ভেনেজুয়েলা-চাভেজ: অসম্ভবকে সম্ভব করার রাষ্ট্রনেতা by ফজলুল হালিম
হুগো চাভেজ তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে স্প্যানিশ ভাষায় লেখেন, ‘এটা ফিরে আসার শুরু, সুপ্রভাত প্রিয় ভেনেজুয়েলা! সুপ্রভাত প্রিয় ভেনেজুয়েলাবাসী। আমি খুব আনন্দিত, আমি ঘরে ফিরে এসেছি। ধন্যবাদ হে ঈশ্বর।’ নীল-সাদা ট্র্যাকসুট পরিহিত অবস্থায় দীর্ঘদিন কিউবায় ক্যানসার চিকিৎসার পর গত বছরের ৮ জুন জন্মভূমিতে এসে উপস্থিত হন হুগো চাভেজ।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে নিয়মিত ওষুধ সেবন, বিশ্রাম, পরিমিত খাদ্যাভ্যাস এবং মেয়ে মারিয়া গাব্রিয়েলা ও রোজা ভার্জিনিয়ার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের আঙিনায় হাঁটাহাঁটির মধ্যেই সীমিত গোটা বিশ্বের রাজনীতির আঙিনায় ঝড় তোলা এই রাষ্ট্রনায়কের জীবন। সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা ১৯৯২ সালে ভেনেজুয়েলায় সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালান আর এই অপরাধে তাঁকে কারাগারে পাঠায় তৎকালীন ভেনেজুয়েলা সরকার। অবশেষে দুই বছর কারাবাসের পর তাঁকে ক্ষমা ও মুক্তি দেওয়া হয়। আর এভাবেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন হুগো চাভেজ। ১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন ভেনেজুয়েলাকে। ১৯৯৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যখন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৪ বছর। লাতিন আমেরিকায় ফিদেল কাস্ত্রো, আর্নেস্তো চে গুয়েভারা, সালভাদর আলেন্দে, পাবলো নেরুদা কিংবা ইভো মোরালেসের মতো হুগো চাভেজও বহুবার মার্কিন পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ, ২০০২ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রশাসনের মদদে ভেনেজুয়েলা সরকারকে উৎখাতের ব্যর্থ সামরিক ক্যু। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে ওই ঘটনার জন্য চাভেজ সরাসরি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে দায়ী করেন এবং তাঁকে ‘ডেভিল’ বলে সম্বোধন করেন। মজার ব্যাপার হলো, ২০০২ সালের এপ্রিলে সামরিক ক্যুর ব্যর্থ চেষ্টা এবং ডিসেম্বর থেকে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংঘটিত বিরোধী জোট এবং পুঁজিপতিদের একটানা আন্দোলন ও হরতাল অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও চাভেজের জনপ্রিয়তায় একটুও চির ধরাতে পারেনি। গণভোটই তার প্রমাণ।
চাভেজ ওই নির্বাচনে জেতেন ২০ লাখ ভোটের ব্যবধানে। মূলত এ বিজয় ভেনেজুয়েলার সংবিধানেরও। এ সংবিধান লাতিন আমেরিকার মহানায়ক বলিভারের আদর্শে গড়া। এটাই একমাত্র সংবিধান, যেখানে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করাতে গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রয়েছে। আর এই সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই চাভেজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম আট বছরে সাতবার জনগণের কাছে ম্যান্ডেট চেয়েছেন এবং জনগণও প্রতিবারই তাঁকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। প্রশ্ন জাগে, লাতিন আমেরিকার প্রাচীন এই ভূগোলে কেন বারবার তিনি বিজয়ী হচ্ছেন। মূলত ২০০২ সালের সামরিক ক্যুর ব্যর্থ চেষ্টার পর থেকেই তিনি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন ভেনেজুয়েলাকে। তাঁর সময়ে ভেনেজুয়েলা পঞ্চম তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। হুগো চাভেজ স্বাস্থ্য-পরিচর্যাব্যবস্থাকে মানবাধিকার হিসেবে উল্লেখ করে নাগরিকের জন্য তা নিশ্চিত করেন। তাঁর সময়ে প্রণীত আইনে সংবিধানের ৮৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য একটি মৌলিক সামাজিক অধিকার এবং তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।’ গৃহহীন, মাদকাসক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে এমন মানুষের জন্য চাভেজ সরকার ২০০৬ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে নেগ্রা হিপোলিটা মিশন নামের একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি। তা ছাড়া এ খাতে উন্নয়নের জন্য কিউবা থেকে আনা হয় ২০ হাজার চিকিৎসক। জনজীবনে সংকট মোকাবিলায় তাঁর সরকারের আরেকটি উদ্যোগের নাম মিশন মারকাল। এর আওতায় সরকার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অনেক বিপণিকেন্দ্র চালু করে। এসব বিপণিকেন্দ্রে পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন সুপার মার্কেটের চেয়ে অর্ধেক দামে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা হয়। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য তাঁর সরকার চালু করে মিশন রিবাস নামের এক শিক্ষা কর্মসূচি, যার আওতায় খেটে খাওয়া গরিব মানুষের সন্তানেরা বিনা মূল্যে বই, খাবার, থাকার ব্যবস্থা ও যাতায়াত খরচ পাচ্ছে।
ব্রিটেনের দৈনিক মর্নিং স্টার-এর তথ্যমতে, ভেনেজুয়েলা পৃথিবীর ‘যন্ত্রসংগীত কেন্দ্র’। আইনের মাধ্যমে প্রত্যেক শিশু-কিশোরের যন্ত্রসংগীত শেখার অধিকার নিশ্চিত করেছে চাভেজ সরকার। ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে চাভেজ সরকার লেনিন নয়, লিংকনের পথে হাঁটছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬২ সালে যে হোমস্টেড অ্যাক্ট করেছিলেন, চাভেজ সরকার সেটিকেই অনুসরণ করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা লেনিন বা কিউবার নীতি গ্রহণ করেননি। তাঁর সরকারের বস্তিবাসীর জন্য আরেকটি প্রকল্প হলো গৃহনির্মাণ। গত ২০ বছরে ভেনেজুয়েলায় যত ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে, গত দুই বছরে তার থেকে বেশি নির্মাণ করা হয় প্লান বলিভারের আওতায়। চাভেজ সরকারের আরেকটি উদ্যোগ সমবায় আইন। এ আইনের আওতায় ভেনেজুয়েলায় গড়ে উঠেছে অনেক ধরনের সমবায় এবং এখানে সংগঠিত হচ্ছে প্রান্তিক বলয়ে বসবাসরত কণ্ঠস্বরহীন মানুষ। এই সমবায়ের অনেক সদস্যই এখন সরকারি চাকরি করে মাসে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়ায় যায় তার প্রায় সমান পাচ্ছেন।
২০০২ সালের পর ভেনেজুয়েলা সরকার বেসরকারি আওতায় গড়ে তোলে বিকল্প তথ্যমাধ্যম। এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০০৫ সাল নাগাদ লাইসেন্সপ্রাপ্ত কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭০টি। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির সব ক্ষেত্রেই সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রথমে এসে চাভেজ সরকার যে জায়গায় অর্থনীতিকে পেয়েছিল, সে জায়গা থেকে চাভেজ সরকার পাড়ি দিয়ে এসেছে অনেক পথ। খনি কিংবা ইস্পাতশ্রমিকদের সরকারের প্রতি ক্ষোভ কিংবা ভূমি সংস্কারে আদিবাসীরা সন্তুষ্ট না হলেও এখন ভেনেজুয়েলার সময় থেমে গেছে ভিন্ন এক জায়গায়, আর তা আরও স্পষ্ট কিংবা ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক সালভাদর নভারীতি জানান প্রেসিডেন্টের আয়ু আর মাত্র দুই বছর! যদিও এ বছরের ১৩ জানুয়ারি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে বার্ষিক ভাষণে এসে টানা নয় ঘণ্টা কথা বলে এ বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলের পক্ষ হয়ে আবারও ভেনেজুয়েলাকে স্বপ্ন দেখালেন চাভেজ।
ফজলুল হালিম: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
চাভেজ ওই নির্বাচনে জেতেন ২০ লাখ ভোটের ব্যবধানে। মূলত এ বিজয় ভেনেজুয়েলার সংবিধানেরও। এ সংবিধান লাতিন আমেরিকার মহানায়ক বলিভারের আদর্শে গড়া। এটাই একমাত্র সংবিধান, যেখানে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করাতে গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রয়েছে। আর এই সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই চাভেজ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম আট বছরে সাতবার জনগণের কাছে ম্যান্ডেট চেয়েছেন এবং জনগণও প্রতিবারই তাঁকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। প্রশ্ন জাগে, লাতিন আমেরিকার প্রাচীন এই ভূগোলে কেন বারবার তিনি বিজয়ী হচ্ছেন। মূলত ২০০২ সালের সামরিক ক্যুর ব্যর্থ চেষ্টার পর থেকেই তিনি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন ভেনেজুয়েলাকে। তাঁর সময়ে ভেনেজুয়েলা পঞ্চম তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। হুগো চাভেজ স্বাস্থ্য-পরিচর্যাব্যবস্থাকে মানবাধিকার হিসেবে উল্লেখ করে নাগরিকের জন্য তা নিশ্চিত করেন। তাঁর সময়ে প্রণীত আইনে সংবিধানের ৮৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য একটি মৌলিক সামাজিক অধিকার এবং তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।’ গৃহহীন, মাদকাসক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে এমন মানুষের জন্য চাভেজ সরকার ২০০৬ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে নেগ্রা হিপোলিটা মিশন নামের একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি। তা ছাড়া এ খাতে উন্নয়নের জন্য কিউবা থেকে আনা হয় ২০ হাজার চিকিৎসক। জনজীবনে সংকট মোকাবিলায় তাঁর সরকারের আরেকটি উদ্যোগের নাম মিশন মারকাল। এর আওতায় সরকার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অনেক বিপণিকেন্দ্র চালু করে। এসব বিপণিকেন্দ্রে পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন সুপার মার্কেটের চেয়ে অর্ধেক দামে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা হয়। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য তাঁর সরকার চালু করে মিশন রিবাস নামের এক শিক্ষা কর্মসূচি, যার আওতায় খেটে খাওয়া গরিব মানুষের সন্তানেরা বিনা মূল্যে বই, খাবার, থাকার ব্যবস্থা ও যাতায়াত খরচ পাচ্ছে।
ব্রিটেনের দৈনিক মর্নিং স্টার-এর তথ্যমতে, ভেনেজুয়েলা পৃথিবীর ‘যন্ত্রসংগীত কেন্দ্র’। আইনের মাধ্যমে প্রত্যেক শিশু-কিশোরের যন্ত্রসংগীত শেখার অধিকার নিশ্চিত করেছে চাভেজ সরকার। ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে চাভেজ সরকার লেনিন নয়, লিংকনের পথে হাঁটছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬২ সালে যে হোমস্টেড অ্যাক্ট করেছিলেন, চাভেজ সরকার সেটিকেই অনুসরণ করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা লেনিন বা কিউবার নীতি গ্রহণ করেননি। তাঁর সরকারের বস্তিবাসীর জন্য আরেকটি প্রকল্প হলো গৃহনির্মাণ। গত ২০ বছরে ভেনেজুয়েলায় যত ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে, গত দুই বছরে তার থেকে বেশি নির্মাণ করা হয় প্লান বলিভারের আওতায়। চাভেজ সরকারের আরেকটি উদ্যোগ সমবায় আইন। এ আইনের আওতায় ভেনেজুয়েলায় গড়ে উঠেছে অনেক ধরনের সমবায় এবং এখানে সংগঠিত হচ্ছে প্রান্তিক বলয়ে বসবাসরত কণ্ঠস্বরহীন মানুষ। এই সমবায়ের অনেক সদস্যই এখন সরকারি চাকরি করে মাসে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়ায় যায় তার প্রায় সমান পাচ্ছেন।
২০০২ সালের পর ভেনেজুয়েলা সরকার বেসরকারি আওতায় গড়ে তোলে বিকল্প তথ্যমাধ্যম। এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০০৫ সাল নাগাদ লাইসেন্সপ্রাপ্ত কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭০টি। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির সব ক্ষেত্রেই সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রথমে এসে চাভেজ সরকার যে জায়গায় অর্থনীতিকে পেয়েছিল, সে জায়গা থেকে চাভেজ সরকার পাড়ি দিয়ে এসেছে অনেক পথ। খনি কিংবা ইস্পাতশ্রমিকদের সরকারের প্রতি ক্ষোভ কিংবা ভূমি সংস্কারে আদিবাসীরা সন্তুষ্ট না হলেও এখন ভেনেজুয়েলার সময় থেমে গেছে ভিন্ন এক জায়গায়, আর তা আরও স্পষ্ট কিংবা ঘনীভূত হয় যখন দেখা যায় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক সালভাদর নভারীতি জানান প্রেসিডেন্টের আয়ু আর মাত্র দুই বছর! যদিও এ বছরের ১৩ জানুয়ারি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে বার্ষিক ভাষণে এসে টানা নয় ঘণ্টা কথা বলে এ বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলের পক্ষ হয়ে আবারও ভেনেজুয়েলাকে স্বপ্ন দেখালেন চাভেজ।
ফজলুল হালিম: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments