রাজনীতি-হরতালকে নির্বিষ করার দায় কার? by মোহীত উল আলম
সম্প্রতি সরকারের এক মধ্যরাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম পাঁচ টাকা বেড়ে গেল। বাড়ল সমহারে গ্যাসের দামও। জনজীবন এমনিতে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে ধুঁকছে। জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ায় জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে এর চাপ পড়ল।
রোগের ক্ষেত্রে বহুমূত্র যেমন সব রোগের মা, তেমনি জ্বালানি তেল হচ্ছে সবকিছুর উৎস। এর মূল্য বৃদ্ধি পেলে খাবার টেবিলে ভাত-তরকারির বাটিতেও খবর হয়; খবর হয় প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করার বেলায়ও। সরকারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা দেখে মানুষ ফুঁসছে।
মানুষের এই ফোঁসানি দেখে বিরোধী দল ভাবল, এক দিনের হরতাল দেওয়া যায়। কিন্তু বৃহস্পতিবারের (২২ সেপ্টেম্বর) ১১ ঘণ্টার হরতালটা হরতাল-দেনেওয়ালাদের জন্য ভালো হয়নি মনে হয়। টিভির সচিত্র প্রতিবেদন দেখে এবং পত্রপত্রিকার বিভিন্ন ছবি দেখে ও সংবাদ পড়ে মনে হলো, হরতালটা সুবিধাজনক হয়নি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্বিবাদে তো অ-হরতাল পালিত হয়েছে, আর বিভিন্ন জেলা শহরে পুলিশের সঙ্গে কিছু পিকেটারের খণ্ড-বিখণ্ড পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে মাত্র। রাস্তাঘাটে বরং হরতালের বিপক্ষ নেওয়া লোকজনের সমাবেশ ও মিছিল জোরদার ছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সদস্য। প্রথম আলোর একটা ছবি ছিল যে হরতালের সময় ব্যস্ত না থাকার কারণে পুলিশের কয়েকজন নারী সদস্য ডাবের পানি পানে মনোনিবেশ করেছিলেন।
অর্থনীতির একটা সূত্র আছে, অতি প্রাপ্তির মাধ্যমে কাম্যতার ক্রমহ্রাস হবে। কোনো জিনিসের সরবরাহ বেশি হলে, প্রাপ্যতার পরিমাণ অনুযায়ী তার চাহিদা কমতে থাকবে। এখন মাথা থেকে একটা টুপি পড়লেই হরতালের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। তাই হরতাল বেশি দেওয়ায় জনগণ এর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ কোন ইস্যুতে সাড়া দেবে, সেটা বুঝতে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রয়োজন আছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি আরেকটি সরকার ক্ষমতায় না থাকলে যে হতো না, লোকে সেটা নিয়ে নিশ্চিত নয়। আর এটার বিশ্ব প্রেক্ষাপটটা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছেও পরিষ্কার। বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তি, সংস্থা ও রাষ্ট্রের কাছে নানা জটিল সমীকরণের মাধ্যমে জড়িত এবং এর ফলে যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান দুর্বল, এটা লোকে জানে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আশ্চর্য শীতল সফরের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক বঙ্গীয় নারীর ঘাড় ত্যাড়া করার কারণে তিস্তা নদীতে ট্রানজিট ডুবল, ভারতীয় অপূর্ব গণতান্ত্রিক কাঠামোর কারণে সেই নারী রক্ষাও পেলেন; কিন্তু এ ঘটনা যদি মোগল আমলে ঘটত, তাহলে বাংলার সবচেয়ে সুপরিচিত সুবেদার নবাব শায়েস্তা খানের ধড়বিহীন মুণ্ডু দিল্লির মসনদে আসীন বাদশাহর কাছে পৌঁছানোর জোর তাগিদ থাকত সিপাহশালারের ওপর। অথচ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাগাতে পারবে না বাংলাদেশ, তাঁকে সমঝে চলে কৌশলে তিস্তার পানি বের করে