অসাম্প্রদায়িক মুক্ত চিন্তার মানুষ by মোজাম্মেল হক তুহিন
এ দেশের অসংখ্য নদীবিধৌত জনপদের কূলে কূলে বেড়ে ওঠা সংস্কৃতির মাঝে অঞ্চলভিত্তিক লৌকিক ঐতিহ্যের এক নাম জালাল উদ্দিন খাঁ। তিনি ১৯৭২ সালের ১ আগস্ট আজকের এই দিনে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সিংগেরগাঁও গ্রামে ইন্তেকাল করেন।
মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ আসদহাটি গ্রামে ১৮৯৪ সালের ২৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বিশ থেকে ষাটের দশক অবধি প্রাকৃত বাঙালিজনের এই গীতিকবি তার সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বের নামাঙ্কিতের মাঝে জালাল উদ্দিন সহস্রাধিক গান রচনা করেছিলেন। প্রখ্যাত এই লোককবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য।
জালাল উদ্দিন খাঁ প্রত্যক্ষ প্রেরণা পেয়েছিলেন এ অঞ্চলেরই আরেকজন প্রখ্যাত লোককবি ও গীতিকার রশিদ উদ্দিনের কাছ থেকে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকেই রশিদ উদ্দিন খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। জালালের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন তিনি। জালাল উদ্দিন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের 'জালাল-গীতিকা' গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় 'জালাল-গীতিকা' পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ছিল ৭২। মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে 'জালাল-গীতিকা সমগ্র।' জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন 'তত্ত্ব'তে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নাম_ আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। 'জালাল-গীতিকা'র অধিকাংশ গানই এ রকম তত্ত্বনামাঙ্কিত হলেও অনেক গানকে জালাল খাঁ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। যেমন 'জালাল-গীতিকা' প্রথম খণ্ডে সংকলিত ২০২টি গানের মধ্যে ২০টি গান 'ভাটিয়ালি' নামাঙ্কিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ২২৮টি গানের ৬০টিই 'ভাটিয়ালি'। তৃতীয় খণ্ডের ৭৮টি গানের সাতটি 'তত্ত্ব' বিষয়ে। আর ১৪টি 'মুর্শিদি' ও ১১টি 'মারফতি' নামাঙ্কিত গান। 'জালাল-গীতিকা'র চতুর্থ খণ্ডে কোনো তত্ত্ব নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপ তাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের হাতে 'জালাল-গীতিকা'র যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস বা নামাঙ্কন করা হয়নি। নব এই প্রকাশনায় জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতি সংকলন করা হয়।
জালাল যদিও বাউল কবি বা বাউল গীতিকাররূপে পরিচিত, তবু মনে রাখা প্রয়োজন, বাউল হচ্ছে বাংলার একটি বিশিষ্ট লৌকিক ধর্ম ও সাধন প্রণালির নাম এবং এই নামের বিশিষ্ট সাধন প্রণালিটির সঙ্গে পূর্ব ময়মনসিংহ ও তার আশপাশের অঞ্চলে প্রচলিত বাউল বা বাউলা গানের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তা না থাকলেও, বাউলসহ সব লৌকিক ধর্মের অন্তঃসার যে বিদ্রোহী চেতনা, সে চেতনাই জালাল-গীতি পুরোপুরি ধারণ করেছে।
শুধু গ্রাম-গঞ্জের অজ্ঞাত-অখ্যাত গায়কদের কণ্ঠেই নয়, আব্বাসউদ্দীন ও আবদুল আলিমের মতো প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীও জালালের গান রেকর্ড করেছেন। সে রকম কয়েকটি গান হলো_ 'ও আমার দরদি আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না', 'আরে ও ভাইট্যাল গাঙের নাইয়া', 'দয়াল মুর্শিদের বাজারে', 'এপাড়ে তোর বসতবাড়ি'। এসব গান অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এগুলোর রচয়িতা যে জালাল উদ্দিন খাঁ_ এই প্রয়োজনীয় তথ্যটি অনেকেরই অজ্ঞাত। শুধু আত্মতত্ত্ব কিংবা পরমতত্ত্ব নয়, জালালের গানে স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তিও ঘটেছে। 'জীবন আমার ধন্য যে হায় জনম মাগো তোমার কোলে/ স্বর্গ যদি থেকেই থাকে বাংলা মা তোর চরণ মূলে', 'হেথা আমি কুসুম সাথে জনম নিলাম অরুণ প্রাতে/শুয়ে ঘাসের গালিচাতে মরণ যেন হয় বিভোলে/ মরার পরে ভুল ভাঙ্গিয়া তোমার মনে মিশাইয়া রেখ আমায় যুগে যুগে/ জালালে কয় পরান খুলে।' গত শতাব্দীর শেষভাগে জালাল উদ্দিন খাঁর জীবন ও সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বেশকিছু গুণীজন। ১৯৯০ সালে বাংলা একডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজিজুল হক চৌধুরী রচিত জীবনীগ্রন্থ 'জালাল উদ্দিন খাঁ'। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক সুধীর চক্রবর্তী ১৯৯০ সালে 'বাংলা দেহতত্ত্বের গান' ও ২০০১ সালে 'জনপদাবলি' নামে দুটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম গ্রন্থটিতে জালালের ১০টি ও দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে ১৩টি গান সংকলিত হয়েছে। দুটি গ্রন্থের ভূমিকাতেই জালালের সঙ্গীত সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন। সুধীর চক্রবর্তীর 'জালাল-গীতি : কত রঙের নকশিকাঁথা' নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নাঈম হাসান সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন 'নিরন্তর'-এর ষষ্ঠ সংখ্যায় পৌষ, ১৪১২ সালে। এছাড়া যতীন সরকার সম্পাদিত 'জালাল-গীতিকা সমগ্র' একটি দুর্লভ প্রকাশনা। লোকমানুষের মরমি এই শিল্পী ১৯৭২ সালে তার সাধনার আত্মতত্ত্ব থেকে স্পর্শ করেন পরমতত্ত্বে। আজ আবারও সময় এসেছে জালাল উদ্দিন খাঁর কর্মের সঠিক স্বীকৃতি দান ও তার সঠিক দর্শন বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার।
tuhintn@yahoo.comজালাল উদ্দিন খাঁ প্রত্যক্ষ প্রেরণা পেয়েছিলেন এ অঞ্চলেরই আরেকজন প্রখ্যাত লোককবি ও গীতিকার রশিদ উদ্দিনের কাছ থেকে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকেই রশিদ উদ্দিন খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। জালালের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন তিনি। জালাল উদ্দিন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের 'জালাল-গীতিকা' গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় 'জালাল-গীতিকা' পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ছিল ৭২। মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে 'জালাল-গীতিকা সমগ্র।' জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন 'তত্ত্ব'তে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নাম_ আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। 'জালাল-গীতিকা'র অধিকাংশ গানই এ রকম তত্ত্বনামাঙ্কিত হলেও অনেক গানকে জালাল খাঁ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। যেমন 'জালাল-গীতিকা' প্রথম খণ্ডে সংকলিত ২০২টি গানের মধ্যে ২০টি গান 'ভাটিয়ালি' নামাঙ্কিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ২২৮টি গানের ৬০টিই 'ভাটিয়ালি'। তৃতীয় খণ্ডের ৭৮টি গানের সাতটি 'তত্ত্ব' বিষয়ে। আর ১৪টি 'মুর্শিদি' ও ১১টি 'মারফতি' নামাঙ্কিত গান। 'জালাল-গীতিকা'র চতুর্থ খণ্ডে কোনো তত্ত্ব নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপ তাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের হাতে 'জালাল-গীতিকা'র যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস বা নামাঙ্কন করা হয়নি। নব এই প্রকাশনায় জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতি সংকলন করা হয়।
জালাল যদিও বাউল কবি বা বাউল গীতিকাররূপে পরিচিত, তবু মনে রাখা প্রয়োজন, বাউল হচ্ছে বাংলার একটি বিশিষ্ট লৌকিক ধর্ম ও সাধন প্রণালির নাম এবং এই নামের বিশিষ্ট সাধন প্রণালিটির সঙ্গে পূর্ব ময়মনসিংহ ও তার আশপাশের অঞ্চলে প্রচলিত বাউল বা বাউলা গানের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তা না থাকলেও, বাউলসহ সব লৌকিক ধর্মের অন্তঃসার যে বিদ্রোহী চেতনা, সে চেতনাই জালাল-গীতি পুরোপুরি ধারণ করেছে।
শুধু গ্রাম-গঞ্জের অজ্ঞাত-অখ্যাত গায়কদের কণ্ঠেই নয়, আব্বাসউদ্দীন ও আবদুল আলিমের মতো প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীও জালালের গান রেকর্ড করেছেন। সে রকম কয়েকটি গান হলো_ 'ও আমার দরদি আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না', 'আরে ও ভাইট্যাল গাঙের নাইয়া', 'দয়াল মুর্শিদের বাজারে', 'এপাড়ে তোর বসতবাড়ি'। এসব গান অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এগুলোর রচয়িতা যে জালাল উদ্দিন খাঁ_ এই প্রয়োজনীয় তথ্যটি অনেকেরই অজ্ঞাত। শুধু আত্মতত্ত্ব কিংবা পরমতত্ত্ব নয়, জালালের গানে স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তিও ঘটেছে। 'জীবন আমার ধন্য যে হায় জনম মাগো তোমার কোলে/ স্বর্গ যদি থেকেই থাকে বাংলা মা তোর চরণ মূলে', 'হেথা আমি কুসুম সাথে জনম নিলাম অরুণ প্রাতে/শুয়ে ঘাসের গালিচাতে মরণ যেন হয় বিভোলে/ মরার পরে ভুল ভাঙ্গিয়া তোমার মনে মিশাইয়া রেখ আমায় যুগে যুগে/ জালালে কয় পরান খুলে।' গত শতাব্দীর শেষভাগে জালাল উদ্দিন খাঁর জীবন ও সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বেশকিছু গুণীজন। ১৯৯০ সালে বাংলা একডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে আজিজুল হক চৌধুরী রচিত জীবনীগ্রন্থ 'জালাল উদ্দিন খাঁ'। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত গবেষক সুধীর চক্রবর্তী ১৯৯০ সালে 'বাংলা দেহতত্ত্বের গান' ও ২০০১ সালে 'জনপদাবলি' নামে দুটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম গ্রন্থটিতে জালালের ১০টি ও দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে ১৩টি গান সংকলিত হয়েছে। দুটি গ্রন্থের ভূমিকাতেই জালালের সঙ্গীত সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন। সুধীর চক্রবর্তীর 'জালাল-গীতি : কত রঙের নকশিকাঁথা' নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নাঈম হাসান সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন 'নিরন্তর'-এর ষষ্ঠ সংখ্যায় পৌষ, ১৪১২ সালে। এছাড়া যতীন সরকার সম্পাদিত 'জালাল-গীতিকা সমগ্র' একটি দুর্লভ প্রকাশনা। লোকমানুষের মরমি এই শিল্পী ১৯৭২ সালে তার সাধনার আত্মতত্ত্ব থেকে স্পর্শ করেন পরমতত্ত্বে। আজ আবারও সময় এসেছে জালাল উদ্দিন খাঁর কর্মের সঠিক স্বীকৃতি দান ও তার সঠিক দর্শন বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার।
No comments