রাজনীতি-মুখরোচক দাওয়াই কাম্য নয় by শেখ জিনাত আলী

মানুষের দুর্ভোগ কী মাত্রায় বেড়ে চলছে সেটি তাদের মুখ্য বিষয় নয়। বাজারে পণ্যের অভাব দেখি না, কিন্তু দাম বেড়েই চলছে। আঘাতটা বেশি খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। এসব মানুষ সংবিধান বুঝে না, তবে সংবিধান ছাড়া চলেও না। তারা সংকট থেকে মুক্তি চায়। আগামীতে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়।


তাই বলছি বিশিষ্টজনদের, আপনারা সংবিধান সংশোধনের অনুশীলন ১১ মাস প্রত্যক্ষ করলেন, বক্তব্যও প্রায় একই ধারায় দিলেন। কিন্তু যা হওয়ার তা-ই হলো


চলমান সংকটের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে বিশিষ্টজনদের বক্তব্য-মন্তব্য প্রচার করা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। আমি বিশিষ্ট ব্যক্তি নই। সারাজীবন বাকৃবিতে শিক্ষকতা করেছি এবং মুক্তিযুদ্ধে সামান্য সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছি। বিশিষ্টজনদের প্রতি দু'চারটা কথা এখানে নিবেদন করতে চাই, যাতে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মঙ্গল হতে পারে। আমি লক্ষ্য করি তারা এমনভাবে বক্তব্য দেন যাতে তেল আর পানি কথা দিয়ে এক করে ফেলেন সমস্যার সমাধানকল্পে। প্রায় সবাই বলছেন, দুই নেত্রীর একত্রে বৈঠক ছাড়া সমস্যার সমাধান নেই, দেশ আবার কোনো এক অজানা সংকটে নিপতিত হবে। আমাদের মহাজন ব্যক্তিরা, বিশেষজ্ঞজনরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটি কয়েক শিক্ষক, সাবেক উপদেষ্টা অথবা বিদেশি অতিথিরা শুধু দুই নেত্রীর বৈঠকের মধ্যে সমস্যার সমাধান নিহিত বলে মতামত দিয়ে একটি দ্বিজাতিতত্ত্বের বিজাতীয় ভাবধারার দলের জন্মকে (সামরিক শাসনের আবেশে যার জন্ম সেনাছাউনিতে) পরোক্ষে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে চলবেন, তা কি বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের বিধিলিপি বলে আমাদের মানতে হবে?
গত ২৩ জুন আওয়ামী লীগ ৬২তম জন্মবার্ষিকী পালন করল। মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় গোপনে ৬ মার্চ ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৫৭ সালের ২৭ জুলাই মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে কাগমারী সম্মেলনের পর শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাক প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীলদের নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। এই কাগমারী সম্মেলনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আওয়ামী লীগে পরিণতি পায়। ইতিপূর্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্বের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে; কিন্তু যুক্তফ্রন্ট কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের রোষানলে পড়ে বেশিদিন পূর্ব বাংলায় কাজ করতে পারেনি বা ফ্রন্টকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। তার আগে ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট গঠনে একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আসে মুক্তিযুদ্ধ। এই মোড় ঘুরানোর কাজে ছাত্রসমাজের ১১ দফা ও আওয়ামী লীগের ৬ দফা এক ঐতিহাসিক অবদান রাখে। তারপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষাকে ২৫ মার্চ কালরাতে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দমন করতে সামরিক বাহিনী নিয়োগ করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়ে দেন, শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেই আসলে বিজয় সংহত করা ও বিধ্বস্ত দেশ গড়ার পালা শুরু হয় এবং সবার আগে একটি সংবিধান প্রণয়ন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মাত্র এক বছরের মাথায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের ফসল হিসেবে ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর সংক্ষিপ্ত (১৫৩ অনুচ্ছেদ) একটি সংবিধান পেয়ে যাই এবং সংবিধানের মূল রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি হয়ে যায় রাষ্ট্র পরিচালনার নিশানা এবং পথের দিশা। বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়েন রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির প্রতীক এবং বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জনক। এ জায়গায় ঐকমত্য সৃষ্টি করা না গেলে ১৯৭৫-পরবর্তী যে শাসনতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বিপরীতে দেশকে দাঁড় করিয়ে) সৃষ্টি করা হয়েছে সেই পরিমণ্ডল এখনও দেশে বিরাজ করছে। আর তাই আমরা দেখি খন্দকার মোশতাক থেকে জেনারেল জিয়া-এরশাদদের আবির্ভাব রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। এখন সামরিক ছাউনিতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দল ভোটের প্রাপ্যতার হিসাবে সেই অস্বাভাবিক আবেশে বড় দল হয়ে চিহ্নিত হচ্ছে এসব বিশিষ্টজন, বিশেষজ্ঞজন, রাজনীতিবিশারদ ব্যক্তিবর্গের কাছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করে এরূপ দল গঠন কি সম্ভব ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিশিষ্টজনরা দয়া করে বড় দু'দলের প্রসঙ্গ কথায় কথায় উঠাবেন না। আমরা এসব কথা শুনতে শুনতে ভারাক্রান্ত হয়েছি অনেক আগেই। আমি আওয়ামী লীগের সাফাই গাওয়ার জন্য এ কথাগুলো লিখছি না। সরকার বর্তমানকে বুদ্ধিমত্তা ও সততার সঙ্গে মোকাবেলা করবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবং মহাজোটের শরিকদের ঐক্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আওয়ামী লীগকেও মানুষের নাড়ি বুঝতে হবে গভীরে গিয়ে। সব সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মী দয়া করে সবকিছুর জন্য শেখ হাসিনার ওপর নির্ভর করে স্তাবকতা করবেন না। নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে দেশপ্রেমের নজির স্থাপন করুন। মানবতার দোহাই, আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষকে সংগঠিত হতে দিন। মানুষ চায় সংবিধানকে পূর্বাবস্থায় নিয়ে যান নির্ভয়ে। পরাবাস্তবতার পরিচয় দিয়ে নয়।
কিন্তু দেখা গেল, মহাজোটের সংসদ সদস্যরা নির্ভয়ে-নিঃসংকোচে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন করতে পারলেন না। গত ৩০ জুন আপনারা বিভক্তি ভোটে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পুনর্বহাল করলেন ঠিকই কিছু সাংঘর্ষিক বিষয়সহ (বিসমিল্লাহ, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল বহাল ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখেই)। কিন্তু যাদের কারণে বা ভয়ে এটা করলেন তারা ঠিকই অস্থিতিশীল দেশকে আরও অস্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার অন্যায় হরতাল পালন করলেন এবং অনেক বেফাঁস ও বদউচ্চারণ (রাষ্ট্রদ্রোহী) করেই চলছেন। আর আপনারাও তুলসী পাতায় ধোয়া হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সফলতা তেমন দেখাতে পারছেন না, বরং অনেক অযাচিত অন্যায় কর্ম করে চলছেন নানা পর্যায়ে ও গভীরতায়। এদিকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শেষ হতে না হতেই ইসলামী নামের কিছু দল (১২টা বলা হয়েছে) ৩০ ঘণ্টার হরতাল ডাকল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনে। মানুষের দুর্ভোগ কী মাত্রায় বেড়ে চলছে সেটি তাদের মুখ্য বিষয় নয়। বাজারে পণ্যের অভাব দেখি না, কিন্তু দাম বেড়েই চলছে। আঘাতটা বেশি খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। এসব মানুষ সংবিধান বুঝে না, তবে সংবিধান ছাড়া চলেও না। তারা সংকট থেকে মুক্তি চায়। আগামীতে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়। তাই বলছি বিশিষ্টজনদের, আপনারা সংবিধান সংশোধনের অনুশীলন ১১ মাস প্রত্যক্ষ করলেন, বক্তব্যও প্রায় একই ধারায় দিলেন। কিন্তু যা হওয়ার তা-ই হলো। এটাকে নানাজনে নানা বিশেষণে বলার চেষ্টা করেছেন, যেমন সোনার পাথর বাটি, পেট্রো-ডলারের কবজা, প্রতিক্রিয়াশীলদের খাতায় নাম লেখানো, বাস্তবতার অতিমূল্যায়ন ইত্যাদি। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বললেন, আওয়ামী লীগ নিজেই এই সংশোধনীতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। বিশ্বায়ন, বাজার অর্থনীতি যাই বলুন, সাধারণ মানুষের মুক্তি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনোই বিকল্প নেই। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সকলের_ এ নিয়ে বাড়াবাড়িই জঙ্গিবাদ। বিশিষ্টজনরা একবার একযোগে কথাগুলো কি বলবেন দেশবাসীকে? সংসদে গিয়ে যা বলার তা বলতে অসুবিধা কোথায়? হরতাল একটি গুজরাটি শব্দ এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। তাই বলি বিশেষজ্ঞজনরা একযোগে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে কাউকে কথার ফুলঝুরিতে আশকারা দেবেন না। এটাই এ নগণ্য ব্যক্তির আকুতি ও নিবেদন।

ড. শেখ জিনাত আলী : শিক্ষক
 

No comments

Powered by Blogger.