পানিই ভাটি অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই জীববৈচিত্র্যের স্থিতিস্থাপকতা তৈরি হয়। তিস্তা নদীর বেলায়ও এ নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। বাংলাদেশে অবস্থিত ১৭ শতাংশ অববাহিকা অঞ্চলেই সমগ্র তিস্তা অববাহিকায় বসবাসরত ২৯ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর ২১ মিলিয়ন মানুষ (অর্থাৎ ৭২ শতাংশ) বসবাস করে এবং সেই জনগোষ্ঠী তিস্তার পানির ওপর নির্ভর করেই তাদের জীবনপ্রক্রিয়া সাজিয়েছে। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা অববাহিকার যথাক্রমে সাত হাজার ২৬ বর্গকিলোমিটার এবং তিন হাজার ৮৫ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল অবস্থিত হলেও সেখানে যথাক্রমে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৩ জন (প্রায় ২ শতাংশ) এবং আট মিলিয়ন (৩৮ শতাংশ) মানুষ বসবাস করে।
সাম্প্রতিক কালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সে সফরকে কেন্দ্র করে যে কথাটা বারবার আলোচিত হয়েছে তা হলো, তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা কী হওয়া উচিত। মূলত এ প্রশ্নটি অমীমাংসিত থাকার কারণেই শেষ পর্যন্ত তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। কথিত আছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মুখে খসড়া যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি, তাতে ভারত ও বাংলাদেশ ৫০:৫০ হিস্যা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি মনে করেন, কোনোভাবেই বাংলাদেশকে ২৫ শতাংশের বেশি পানি দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, তাতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের স্বার্থরক্ষা হবে না। পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকায় এও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো কোনো বাড়তি পানিই আসলে শীতের মৌসুমে তিস্তা নদীতে থাকে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিস্তা নদীতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা কী হওয়া উচিত? এ প্রশ্নের পানিবিজ্ঞানসম্মত ও পরিবেশবিজ্ঞানসম্মত সহজ উত্তর হচ্ছে, অববাহিকার ভাটির অঞ্চল হিসেবে তিস্তা নদীতে প্রবাহিত সব মৌসুমের ১০০ শতাংশ পানিই বাংলাদেশের প্রাপ্য। প্রকৃতির নিয়ম সেটাই বলে। পানিসম্পদের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা মেনে নিলে, সব পানি ও পানিবাহিত পলিমাটির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হলে শুধু অর্থনীতিরই ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে বঙ্গীয় বদ্বীপ গঠন-প্রক্রিয়ারও, যা এখন বাড়তি হুমকির মুখে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে। বঙ্গীয় বদ্বীপ গঠন-প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বর্ষাকালের প্লাবন, জোয়ার-ভাটার নিয়মিত প্লাবন এবং পলি স্তরায়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভূমির উচ্চতা বাড়িয়ে তোলার কোনো বিকল্প বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। সে অর্থে শুধু তিস্তা নয়, সব অভিন্ন নদীর পানি এবং পলিপ্রবাহ প্রাকৃতিক হারে বজায় রাখা ছাড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সত্যিই হুমকির মুখে পড়বে। তাই বন্যার প্লাবন যতই বিপত্তিদায়ক মনে হোক না কেন, অতীতে ভূতাত্ত্বিক নিয়মে যেমন বন্যার প্লাবনেই বাংলাদেশের বিস্তর প্লাবনভূমি গড়ে উঠেছে—ভবিষ্যতেও একই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশের ভূখণ্ড ঠিক থাকতে পারবে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সব নদী ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরই প্রভাব পড়েছে এবং কোনো নদীই আর প্রাকৃতিক নিয়মে বাধাহীনভাবে প্রবহমান নেই। প্রতিবেশী দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সব কটি নদীর প্রবাহেই বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও নদীগুলোতে নানামুখী প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশে তিস্তা নদীতে ডালিয়া নামক স্থানে ১৯৯৩ সালে একটি ব্যারাজ এবং এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সেচ-খাল ও ক্যানেল তৈরি করে নীলফামারী, রংপুর এবং বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ১ লাখ ১৩ হাজার একর কৃষিজমিতে সেচের ব্যবস্থা করা হয়। এই সেচ প্রকল্পের সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৮ লাখ একর জমি। শুকনো মৌসুমে গড়ে ৯ হাজার কিউসেক পরিমাণ পানিপ্রবাহের প্রাপ্যতা ধরে নিয়ে এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ডালিয়ায় অবস্থিত ব্যারাজ প্রকল্পের ভাটিতে পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং কৃষির ওপর এই প্রকল্পের কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে কি না, তা নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। এই সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলের ৬৩ শতাংশ এলাকা সেচের আওতায় এনে সারা দেশের প্রায় ১৪ শতাংশ ফসল ফলানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এই সেচ প্রকল্পের সাফল্য বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ডালিয়ার উজানে পশ্চিমবঙ্গের গোজালডোবায় একটি ব্যারাজ তৈরি করে ১৯৯৬ সালে থেকে শুকনো মৌসুমের পানিপ্রবাহের প্রায় ৮৫ শতাংশ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুরের ১ লাখ ২৬ হাজার ১১০ একর জমি ইতিমধ্যেই সেচের আওতায় আনা হয়েছে এবং সর্বোমোট ৩ লাখ ২০ হাজার (মতান্তরে ২২,৭৭,৩৪০) একর জমি সেচের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা সেচ প্রকল্পের মধ্যে অন্য অববাহিকার জমিও রয়েছে, যা আন্তনদী সংযোগেরই নামান্তর। গোজালডোবায় ব্যারাজ নির্মাণের আগে যেখানে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশে গড়ে পাঁচ থেকে আট হাজার কিউসেক পানি আসত, সেখানে বর্তমানে দুই হাজার কিউসেকেরও কম পানি আসছে। উল্লেখ্য, কৃষিকাজের বাইরেও নদীর প্রাকৃতিক কার্যক্রম ও প্রতিবেশজনিত জীববৈচিত্র্য ধরে রাখার জন্য ন্যূনতম প্রবাহের প্রয়োজন হয়, যেটাকে পানিবিজ্ঞানের ভাষায় পরিবেশপ্রবাহ বলা হয়। গবেষকদের মতে, শুকনো মৌসুমে তিস্তা নদীর ন্যূনতম পরিবেশপ্রবাহের পরিমাণ তিন হাজার ২০০ থেকে ৯ হাজার ৫০০ কিউসেক হওয়া আবশ্যক। বলা বাহুল্য, বর্তমান প্রবাহের দুই হাজার কিউসেক পানি সেচ কিংবা পরিবেশপ্রবাহ—এর কোনোটির জন্যই প্রতুল নয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে যেহেতু ইতিমধ্যেই শুকনো মৌসুমের প্রায় ৮৫ শতাংশ পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং আরও বেশি জমি সেচের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে; তাদের পক্ষে ৫০:৫০ পানি বণ্টন চুক্তিতে আসা সম্ভব নয় বলেই কোনো চুক্তিই না করা তাদের জন্য লাভজনক। তিস্তা অববাহিকায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার আনুপাতিক হার ৭০:৩০। সেই হিসাবেও পরিবেশপ্রবাহের জন্য ন্যূনতম তিন হাজার ২০০ কিউসেক পানি রেখে বাকি পানির ৭০:৩০ হারে বণ্টন করা যুক্তিযুক্ত। গোজালডোবা ব্যারাজ নির্মাণের আগের ঐতিহাসিক পানিপ্রবাহকে ভিত্তি ধরে নিয়ে ৭০:৩০ হারে চুক্তি হলে উভয় পক্ষের জন্য ন্যায়বিচার করা হবে। পানিবিজ্ঞানের সূত্র, আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতেই তিস্তা এবং অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের সুরাহা হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
মো. খালেকুজ্জামান: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটি, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

No comments

Powered by Blogger.