সহজিয়া কড়চা-তিন অমঙ্গল ও অকার্যকর রাষ্ট্র by সৈয়দ আবুল মকসুদ
দুর্নীতি, অদক্ষতা ও কর্তব্যে অবহেলা এবং অপচয়—এই তিন অমঙ্গল একটি রাষ্ট্রকে করে দেয় অকার্যকর, কোনো দেশের গণতন্ত্রের চর্চাকে শুধু ব্যাহত নয়, করে তোলে অসম্ভব। এই তিন অমঙ্গল যেখানে প্রাধান্য পায়, সে জাতির সব আশা-আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে যেতে পারে। তার বর্তমান যেমন হতাশাজনক, তেমনি তার ভবিষ্যৎও অন্ধকারাচ্ছন্ন।
একটি রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। একটি ন্যায়ভিত্তিক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একদিকে তা ছিল প্রতিরোধযুদ্ধ: পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার ও নারকীয়তাকে প্রতিহত করা। অন্যদিকে ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করে, একটি উন্নত সমাজ গঠন—যে সমাজ ও রাষ্ট্র হবে পাকিস্তানি শাসনের চেয়ে ভালো। যদি এমন হতো, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিয়াজি-ফরমানের পরিবর্তে কম অত্যাচারী অন্য কোনো পাকিস্তানিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, সেটা হতো ভিন্ন ব্যাপার। তা তো নয়। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ চেয়েছে স্বশাসন এবং সেই স্বশাসিত রাষ্ট্রটি হবে গণতান্ত্রিক, ন্যায়বিচারভিত্তিক ও অপেক্ষাকৃত বৈষম্যহীন।
সর্বশেষ যিনি ছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে তাঁর সাধ্য ও পরিকল্পনামতো সেবা দিয়ে স্বদেশে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশকে একটি সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতায় পৌরোহিত্য করে তিনি চলে যান। তাঁর পদে বাংলাদেশে নতুন মার্কিন প্রধান অতিথি হিসেবে আসছেন মি. ড্যান ডব্লিউ মোজেনা। ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটিতে এক শুনানিতে তিনি বলেন, ‘দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, দুই মেরুতে বিভক্ত রাজনৈতিক দল, দুর্নীতি এবং নাগরিক সমাজের প্রতি সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা।’ তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ একটি ‘মধ্যপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ’।
মান্যবর মোজেনা যখন তাঁর পর্যবেক্ষণ সিনেট কমিটিতে প্রকাশ করেন, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশের সমস্যা যে দুর্নীতি—এই অভিযোগ যে রাবিশ ও বোগাস, সে কথা প্রবীণ অর্থমন্ত্রী সেখানে সাংবাদিকদের বলেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে মি. মোজেনা আগন্তুক নন। শুধু সরকারি কাগজপত্র থেকে নয়, তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে কর্মকর্তা ছিলেন।
বিশ্বব্যাংকের বড় কর্ত্রী কিছুদিন আগে বাংলাদেশে পদধূলি দিয়েছিলেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ সরেজমিনে দেখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো রকম করাপশন টলারেট বা দুর্নীতিকে বরদাশত করা হবে না। কথাটি বলেন তিনি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে। তাঁর বলার ভঙ্গিটি টিভিতে দেখে আমার ভালো লাগেনি। পরদিন আবার টিভিতে দেখি, তিনি তাঁর তর্জনী নাচিয়ে বলছেন, ‘নো করাপশন, নো করাপশন, নো করাপশন’। আমাদের সরকারের কেউ কোনো প্রতিবাদ করেননি। ওই দিনই রাতে এটিএন বাংলা আমাকে টক শোতে ডাকে। সেখানে আমি বিশ্বব্যাংক-কর্ত্রীর মুখনিঃসৃত বাণীর বিষয়বস্তু ও বলার ঢং—দুটোরই তীব্র প্রতিবাদ করি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে পত্রপত্রিকায় অব্যাহত লেখালেখি হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রামাণ্য প্রতিবেদন হচ্ছে। কিছুদিন ধরে আমরা নাগরিক সমাজ থেকেও জোরালো প্রতিবাদ করছি। তাতে সরকার বিরক্ত। নেতারা আমাদের আক্রমণ করে সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সরকারের নেতাদের সুর দেখে মনে হয়, তাঁরা এ কথা স্বীকার করতে অনিচ্ছুক যে রাষ্ট্রে দুর্নীতি আছে। এবং দুর্নীতির প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। দুর্নীতি যে একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম, তার জন্য কোনো এক বা কয়েকজন ব্যক্তি দায়ী নন, তা উপলব্ধির প্রয়োজন বোধ করেন না আমাদের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য করে বলেছেন, শুধু দুর্নীতি দুর্নীতি বললেই হবে না, কোথায়, কোন খাতে, কতটা দুর্নীতি হচ্ছে শুধু অভিযোগ করলেই হবে না, তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত করতে হবে।
বাংলাদেশের কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে, তার তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার কথা শুনলে বড়ই অসহায় ও বিপন্ন বোধ করি। কেউ যদি আমাকে বলেন যে বাংলাদেশে অক্সিজেন নামে যে কোনো পদার্থ আছে, তার প্রমাণ দাও। আমি দিতে পারব না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গায় দুর্নীতির চিহ্ন রয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি কি ও কত প্রকার, তা এই দেশের সেই ব্যক্তিই জানে যে টিঅ্যান্ডটির একটি টেলিফোনের গ্রাহক, সারা জীবনের সঞ্চয়, বউয়ের অলংকার ও ঘটি-বাটি বিক্রি করে ঢাকার কোনো প্রান্তে কাঠা দেড়েক জমি কিনে কোনোমতে একটি ঘর তুলেছে, সেই ঘরে বিদ্যুৎ নিয়েছে, লাকড়ির চুলার বদলে তিতাস গ্যাসের লাইন নিয়েছে, যার একটি ভাঙাচোরা গাড়ি আছে, যেকোনো দিন একটি পাসপোর্ট করেছে, যে তার নিষ্কণ্টক জমি বিক্রি করতে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একবার গেছে অথবা সম্পূর্ণ কষ্টার্জিত টাকায় কিনতে গেছে এক খণ্ড জমি। গত ৫০ বছরে আমি নিজে অন্তত ১৫ বার কাউকে না কাউকে ঘুষ দিয়েছি। ঘুষ নেওয়ার মতো দেওয়াও অন্যায়, তা জেনেও দিয়েছি। মাত্র এক বাসা থেকে আরেক বাসায় টেলিফোন শিফট করব, দূরত্ব মাত্র ২০০ গজ, কিছু ‘বকশিশ’ ছাড়া আড়াই মাসেও কাজ হয়নি।
এই উপমহাদেশে দুর্নীতি নতুন বিষয় নয়। ব্রিটিশ আমলে এর শুরু। তবে তখন খুব কম জায়গায় ঘুষ-দুর্নীতি ছিল। পুলিশের নিচের দিকে দারোগাদের কেউ ঘুষ খেতেন, কোনো এসপি ঘুষ খেয়েছেন, তেমন নজির অতি নগণ্য। সেকালে পদমর্যাদাই কাউকে বাধা দিত দুর্নীতি করতে। পঞ্চাশের দশকে আমার এক বন্ধুর বাবা রেলের টিটি ছিলেন। আমরা জানতাম, তিনি টিকিটবিহীন যাত্রীদের থেকে কিছু ‘খান’। কোনো কোনো দিন দু-তিন টাকা তাঁর ভাগ্যে জুটত। তাতেই তাঁর বদনাম হয়েছিল যে ঘুষখোর। তিনি এমনই দুর্নীতিবাজ ছিলেন যে মৃত্যুকালে কোনো সঞ্চয় রেখে যাননি। আমার বন্ধু আইএ পাস করেই চাকরিতে ঢোকে।
আজ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ছোট পুলিশ কর্মকর্তা নন, আইজির গ্রামের বাড়িতে প্রাসাদ ওঠে, তাঁর স্থাবর সম্পত্তিতে ভরে যায় শহর ও গ্রামের এলাকা। কেউ জিজ্ঞাসা করে না: এ টাকা তুমি কোথায় পেলে? বরং তাকে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। বহু বাড়িঘর, জমি, দামি গাড়ি ও দোকানপাটের মালিক। রাষ্ট্র প্রশ্ন করে না: এসবের উৎস কী? এর নাম সিস্টেম।
স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দুর্নীতির উৎস ও তার কারণ অনুসন্ধানে একটি গবেষণাধর্মী কমিশন গঠন করেছিলেন। সেই কমিশনের রিপোর্টের অংশবিশেষ দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তার শুরুতেই ছিল হোয়াট ইজ করাপশন বা দুর্নীতি জিনিসটি কী? তারপর হোয়াট ইজ দ্য কজেজ অব দ্য করাপশন? অর্থাৎ দুর্নীতির কারণ কী? খুব বড় বড় নীতিমান পণ্ডিত ব্যক্তি ওই কমিশনে ছিলেন। দুর্নীতির সংজ্ঞা তাঁরা যা দিয়েছিলেন, আজ তাকে খুব সংকীর্ণ মনে হয়। দুর্নীতির পরিধি ও গভীরতা আজ আরও ব্যাপক পণ্ডিত নেহরুর দেশে ও বাংলাদেশে। তবে নেহরুর দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তফাতটা এখানে যে তাঁর দেশের নেতারা দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন, বাংলাদেশের নেতারা তা অস্বীকার করেন বা চেপে যান।
কোনো মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে যিনি আছেন, তিনি নিজে সৎ হলেই যে তাঁর মন্ত্রণালয় দুর্নীতিমুক্ত হবে, তা নয়। এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে গিয়ে আমার স্ত্রী ৩০ টাকা ঘুষ দিয়ে এসেছেন। তিনি একা নন, তাঁর মতো অগণিত। জাতীয় সঞ্চয়পত্র কোন মন্ত্রণালয়ে? আয়কর বিভাগ কোন মন্ত্রণালয়ে? স্থানীয় সরকারে দুর্নীতি, গম আত্মসাৎ প্রভৃতি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সময় শুরু হয়েছে, এখন তার পরিমাণ কতটা, তা গাঁওগেরামের যে কেউ জানে। সার, ডিজেল নিয়ে কী হয়, তা কাগজে কিছু আসে, তার জন্য কৃষিমন্ত্রীকে দায়ী করা যাবে না—দায়ী সিস্টেম। কিন্তু দায়িত্ব বর্তায় মন্ত্রীর ওপর।
বাংলাদেশের বনভূমির প্রতিটি গাছ জানে, দুর্নীতি কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে হয়। বৃক্ষের যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত, সে চিৎকার করে সব বলে দিত: তার গোড়ায় মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্যে করাত চালায় কে অথবা ব্যাগে কোটি কোটি টাকা নিয়ে প্রধান বনরক্ষক হওয়ার জন্য কে কোথায় ছোটেন। শিক্ষা বিভাগে কী হয়, শিক্ষামন্ত্রী তা খুব ভালো জানেন। ওই বিভাগের কথা শোনার জন্য প্রাথমিক স্কুলের কোনো হতভাগ্য শিক্ষক, যাঁর পাঞ্জাবি ঘাড়ের কাছে ছিঁড়ে গেছে, অথবা কোনো কলেজের অধ্যাপকের জবানবন্দি নেওয়ার দরকার নেই। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকের ভবনটির দিকে তাকালেই যে-কারও নিঃশ্বাস দুর্নীতির গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে।
খুব বেশি আগের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটির দরকার নেই। রোববারের দুটি দৈনিকের দুটি সংবাদের দিকে তাকাতে চাই। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম আর দুর্নীতির তদন্তে ভাটা’ শিরোনামে যুগান্তর লিখেছে: ‘দেশের ২৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জোট সরকারের আমলে সংঘটিত নামা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।... মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজদের বহুমুখী তৎপরতার কারণেই ওই তদন্তকার্য সম্পন্ন হয়নি।’ জোট সরকারের সময় এক সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অতিথি সৎকারের বিল পরিশোধ করেই ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফতুর হয়ে যায়। এক মোরগের বিল তিনি ৭০০ টাকা পর্যন্ত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় তাঁর ভোজনবিলাসিতার কথা ও আনুুষঙ্গিক দুর্নীতির সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টাকার অভাব, তা জানা গেল প্রথম আলোর ‘তিন বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজি নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটের বেশির ভাগ অর্থ দেয় সরকার। কিন্তু আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা আছে।’ অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ উপচে পড়ছে।