নেওয়ার কৌশলটি বাংলাদেশের দীপু মনিকে গ্রহণ করতে হবে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এ পরাভূত অবস্থার মধ্যে বিরাট একটা হরতাল হতে পারত, যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো দুর্বলতাবশত ট্রানজিট দিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি সেটি দেননি এবং এর ফলে দেশের মানুষ যে তাঁর নেতৃত্বের দৃঢ়চেতা দিকটি সম্পর্কে নতুনভাবে অবগত হলো, সাধারণ মানুষের মধ্যে যে তাঁর সম্পর্কে আশাবাদ ব্যাপ্ত হয়েছে—এ সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর না রেখে হুট করে হরতাল দেওয়ায় লোকজন তেমন সাড়া দেয়নি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যে বলেছেন, এটা ছিল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে নয়, বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারব্যবস্থা বাধা দেওয়ার হরতাল। এটারও জুতসই জবাব বিরোধী দল থেকে আসতে পারেনি। কারণ, ঠিক এর দুই দিন আগে পুলিশকে হামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী মাঠে নেমেছিল। আর সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য আমলে নেওয়ার কারণ হয়েছে, বর্তমান প্রজন্ম ও আগের প্রজন্মের সচেতন অংশটি লোকের কথায় ও ইতিহাস পড়ে জানছে যে যুদ্ধাপরাধ আসলেই সংঘটিত হয়েছিল এবং অনেক লোকই এই অপরাধ সংঘটিত করেছিল, যাঁদের কেউ কেউ এখনো জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আছেন। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ যদি ক্রমে ইতিহাস-সচেতন হয়ে উঠতে থাকে, তারা যদি ঘটনার কার্যকারণ ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ঠিকমতো জানতে পারে, তাহলে মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এমনিতেই অবস্থান নেবে, তাদের শাস্তি চাইবে। এটি প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়বে।
হরতাল বিরোধী দলকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক-অধিকারপুষ্ট একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি। কিন্তু এর প্রয়োগ হতে হবে শেষতম চাল হিসেবে। চিকিৎসাসেবার ভাষায় বললে, কোরামিন বা জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে। যেমন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের মার্চের ৩ থেকে ৬ তারিখ, টানা চার দিন। ওই হরতাল এতটা কার্যকর ছিল যে তখন গাছের একটা পাতাও নড়েনি হরতালের হুকুমের বাইরে। এমনকি ৬ মার্চ যখন পাকিস্তানের সামরিক সরকার পাঞ্জাবের সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের স্থলাভিষিক্ত করেন, তখন গভর্নর হিসেবে ৯ মার্চ তাঁর শপথবাক্য পাঠ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী। তখন চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। (অবশ্য এই একই বি এ সিদ্দিকী ৯ এপ্রিল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করান।)
বঙ্গবন্ধুর ডাকা ওই হরতালকে যদি হরতালের ধ্রুপদি উদাহরণ ধরি, তাহলে বাংলাদেশে এরপর যত হরতাল হয়েছে, তা সবই হচ্ছে এর চেয়ে নিম্নমানের, অধোগতির, খাপছাড়া ও দিকনির্দেশনাবিহীন—কেবল নব্বইয়ের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালিত হরতালগুলো ছাড়া। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বউ-ঠাকুরানীর হাট উপন্যাসের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘লোকের যখন ধর্মজ্ঞান সহসা বিশেষ প্রবল হইয়া উঠে, তখন কোন যুক্তিই তাহার কাছে খাটে না।’ ঠিক সে রকম বিরোধী দলের মধ্যে হরতালজ্ঞান যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন কোনো যুক্তিই তাদের কাছে খাটে না।
আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের আঙ্গিকে এ সমস্যাটা আলোচনা করা যায়। কাঠামোবাদী তাত্ত্বিক ফার্ডিনান্ড ডি স্যাসুর যুগ্ম বৈপরীত্যের (বাইনারি অপজিশন) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, দিন বললে আমরা ধরে নিই যে রাতও আছে। রবীন্দ্রনাথও একই কথা কাব্যিকভাবে বলে গেছেন যে দিনের আলোর মাঝে লুকিয়ে আছে রাতের সব তারা। এ ভাবটিকে একটু বিপরীতভাবে বিন্যাস করে আমরা বলতে পারি যে হরতাল নিরেট গণতান্ত্রিক ব্যাপার হলেও এর মধ্যে একটি যুক্তির দাঁত লুকিয়ে আছে। গরুর মাথার খুলি থেকে মগজ খোলার সময় কসাই একটি ছোট মাংসের গুটি ফেলে দেয়। ওরা এটাকে বলে ‘পোকা’, যেটি খেলে শরীরের ক্ষতি হয়। ঠিক সে রকম হরতাল গণতান্ত্রিক এবং বৈধ প্রতিবাদী পন্থা হলেও এর ভেতরের কাঠামোর মধ্যে একটি বিষপোকা আছে, যেটি সম্পর্কে হরতাল-দেনেওয়ালাদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে।
বিষপোকাটা কীভাবে উদগ্র হয়ে ওঠে, সেটা বলি। প্রথম হলো, বাংলাদেশে এখন সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে। সংসদকে কার্যকর রাখতে সরকারি ও বিরোধী দলগুলো তৎপর থাকবে, এটি জাতির আরাধ্য। কিন্তু বিরোধী দলের সাংসদেরা সাধারণত সংসদে যান না। যান তখন, যখন তাঁদের সংসদ সদস্যপদ অনুপস্থিতির কারণে বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়। অথচ তাঁরা মাসে মাসে বেতন টানেন এবং সব ধরনের সুবিধা ও ভাতা ভোগ করেন। কিছুদিন আগে প্রকাশিত বিজ্ঞাপিত তালিকায় দেখা গেছে, সুদমুক্ত বিলাসী গাড়ির সুযোগ ব্যবহার করার ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধী দলের সাংসদেরাও ছিলেন বড় জায়গাজুড়ে। গরিব দেশের মানুষের চোখে সমাজ-শাসকদের এসব যুগ্ম বৈপরীত্য যে পড়ে না, তা নয়। তাদের মধ্যে হতাশা ও নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। তখন তাদের মধ্যে শিক্ষক ক্লাস না নিয়ে আন্দোলন করলে যে ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, সাংসদ বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি গ্রহণ করেও সংসদে কার্যকর ভূমিকা না রাখলে একই প্রতিক্রিয়া হয়। আবার এই সাংসদদের রাজনৈতিক দলগুলোই যখন হরতাল ডাকে, তখন তাদের মনের মধ্যে নৈতিক প্রশ্নটা আসে, ‘কেন?’
আমাদের এ কথাটা বুঝতে হবে যে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করলেও নৈতিকতা ও বিবেকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কোনো কর্মে আইনিভাবে ঠিক থাকা আর সামাজিক ও মানবিকভাবে ঠিক থাকা, সব সময় এক কথা নয়। সংবিধানের এমন কোনো বিধি নেই, যা দিয়ে সংসদে অনুপস্থিত থাকার পরও সাংসদদের জবাবদিহি তৈরির সুযোগ ঠেকানো যাবে, কিন্তু মানুষের মনে তো চলমানভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। সেই প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার মধ্যে সংবিধান বা আদালতের কোনো হাত নেই। মানুষের প্রতিক্রিয়ার জায়গাতেই সাংসদদের সম্পর্কে গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাচ্ছে অথবা কমে যাচ্ছে। সেখানেই মানুষ ঠিকই বুঝতে পারে, হরতালের মধ্যে অন্তর্নিহিত পোকাটি উসকে দেওয়া হচ্ছে কিসের উদ্দেশ্যে?
যখন পোকাটি উসকে ওঠে, তখন হরতালের ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক দিকটাই বড় হয়ে ওঠে। সেই নেতিবাচক দিক ঠেকাতে হয়। এটার বড় প্রমাণ দেখালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সাহেব। হরতালের মতো নেতিবাচক কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের পরীক্ষা চালু রাখলেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাঁর এ সিদ্ধান্তে ইতিবাচক ফল এসেছে। পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে জমায়েত হলে শিক্ষকের ওপর ক্লাস নেওয়ার নির্দেশ আছে। আমি নিশ্চিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদাহরণ সামনের হরতালের দিনগুলোতে অন্য সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুসরণ করতে সচেষ্ট হবে। হরতালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতির লেখাপড়া। এ ক্ষতি দেখা যায় না বলে আমরা তা নিয়ে বিচলিত হই না। অথচ এ ক্ষতিই কর্কট রোগের মতো ভবিষ্যতে বিস্তার লাভ করে সংহারী মূর্তি ধারণ করে। হরতালের সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হরতাল-কর্মসূচি থেকে অবমুক্ত রাখার জন্য আগেও আবেদন রেখেছিলাম, এখনো রাখছি হরতাল-দেনেওয়ালাদের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে নেতিবাচক হরতাল-বর্জনের ক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে, এটাও জাতির জন্য ভবিষ্যতে ইতিবাচক হবে।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
মানুষের এই ফোঁসানি দেখে বিরোধী দল ভাবল, এক দিনের হরতাল দেওয়া যায়। কিন্তু বৃহস্পতিবারের (২২ সেপ্টেম্বর) ১১ ঘণ্টার হরতালটা হরতাল-দেনেওয়ালাদের জন্য ভালো হয়নি মনে হয়। টিভির সচিত্র প্রতিবেদন দেখে এবং পত্রপত্রিকার বিভিন্ন ছবি দেখে ও সংবাদ পড়ে মনে হলো, হরতালটা সুবিধাজনক হয়নি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্বিবাদে তো অ-হরতাল পালিত হয়েছে, আর বিভিন্ন জেলা শহরে পুলিশের সঙ্গে কিছু পিকেটারের খণ্ড-বিখণ্ড পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে মাত্র। রাস্তাঘাটে বরং হরতালের বিপক্ষ নেওয়া লোকজনের সমাবেশ ও মিছিল জোরদার ছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সদস্য। প্রথম আলোর একটা ছবি ছিল যে হরতালের সময় ব্যস্ত না থাকার কারণে পুলিশের কয়েকজন নারী সদস্য ডাবের পানি পানে মনোনিবেশ করেছিলেন।
অর্থনীতির একটা সূত্র আছে, অতি প্রাপ্তির মাধ্যমে কাম্যতার ক্রমহ্রাস হবে। কোনো জিনিসের সরবরাহ বেশি হলে, প্রাপ্যতার পরিমাণ অনুযায়ী তার চাহিদা কমতে থাকবে। এখন মাথা থেকে একটা টুপি পড়লেই হরতালের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। তাই হরতাল বেশি দেওয়ায় জনগণ এর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ কোন ইস্যুতে সাড়া দেবে, সেটা বুঝতে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রয়োজন আছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি আরেকটি সরকার ক্ষমতায় না থাকলে যে হতো না, লোকে সেটা নিয়ে নিশ্চিত নয়। আর এটার বিশ্ব প্রেক্ষাপটটা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছেও পরিষ্কার। বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তি, সংস্থা ও রাষ্ট্রের কাছে নানা জটিল সমীকরণের মাধ্যমে জড়িত এবং এর ফলে যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান দুর্বল, এটা লোকে জানে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আশ্চর্য শীতল সফরের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক বঙ্গীয় নারীর ঘাড় ত্যাড়া করার কারণে তিস্তা নদীতে ট্রানজিট ডুবল, ভারতীয় অপূর্ব গণতান্ত্রিক কাঠামোর কারণে সেই নারী রক্ষাও পেলেন; কিন্তু এ ঘটনা যদি মোগল আমলে ঘটত, তাহলে বাংলার সবচেয়ে সুপরিচিত সুবেদার নবাব শায়েস্তা খানের ধড়বিহীন মুণ্ডু দিল্লির মসনদে আসীন বাদশাহর কাছে পৌঁছানোর জোর তাগিদ থাকত সিপাহশালারের ওপর। অথচ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাগাতে পারবে না বাংলাদেশ, তাঁকে সমঝে চলে কৌশলে তিস্তার পানি বের করে নেওয়ার কৌশলটি বাংলাদেশের দীপু মনিকে গ্রহণ করতে হবে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের এ পরাভূত অবস্থার মধ্যে বিরাট একটা হরতাল হতে পারত, যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো দুর্বলতাবশত ট্রানজিট দিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি সেটি দেননি এবং এর ফলে দেশের মানুষ যে তাঁর নেতৃত্বের দৃঢ়চেতা দিকটি সম্পর্কে নতুনভাবে অবগত হলো, সাধারণ মানুষের মধ্যে যে তাঁর সম্পর্কে আশাবাদ ব্যাপ্ত হয়েছে—এ সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর না রেখে হুট করে হরতাল দেওয়ায় লোকজন তেমন সাড়া দেয়নি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যে বলেছেন, এটা ছিল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে নয়, বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারব্যবস্থা বাধা দেওয়ার হরতাল। এটারও জুতসই জবাব বিরোধী দল থেকে আসতে পারেনি। কারণ, ঠিক এর দুই দিন আগে পুলিশকে হামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী মাঠে নেমেছিল। আর সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য আমলে নেওয়ার কারণ হয়েছে, বর্তমান প্রজন্ম ও আগের প্রজন্মের সচেতন অংশটি লোকের কথায় ও ইতিহাস পড়ে জানছে যে যুদ্ধাপরাধ আসলেই সংঘটিত হয়েছিল এবং অনেক লোকই এই অপরাধ সংঘটিত করেছিল, যাঁদের কেউ কেউ এখনো জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আছেন। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ যদি ক্রমে ইতিহাস-সচেতন হয়ে উঠতে থাকে, তারা যদি ঘটনার কার্যকারণ ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ঠিকমতো জানতে পারে, তাহলে মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এমনিতেই অবস্থান নেবে, তাদের শাস্তি চাইবে। এটি প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়বে।
হরতাল বিরোধী দলকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক-অধিকারপুষ্ট একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি। কিন্তু এর প্রয়োগ হতে হবে শেষতম চাল হিসেবে। চিকিৎসাসেবার ভাষায় বললে, কোরামিন বা জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে। যেমন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের মার্চের ৩ থেকে ৬ তারিখ, টানা চার দিন। ওই হরতাল এতটা কার্যকর ছিল যে তখন গাছের একটা পাতাও নড়েনি হরতালের হুকুমের বাইরে। এমনকি ৬ মার্চ যখন পাকিস্তানের সামরিক সরকার পাঞ্জাবের সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের স্থলাভিষিক্ত করেন, তখন গভর্নর হিসেবে ৯ মার্চ তাঁর শপথবাক্য পাঠ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী। তখন চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। (অবশ্য এই একই বি এ সিদ্দিকী ৯ এপ্রিল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করান।)
বঙ্গবন্ধুর ডাকা ওই হরতালকে যদি হরতালের ধ্রুপদি উদাহরণ ধরি, তাহলে বাংলাদেশে এরপর যত হরতাল হয়েছে, তা সবই হচ্ছে এর চেয়ে নিম্নমানের, অধোগতির, খাপছাড়া ও দিকনির্দেশনাবিহীন—কেবল নব্বইয়ের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালিত হরতালগুলো ছাড়া। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বউ-ঠাকুরানীর হাট উপন্যাসের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘লোকের যখন ধর্মজ্ঞান সহসা বিশেষ প্রবল হইয়া উঠে, তখন কোন যুক্তিই তাহার কাছে খাটে না।’ ঠিক সে রকম বিরোধী দলের মধ্যে হরতালজ্ঞান যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন কোনো যুক্তিই তাদের কাছে খাটে না।
আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বের আঙ্গিকে এ সমস্যাটা আলোচনা করা যায়। কাঠামোবাদী তাত্ত্বিক ফার্ডিনান্ড ডি স্যাসুর যুগ্ম বৈপরীত্যের (বাইনারি অপজিশন) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, দিন বললে আমরা ধরে নিই যে রাতও আছে। রবীন্দ্রনাথও একই কথা কাব্যিকভাবে বলে গেছেন যে দিনের আলোর মাঝে লুকিয়ে আছে রাতের সব তারা। এ ভাবটিকে একটু বিপরীতভাবে বিন্যাস করে আমরা বলতে পারি যে হরতাল নিরেট গণতান্ত্রিক ব্যাপার হলেও এর মধ্যে একটি যুক্তির দাঁত লুকিয়ে আছে। গরুর মাথার খুলি থেকে মগজ খোলার সময় কসাই একটি ছোট মাংসের গুটি ফেলে দেয়। ওরা এটাকে বলে ‘পোকা’, যেটি খেলে শরীরের ক্ষতি হয়। ঠিক সে রকম হরতাল গণতান্ত্রিক এবং বৈধ প্রতিবাদী পন্থা হলেও এর ভেতরের কাঠামোর মধ্যে একটি বিষপোকা আছে, যেটি সম্পর্কে হরতাল-দেনেওয়ালাদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে।
বিষপোকাটা কীভাবে উদগ্র হয়ে ওঠে, সেটা বলি। প্রথম হলো, বাংলাদেশে এখন সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে। সংসদকে কার্যকর রাখতে সরকারি ও বিরোধী দলগুলো তৎপর থাকবে, এটি জাতির আরাধ্য। কিন্তু বিরোধী দলের সাংসদেরা সাধারণত সংসদে যান না। যান তখন, যখন তাঁদের সংসদ সদস্যপদ অনুপস্থিতির কারণে বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়। অথচ তাঁরা মাসে মাসে বেতন টানেন এবং সব ধরনের সুবিধা ও ভাতা ভোগ করেন। কিছুদিন আগে প্রকাশিত বিজ্ঞাপিত তালিকায় দেখা গেছে, সুদমুক্ত বিলাসী গাড়ির সুযোগ ব্যবহার করার ব্যক্তিদের মধ্যে বিরোধী দলের সাংসদেরাও ছিলেন বড় জায়গাজুড়ে। গরিব দেশের মানুষের চোখে সমাজ-শাসকদের এসব যুগ্ম বৈপরীত্য যে পড়ে না, তা নয়। তাদের মধ্যে হতাশা ও নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। তখন তাদের মধ্যে শিক্ষক ক্লাস না নিয়ে আন্দোলন করলে যে ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, সাংসদ বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি গ্রহণ করেও সংসদে কার্যকর ভূমিকা না রাখলে একই প্রতিক্রিয়া হয়। আবার এই সাংসদদের রাজনৈতিক দলগুলোই যখন হরতাল ডাকে, তখন তাদের মনের মধ্যে নৈতিক প্রশ্নটা আসে, ‘কেন?’
আমাদের এ কথাটা বুঝতে হবে যে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করলেও নৈতিকতা ও বিবেকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কোনো কর্মে আইনিভাবে ঠিক থাকা আর সামাজিক ও মানবিকভাবে ঠিক থাকা, সব সময় এক কথা নয়। সংবিধানের এমন কোনো বিধি নেই, যা দিয়ে সংসদে অনুপস্থিত থাকার পরও সাংসদদের জবাবদিহি তৈরির সুযোগ ঠেকানো যাবে, কিন্তু মানুষের মনে তো চলমানভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। সেই প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ার মধ্যে সংবিধান বা আদালতের কোনো হাত নেই। মানুষের প্রতিক্রিয়ার জায়গাতেই সাংসদদের সম্পর্কে গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাচ্ছে অথবা কমে যাচ্ছে। সেখানেই মানুষ ঠিকই বুঝতে পারে, হরতালের মধ্যে অন্তর্নিহিত পোকাটি উসকে দেওয়া হচ্ছে কিসের উদ্দেশ্যে?
যখন পোকাটি উসকে ওঠে, তখন হরতালের ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক দিকটাই বড় হয়ে ওঠে। সেই নেতিবাচক দিক ঠেকাতে হয়। এটার বড় প্রমাণ দেখালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সাহেব। হরতালের মতো নেতিবাচক কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের পরীক্ষা চালু রাখলেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাঁর এ সিদ্ধান্তে ইতিবাচক ফল এসেছে। পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে জমায়েত হলে শিক্ষকের ওপর ক্লাস নেওয়ার নির্দেশ আছে। আমি নিশ্চিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদাহরণ সামনের হরতালের দিনগুলোতে অন্য সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুসরণ করতে সচেষ্ট হবে। হরতালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতির লেখাপড়া। এ ক্ষতি দেখা যায় না বলে আমরা তা নিয়ে বিচলিত হই না। অথচ এ ক্ষতিই কর্কট রোগের মতো ভবিষ্যতে বিস্তার লাভ করে সংহারী মূর্তি ধারণ করে। হরতালের সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হরতাল-কর্মসূচি থেকে অবমুক্ত রাখার জন্য আগেও আবেদন রেখেছিলাম, এখনো রাখছি হরতাল-দেনেওয়ালাদের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে নেতিবাচক হরতাল-বর্জনের ক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে, এটাও জাতির জন্য ভবিষ্যতে ইতিবাচক হবে।
ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments