জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা-বাংলার দাবি আরও সংহত হোক
জাতিসংঘ পৃথিবীর জাতিগুলোর জন্য সম্মিলিত একটি ফোরাম। বাংলায় নেশন্স শব্দের অর্থ জাতি ও রাষ্ট্র দুটিই। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউনাইটেড নেশন্সকে রাষ্ট্রসংঘও বলা হয়। একদিক থেকে এটি রাষ্ট্রগুলোর সংঘ। রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন ভাষা-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে বলেই এটি জাতিসংঘও বটে।
স্বাভাবিক প্রত্যাশা হলো, জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু মতের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। যাতে সকল জাতিই এ প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে বিবেচনা করতে পারে। শুরুতে ১৯৪৫ সালে গৃহীত জাতিসংঘের সনদে ইংরেজির বাইরে অন্য ভাষাগুলোর গুরুত্ব স্বীকৃত হয়নি। পরে ১৯৪৬ সালে দাফতরিক হিসেবে পাঁচটি ও ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে দুটি স্বীকৃত হয়। ১৯৪৮ সালে ইংরেজি ও ফরাসি এই দুই ব্যবহারিক ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয় স্প্যানিশ। এখন ব্যবহারিক ভাষা তিনটি হলেও জাতিসংঘের স্বীকৃত দাফতরিক ভাষা ছয়টি। আরবি, চীনা (মান্দারিন), ইংরেজি, ফরাসি, রুশ ও স্প্যানিশ। দাফতরিক ছয়টি ভাষার যে কোনো একটি ভাষায় বক্তব্য রাখলেও সদস্যদের কাছে বাকি পাঁচটি ভাষায় বক্তব্য-বিবৃতি অনুবাদের মাধ্যমে পেঁৗছানো হয়। ছয়টি দাফতরিক ভাষার বাইরে আরও কয়েকটি ভাষাকে দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব রয়েছে। এ তালিকায় সর্বশেষে রয়েছে বাংলা ভাষা। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে দাফতরিক ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। এ প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। বাংলা ছাড়াও যেসব ভাষার প্রস্তাব রয়েছে সেগুলো হলো : এসপেরান্তো, হিন্দুস্তানি, পর্তুগিজ, তুর্কি। এ ভাষাগুলোর মধ্যে পর্তুগিজ বিভিন্ন মহাদেশের প্রায় ৯টি দেশের ভাষা। আন্তর্জাতিকভাবে কমিউনিটি অব পর্তুগিজ ল্যাঙ্গুয়েজ কান্ট্রিজ পর্তুগিজ ভাষার পক্ষে কাজ করছে। দৃশ্যত বাংলার পক্ষে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের অফিসিয়াল সমর্থন নেই। বাংলাদেশের বাইরে ভারতেই বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা বেশি। ভারত সরকারিভাবে হিন্দিকে দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে। তবে হিন্দি বলয়ের বাইরের দক্ষিণ ভারতের মানুষের এ নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য হিসেবে বাংলার পক্ষে। এ যাবৎ জাতিসংঘে যেসব ভাষা দাফতরিক বলে স্বীকৃত হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো_ এগুলো একাধিক দেশের ভাষা এবং প্রচুর মানুষ এসব ভাষায় কথা বলে। এ ভাষাগুলোর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিস্তৃত। ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা অনুসারে বাংলার স্থান চীনা (মান্দারিন), স্প্যানিশ, ইংলিশ, হিন্দুস্তানি (হিন্দি ও উর্দু) ও আরবির পরেই। বাংলার পর পর্তুগিজ ও রুশ ভাষার স্থান। বাংলা ভাষার দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। আছে সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্যও। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষও। ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা একটির বেশি দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই বলে একাধিক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলার দাবি উচ্চারিত হওয়া কঠিন। এক্ষেত্রে একমাত্র ভারতকেই প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে আমাদের সহযাত্রী হওয়ার। সে লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতাও শুরু হতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশ সম্মিলিতভাবে দাবি উত্থাপন করলে সে প্রস্তাব অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে। বহু ভাষাভাষী ভারতের পক্ষে হিন্দি ছড়া যে কোনো একটি ভাষার পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন। বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান অনুসারে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা যদি সমস্বরে এগিয়ে আসেন, তাহলে বাংলার দাবি জোরদার হতে পারে। ইতিমধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। বাংলার পক্ষে বহু যুক্তি রয়েছে। এখন পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা একত্রিত হয়ে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম গড়ে তুলে, সে ফোরামে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষদের একত্রিত করে সম্মিলিত দাবি উত্থাপন করলে বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার দাবি পূরণ হতে পারে। বাংলা সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর সামনে নতুন মাত্রায় উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও এ ধরনের আন্তর্জাতিক ফোরাম বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে।
No comments