অযোগ্য ও অসৎ লোকেরা আত্মরক্ষার বা আত্ম-উন্নতির জন্য বিচিত্র উপায় উদ্ভাবন করে। তার মধ্যে একটি স্তাবকতা। একালের ছেলেমেয়েরা একটি চমৎকার শব্দ বের করেছে: চামচামি। ভালো ভালো কাজ করে সরকারপ্রধানকে খুশি করার চেয়ে স্তাবকতা করে চাকরি টিকিয়ে রাখা জরুরি। ফলে কার সাধ্য তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ তোলে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কৃত হওয়ার অর্থ গোটা দেশবাসীর পুরস্কৃত হওয়া। আলাদা করে কোনো বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আনন্দের ব্যাপার নয়। ‘বিশ্ব মহিলা’ ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে ‘সাউথ সাউথ’ পুরস্কার পাওয়ায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের উপাচার্য প্রফেসর ড. হক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ‘অকৃত্রিম অভিনন্দন’ জানিয়েছেন। বিজ্ঞাপনে মুদ্রিত হয়েছে দুটি ছবি: ডান দিকে প্রধানমন্ত্রীর, বাম দিকে উপাচার্যের। ছবি ও নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় ধারণা হয় বিজ্ঞাপনের দেড়-দুই লাখ টাকা তাঁর নিজের। যদি তা না হয়ে থাকে, তা হলে তা হবে অনৈতিক ও অরুচিকর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যথাক্রমে প্রফেসর ড. আখন্দ ও প্রফেসর ড. আলমও ‘আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন’ জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাখ লাখ টাকা বিজ্ঞাপনে ব্যয় হলো।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোনো এক গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রকাণ্ড ছবিসহ লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সমকাল-এর সোমবারের এক প্রতিবেদনে জানা গেল, পঞ্চগড়ের স্বাস্থ্য সহকারী নওয়াবউদ্দিন অবসর নেন ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর, মারা যান ’৭৯ সালে, তাঁর বিধবা স্ত্রী স্বামীর পেনশনের টাকা আজও পাননি। এ কি রাষ্ট্রীয় অপরাধ নয়?
যে তিন অমঙ্গলের কারণে একটি রাষ্ট্র অকার্যকর হয়, তার সবগুলোই বাংলাদেশে বর্তমান। এখন থেকে নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই। ইথিওপিয়া, জায়ার, গিনি, ঘানা, জাম্বিয়া, সোমালিয়া ও কেনিয়ার সম্মিলিত লোকসংখ্যার দেড় গুণ লোকসংখ্যা বাংলাদেশের। এই দেশে শুধু দুর্নীতিবাজ নয়, কৃষক-শ্রমিক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে এখনো সৎ ও ভালো মানুষ কোটি কোটি। বিশেষ করে রয়েছে অভিভাবকহীন। অথচ অপার সম্ভাবনাময় যুবসম্প্রদায়। তারা রাষ্ট্রকে অকার্যকর ও ব্যর্থ হতে দিতে পারে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সর্বশেষ যিনি ছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে তাঁর সাধ্য ও পরিকল্পনামতো সেবা দিয়ে স্বদেশে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশকে একটি সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতায় পৌরোহিত্য করে তিনি চলে যান। তাঁর পদে বাংলাদেশে নতুন মার্কিন প্রধান অতিথি হিসেবে আসছেন মি. ড্যান ডব্লিউ মোজেনা। ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটিতে এক শুনানিতে তিনি বলেন, ‘দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, দুই মেরুতে বিভক্ত রাজনৈতিক দল, দুর্নীতি এবং নাগরিক সমাজের প্রতি সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা।’ তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ একটি ‘মধ্যপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ’।
মান্যবর মোজেনা যখন তাঁর পর্যবেক্ষণ সিনেট কমিটিতে প্রকাশ করেন, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশের সমস্যা যে দুর্নীতি—এই অভিযোগ যে রাবিশ ও বোগাস, সে কথা প্রবীণ অর্থমন্ত্রী সেখানে সাংবাদিকদের বলেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে মি. মোজেনা আগন্তুক নন। শুধু সরকারি কাগজপত্র থেকে নয়, তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে কর্মকর্তা ছিলেন।
বিশ্বব্যাংকের বড় কর্ত্রী কিছুদিন আগে বাংলাদেশে পদধূলি দিয়েছিলেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ সরেজমিনে দেখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো রকম করাপশন টলারেট বা দুর্নীতিকে বরদাশত করা হবে না। কথাটি বলেন তিনি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে। তাঁর বলার ভঙ্গিটি টিভিতে দেখে আমার ভালো লাগেনি। পরদিন আবার টিভিতে দেখি, তিনি তাঁর তর্জনী নাচিয়ে বলছেন, ‘নো করাপশন, নো করাপশন, নো করাপশন’। আমাদের সরকারের কেউ কোনো প্রতিবাদ করেননি। ওই দিনই রাতে এটিএন বাংলা আমাকে টক শোতে ডাকে। সেখানে আমি বিশ্বব্যাংক-কর্ত্রীর মুখনিঃসৃত বাণীর বিষয়বস্তু ও বলার ঢং—দুটোরই তীব্র প্রতিবাদ করি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে পত্রপত্রিকায় অব্যাহত লেখালেখি হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রামাণ্য প্রতিবেদন হচ্ছে। কিছুদিন ধরে আমরা নাগরিক সমাজ থেকেও জোরালো প্রতিবাদ করছি। তাতে সরকার বিরক্ত। নেতারা আমাদের আক্রমণ করে সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সরকারের নেতাদের সুর দেখে মনে হয়, তাঁরা এ কথা স্বীকার করতে অনিচ্ছুক যে রাষ্ট্রে দুর্নীতি আছে। এবং দুর্নীতির প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। দুর্নীতি যে একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম, তার জন্য কোনো এক বা কয়েকজন ব্যক্তি দায়ী নন, তা উপলব্ধির প্রয়োজন বোধ করেন না আমাদের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য করে বলেছেন, শুধু দুর্নীতি দুর্নীতি বললেই হবে না, কোথায়, কোন খাতে, কতটা দুর্নীতি হচ্ছে শুধু অভিযোগ করলেই হবে না, তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত করতে হবে।
বাংলাদেশের কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে, তার তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার কথা শুনলে বড়ই অসহায় ও বিপন্ন বোধ করি। কেউ যদি আমাকে বলেন যে বাংলাদেশে অক্সিজেন নামে যে কোনো পদার্থ আছে, তার প্রমাণ দাও। আমি দিতে পারব না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গায় দুর্নীতির চিহ্ন রয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি কি ও কত প্রকার, তা এই দেশের সেই ব্যক্তিই জানে যে টিঅ্যান্ডটির একটি টেলিফোনের গ্রাহক, সারা জীবনের সঞ্চয়, বউয়ের অলংকার ও ঘটি-বাটি বিক্রি করে ঢাকার কোনো প্রান্তে কাঠা দেড়েক জমি কিনে কোনোমতে একটি ঘর তুলেছে, সেই ঘরে বিদ্যুৎ নিয়েছে, লাকড়ির চুলার বদলে তিতাস গ্যাসের লাইন নিয়েছে, যার একটি ভাঙাচোরা গাড়ি আছে, যেকোনো দিন একটি পাসপোর্ট করেছে, যে তার নিষ্কণ্টক জমি বিক্রি করতে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একবার গেছে অথবা সম্পূর্ণ কষ্টার্জিত টাকায় কিনতে গেছে এক খণ্ড জমি। গত ৫০ বছরে আমি নিজে অন্তত ১৫ বার কাউকে না কাউকে ঘুষ দিয়েছি। ঘুষ নেওয়ার মতো দেওয়াও অন্যায়, তা জেনেও দিয়েছি। মাত্র এক বাসা থেকে আরেক বাসায় টেলিফোন শিফট করব, দূরত্ব মাত্র ২০০ গজ, কিছু ‘বকশিশ’ ছাড়া আড়াই মাসেও কাজ হয়নি।
এই উপমহাদেশে দুর্নীতি নতুন বিষয় নয়। ব্রিটিশ আমলে এর শুরু। তবে তখন খুব কম জায়গায় ঘুষ-দুর্নীতি ছিল। পুলিশের নিচের দিকে দারোগাদের কেউ ঘুষ খেতেন, কোনো এসপি ঘুষ খেয়েছেন, তেমন নজির অতি নগণ্য। সেকালে পদমর্যাদাই কাউকে বাধা দিত দুর্নীতি করতে। পঞ্চাশের দশকে আমার এক বন্ধুর বাবা রেলের টিটি ছিলেন। আমরা জানতাম, তিনি টিকিটবিহীন যাত্রীদের থেকে কিছু ‘খান’। কোনো কোনো দিন দু-তিন টাকা তাঁর ভাগ্যে জুটত। তাতেই তাঁর বদনাম হয়েছিল যে ঘুষখোর। তিনি এমনই দুর্নীতিবাজ ছিলেন যে মৃত্যুকালে কোনো সঞ্চয় রেখে যাননি। আমার বন্ধু আইএ পাস করেই চাকরিতে ঢোকে।
আজ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ছোট পুলিশ কর্মকর্তা নন, আইজির গ্রামের বাড়িতে প্রাসাদ ওঠে, তাঁর স্থাবর সম্পত্তিতে ভরে যায় শহর ও গ্রামের এলাকা। কেউ জিজ্ঞাসা করে না: এ টাকা তুমি কোথায় পেলে? বরং তাকে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। বহু বাড়িঘর, জমি, দামি গাড়ি ও দোকানপাটের মালিক। রাষ্ট্র প্রশ্ন করে না: এসবের উৎস কী? এর নাম সিস্টেম।
স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দুর্নীতির উৎস ও তার কারণ অনুসন্ধানে একটি গবেষণাধর্মী কমিশন গঠন করেছিলেন। সেই কমিশনের রিপোর্টের অংশবিশেষ দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তার শুরুতেই ছিল হোয়াট ইজ করাপশন বা দুর্নীতি জিনিসটি কী? তারপর হোয়াট ইজ দ্য কজেজ অব দ্য করাপশন? অর্থাৎ দুর্নীতির কারণ কী? খুব বড় বড় নীতিমান পণ্ডিত ব্যক্তি ওই কমিশনে ছিলেন। দুর্নীতির সংজ্ঞা তাঁরা যা দিয়েছিলেন, আজ তাকে খুব সংকীর্ণ মনে হয়। দুর্নীতির পরিধি ও গভীরতা আজ আরও ব্যাপক পণ্ডিত নেহরুর দেশে ও বাংলাদেশে। তবে নেহরুর দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তফাতটা এখানে যে তাঁর দেশের নেতারা দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন, বাংলাদেশের নেতারা তা অস্বীকার করেন বা চেপে যান।
কোনো মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে যিনি আছেন, তিনি নিজে সৎ হলেই যে তাঁর মন্ত্রণালয় দুর্নীতিমুক্ত হবে, তা নয়। এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে গিয়ে আমার স্ত্রী ৩০ টাকা ঘুষ দিয়ে এসেছেন। তিনি একা নন, তাঁর মতো অগণিত। জাতীয় সঞ্চয়পত্র কোন মন্ত্রণালয়ে? আয়কর বিভাগ কোন মন্ত্রণালয়ে? স্থানীয় সরকারে দুর্নীতি, গম আত্মসাৎ প্রভৃতি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সময় শুরু হয়েছে, এখন তার পরিমাণ কতটা, তা গাঁওগেরামের যে কেউ জানে। সার, ডিজেল নিয়ে কী হয়, তা কাগজে কিছু আসে, তার জন্য কৃষিমন্ত্রীকে দায়ী করা যাবে না—দায়ী সিস্টেম। কিন্তু দায়িত্ব বর্তায় মন্ত্রীর ওপর।
বাংলাদেশের বনভূমির প্রতিটি গাছ জানে, দুর্নীতি কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে হয়। বৃক্ষের যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত, সে চিৎকার করে সব বলে দিত: তার গোড়ায় মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্যে করাত চালায় কে অথবা ব্যাগে কোটি কোটি টাকা নিয়ে প্রধান বনরক্ষক হওয়ার জন্য কে কোথায় ছোটেন। শিক্ষা বিভাগে কী হয়, শিক্ষামন্ত্রী তা খুব ভালো জানেন। ওই বিভাগের কথা শোনার জন্য প্রাথমিক স্কুলের কোনো হতভাগ্য শিক্ষক, যাঁর পাঞ্জাবি ঘাড়ের কাছে ছিঁড়ে গেছে, অথবা কোনো কলেজের অধ্যাপকের জবানবন্দি নেওয়ার দরকার নেই। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকের ভবনটির দিকে তাকালেই যে-কারও নিঃশ্বাস দুর্নীতির গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে।
খুব বেশি আগের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটির দরকার নেই। রোববারের দুটি দৈনিকের দুটি সংবাদের দিকে তাকাতে চাই। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম আর দুর্নীতির তদন্তে ভাটা’ শিরোনামে যুগান্তর লিখেছে: ‘দেশের ২৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জোট সরকারের আমলে সংঘটিত নামা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।... মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজদের বহুমুখী তৎপরতার কারণেই ওই তদন্তকার্য সম্পন্ন হয়নি।’ জোট সরকারের সময় এক সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অতিথি সৎকারের বিল পরিশোধ করেই ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফতুর হয়ে যায়। এক মোরগের বিল তিনি ৭০০ টাকা পর্যন্ত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় তাঁর ভোজনবিলাসিতার কথা ও আনুুষঙ্গিক দুর্নীতির সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টাকার অভাব, তা জানা গেল প্রথম আলোর ‘তিন বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজি নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটের বেশির ভাগ অর্থ দেয় সরকার। কিন্তু আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা আছে।’ অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ উপচে পড়ছে।
অযোগ্য ও অসৎ লোকেরা আত্মরক্ষার বা আত্ম-উন্নতির জন্য বিচিত্র উপায় উদ্ভাবন করে। তার মধ্যে একটি স্তাবকতা। একালের ছেলেমেয়েরা একটি চমৎকার শব্দ বের করেছে: চামচামি। ভালো ভালো কাজ করে সরকারপ্রধানকে খুশি করার চেয়ে স্তাবকতা করে চাকরি টিকিয়ে রাখা জরুরি। ফলে কার সাধ্য তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ তোলে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কৃত হওয়ার অর্থ গোটা দেশবাসীর পুরস্কৃত হওয়া। আলাদা করে কোনো বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আনন্দের ব্যাপার নয়। ‘বিশ্ব মহিলা’ ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে ‘সাউথ সাউথ’ পুরস্কার পাওয়ায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের উপাচার্য প্রফেসর ড. হক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ‘অকৃত্রিম অভিনন্দন’ জানিয়েছেন। বিজ্ঞাপনে মুদ্রিত হয়েছে দুটি ছবি: ডান দিকে প্রধানমন্ত্রীর, বাম দিকে উপাচার্যের। ছবি ও নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় ধারণা হয় বিজ্ঞাপনের দেড়-দুই লাখ টাকা তাঁর নিজের। যদি তা না হয়ে থাকে, তা হলে তা হবে অনৈতিক ও অরুচিকর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যথাক্রমে প্রফেসর ড. আখন্দ ও প্রফেসর ড. আলমও ‘আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন’ জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাখ লাখ টাকা বিজ্ঞাপনে ব্যয় হলো।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোনো এক গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রকাণ্ড ছবিসহ লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সমকাল-এর সোমবারের এক প্রতিবেদনে জানা গেল, পঞ্চগড়ের স্বাস্থ্য সহকারী নওয়াবউদ্দিন অবসর নেন ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর, মারা যান ’৭৯ সালে, তাঁর বিধবা স্ত্রী স্বামীর পেনশনের টাকা আজও পাননি। এ কি রাষ্ট্রীয় অপরাধ নয়?
যে তিন অমঙ্গলের কারণে একটি রাষ্ট্র অকার্যকর হয়, তার সবগুলোই বাংলাদেশে বর্তমান। এখন থেকে নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই। ইথিওপিয়া, জায়ার, গিনি, ঘানা, জাম্বিয়া, সোমালিয়া ও কেনিয়ার সম্মিলিত লোকসংখ্যার দেড় গুণ লোকসংখ্যা বাংলাদেশের। এই দেশে শুধু দুর্নীতিবাজ নয়, কৃষক-শ্রমিক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে এখনো সৎ ও ভালো মানুষ কোটি কোটি। বিশেষ করে রয়েছে অভিভাবকহীন। অথচ অপার সম্ভাবনাময় যুবসম্প্রদায়। তারা রাষ্ট্রকে অকার্যকর ও ব্যর্থ হতে দিতে পারে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments