পরিবহন-গাড়িবহর ও অসহনীয় যানজট by মোঃ মুজিবুর রহমান

আজকাল অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাস্তায় চলাচলের সময় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করতে পারলে যেন অনেকেই গর্ববোধ করেন। আর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যেন আরও বড় ধরনের বাহাদুরির কাজ। অথচ আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা আমাদের কারও জন্যই যে মঙ্গলজনক নয় এমন ভাবনাও যেন আজ লোপ পেতে বসেছে


বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট বলে মনে করা হয় যাকে, সেই বারাক ওবামার গাড়িবহরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর না হলেও গুরুত্বপূর্ণ। গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একদল সঙ্গীসহ লন্ডন সফর করে গেলেন। লন্ডন সফরকালে প্রেসিডেন্ট ওবামা তার গাড়িবহর নিয়ে সেন্ট্রাল লন্ডন ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। লন্ডনের সিটি সেন্টার অতিক্রমকালে ওই গাড়িবহরের একটি গাড়ি আচমকা থেমে যাওয়ায় সিটি সেন্টারে সৃষ্টি হয় অপ্রত্যাশিত যানজটের। আর সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে থেমে যাওয়া গাড়িগুলোর নম্বর প্লেট। ক্যামেরায় যেসব গাড়ির নম্বর প্লেট ধরা পড়েছে সেসব গাড়িকে জরিমানা করা হয়। তবে কেন প্রেসিডেন্টের গাড়িবহরের একটি গাড়ি হঠাৎ পথে থেমে গিয়েছিল তার কারণ জানা যায়নি। প্রেসিডেন্টকে বহনকারী তার ব্যক্তিগত লিমুজিন 'দি বিস্ট' গাড়িটি সিসিটিভি ক্যামেরার চোখের সীমানার বাইরে থাকায় ওই গাড়িটির নম্বর প্লেট ধরা পড়েনি ক্যামেরায়। ফলে প্রেসিডেন্টের গাড়িটি জরিমানা থেকে রেহাই পেলেও এখন তার গাড়িবহরকেই ১৯৩ মার্কিন ডলার জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
লন্ডনের ওই এলাকার নিয়মানুযায়ী যেসব গাড়ি যানজট তৈরির জন্য দায়ী বলে সিসিটিভি ক্যামেরায় শনাক্ত হবে সেসব গাড়িকে 'যানজট তৈরির ফি' পরিশোধ করতে হবে। যদি কোনো গাড়ি নির্ধারিত ফি পরিশোধ না করে তাহলে ওই গাড়িকে ফি পরিশোধ না করার অভিযোগে জরিমানা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার গাড়িবহরও যানজট সৃষ্টির ফি পরিশোধ না করায় এখন মুখোমুখি হয়েছে জরিমানার। জরিমানার অর্থ পরিশোধের জন্য লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করেছেন। তবে লন্ডনের মার্কিন দূতাবাস এই বলে জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে যে, ১৯৬০ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনীতিকরা সব ধরনের ট্যাক্সের আওতামুক্ত। কিন্তু মেয়র বরিসও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে মার্কিন দূতাবাসের দাবি খণ্ডন করেছেন এই বলে যে, "এটা কোনো 'ট্যাক্স' নয়। নিয়মভঙ্গ করার 'ফি' এবং সময়মতো সেই 'ফি' না দেওয়ার ফলেই 'জরিমানা'।" অতএব জরিমানা তো পরিশোধ করতেই হবে!
লন্ডন কর্তৃক মার্কিন প্রেসিডেন্টের গাড়িবহরকে জরিমানা করার পরিপ্রেক্ষিতে খুব সাধারণ চিন্তা-ভাবনা থেকে যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশের কোনো রাস্তায় অযথা যানজট সৃষ্টি করার জন্য কি কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির গাড়িকে এভাবে জরিমানা করা সম্ভব? এ প্রশ্নের একটি জবাব হতে পারে এমন যে, লন্ডনের মতো বাংলাদেশে তা সম্ভব নয় সহজে। আমাদের দেশের শহরগুলোতে তো বটেই এমনকি সড়ক-মহাসড়কে যেসব গাড়ি হরহামেশাই যানজট সৃষ্টি করে চলেছে সেসব সাধারণ গাড়ির বিরুদ্ধেও জরিমানা ধার্য করার দৃষ্টান্ত খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। যানজটকবলিত আমাদের রাজধানী মহানগরী ঢাকার কথা বাদই দিলাম। কারণ ঢাকা তো এখন প্রায় ২৪ ঘণ্টাই যানজটের মহাফাঁদে নাকাল। জেলা শহরগুলোর অবস্থাও তথৈবচ! আর ঢাকায় চলাচলকারী মানুষরা? তারা তো যানজটে আটকে পড়ে শুধু হাঁসফাঁস করেন সারাক্ষণ। অথচ ঢাকার যানজট নিরসনের জন্য কত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা, কত পরামর্শ, কত লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না কোনো কিছুতেই।
আসলে ঢাকায় যানজট সৃষ্টিকারী হাজার হাজার গাড়িকে জরিমানা করা পুলিশ বিভাগের পক্ষে সহজ কাজ নয়। কারণ শুধু ঢাকা নয়, বরং সারাদেশের রাস্তায় চলাচলকারী অধিকাংশ গাড়িই ট্রাফিক আইন মানতে চায় না। অথচ যদি সবাই শুধু ট্রাফিক আইন মেনে চলত তাহলে যানজট কমে আসত আশাতীতভাবে। তখন আইন লঙ্ঘনের জন্য জরিমানার প্রয়োজনীয়তাও কমে আসত সমান হারে।
তবে লন্ডনের মতো বাংলাদেশে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে কোনো গাড়ির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করলে হয়তো দেখা যাবে জরিমানা আরোপকারী পুলিশ কর্মকর্তাকেই উল্টো অনেক ঘাটের পানি খেতে হচ্ছে। কারণ ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করার কারণে সামান্য মোটরসাইকেল চালকের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সংশ্লিষ্ট পুলিশকেই অনেক সময় লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়_ এমন অনেক খবর পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়। কিছুকাল আগেও তিনজন আরোহী নিয়ে কোনো রিকশা রাস্তায় বের হলে ট্রাফিক পুলিশকে ওই রিকশার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যেত। কিন্তু দিন পাল্টেছে। এখন রিকশায় শুধু তিনজন নয়, কখনও কখনও চার-পাঁচজন যাত্রী নিয়েও প্রধান সড়কে রিকশা চলতে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। অধিকাংশ রিকশাও যেমন এখন আর ট্রাফিক আইন মানতে চায় না; ঠিক তেমনি মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, ট্রাক ও বাস এসবেরও যেন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। একই সঙ্গে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন ভুয়া চালকের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এ ছাড়া অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সে কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো, রাস্তায় চলাচলের ফিটনেস নেই এমন বহু পুরনো এবং লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়ি রাস্তায় বের করা, অদক্ষ ড্রাইভার কর্তৃক গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আজকাল অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাস্তায় চলাচলের সময় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করতে পারলে যেন অনেকেই গর্ববোধ করেন। আর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যেন আরও বড় ধরনের বাহাদুরির কাজ। অথচ আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা আমাদের কারও জন্যই যে মঙ্গলজনক নয় এমন ভাবনাও যেন আজ লোপ পেতে বসেছে। ফলে আমাদের সবাইকে পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। কিন্তু লন্ডনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের গাড়িবহরের বেলায় আমরা কী দেখলাম? ওই ঘটনা থেকে কি শেখার কিছুই নেই?
কোনো উন্নত দেশের সিটি কাউন্সিল অন্য একটি উন্নত দেশের প্রেসিডেন্টের গাড়িবহরকে জরিমানা করার ক্ষমতা রাখে শুধু নিজেরা আইন মেনে চলার জন্য, আইন অনুযায়ী সর্বত্র শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য, নিজেরা নিয়মতান্ত্রিক হওয়ার জন্য। আর আমরা নিজেদের বেলায়ই তা পারি না। এখানেই উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য।

মোঃ মুজিবুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পাবনা
mujibur30@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.