শিক্ষা ব্যবস্থা-উৎপাদন ও কর্মমুখী কারিকুলামেই অগ্রগতি by আবু সাঈদ খান
সর্বক্ষেত্রেই কর্তৃত্বে নেতৃত্বে মেধার যোগ প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষাই সে চাহিদা মেটাতে পারে, জাতির মননে দিতে পারে নতুন দিশা। তাই উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে হবে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ সবার জন্য। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হবে নিয়মিত-অনিয়মিত সব শিক্ষার্থীর জন্য।
তথাকথিত 'ব্রেক অব স্টাডি'র খৰ উঁচিয়ে কোনো জ্ঞানপিপাসু মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পথে বাধা সৃষ্টি কাম্য নয়। সামগ্রিক বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার দ্বার হবে মেধাবীদের জন্য উন্মুক্ত। এর লক্ষ্য হবে শিক্ষিত বেকার তৈরি নয়, বরং উচ্চতর শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত মানুষ গড়া_ যারা নিবেদিত হবেন সৃষ্টিশীল
কাজে, গবেষণায় ও দেশের সামগ্রিক কল্যাণে
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে সম্প্রতি। কৃতকার্য ছেলেমেয়েদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ_ প্রত্যাশিত বিষয় ও পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আশ্বাস দিয়েছেন, সারাদেশে কলেজগুলোর যে ধারণ ক্ষমতা আছে তাতে আসন সংকট হবে না; তবে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হবে। আমরাও ধরে নিচ্ছি, কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে। তবে দেখা যাবে_ যে ডাক্তারি পড়তে চাইছে তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছে তাকে হয়তো পদার্থ বা রসায়ন বিজ্ঞানে ভর্তি হতে হবে। এমনকি ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা আছে, এমন শিক্ষার্থীকে হয়তো ইতিহাস বা সাহিত্যে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নিজস্ব পছন্দ বা প্রত্যাশার মূল্য সামান্যই। এটি শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক অদ্ভুত নিয়ম চালু করেছে। সেটি হলো অনুষদ বা ফ্যাকাল্টিই নম্বর অনুসারে শিক্ষার্থীর জন্য বিষয় ঠিক করে দিচ্ছে। হয়তো একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে চাইল, কিন্তু বাস্তবে তাকে পালি কিংবা ইতিহাসে পড়তে হয়। নম্বরই এখানে মুখ্য। এই নম্বরের কারণে বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির কোনো ছাত্রকে কলা কিংবা সোশ্যাল সায়েন্সে আসতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে শিক্ষার সঙ্গে মনের যোগ থাকে না সে শিক্ষা কতটুকু স্বাস্থ্যকর এবং এমন শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে কতটুকু সাফল্য দেখানো সম্ভব?
যারা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই হকিকত জানেন না তাদের মনে হতে পারে, অধিক মাত্রায় পরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে এটি হচ্ছে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে, এখানে শিক্ষার সঙ্গে কর্মযোগের বিষয়টি একেবারেই গৌণ। সাহিত্য বা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে ব্যাংকের হিসাবরক্ষক হতে হয়েছে, এমন উদাহরণ অনেক। অথচ এ কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল হিসাববিজ্ঞানের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা। একইভাবে নাট্যতত্ত্ব বা সঙ্গীতের ডিগ্রিধারীদের শিল্পকলা একাডেমী বা সংশ্লিষ্ট পেশায় চাকরি হচ্ছে না। পুরাতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রদের পুরাতত্ত্ব অধিদফতর বা জাদুঘরগুলোতে চাকরি হচ্ছে না। কাউকে কাউকে এমবিবিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট হতে দেখেছি। মানুষের পেশা পরিবর্তনের অধিকার আছে। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পেশায় কাজ করার মধ্য দিয়ে যে অধিকতর যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখা সম্ভব, অন্য বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের দিয়ে সে কাজ করানো দুরূহ।
শিক্ষাঙ্গনের অভিজ্ঞতা অনুসারে পেশা চয়নের সুযোগ নেই। এ কারণে সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে এক ধরনের হাতুড়েপনা। এ হাতুড়েপনায় আমাদের জাতীয় উন্নয়নের ধারা হচ্ছে বাধাগ্রস্ত, কর্মশক্তির হচ্ছে অপচয়।
আমরা শিক্ষা বলতে সাধারণ শিক্ষাকেই বিবেচনা করছি, যা উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসক প্রবর্তিত। যে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল_ এমন একদল বশংবদ তৈরি করা, যারা মানসিকতায়, মেজাজে সাহেব_ রক্ত-মাংসে ভারতীয়। খানিকটা ইংরেজি শিখিয়ে তাদের ব্যবহার করা অর্থাৎ কেরানি তৈরিই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। সেই বিবেচনায় বিএ-এমএ পাস করে অফিসার হওয়া থেকে কেরানি-আরদালির চাকরি পাবে এমন আশায় বঙ্গসন্তানদের স্কুলে পাঠানো হতো। শিক্ষার লক্ষ্য একমাত্র সরকারি চাকরি পাওয়ার মানসিকতার ওপর শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে নেই। পরিবর্তন ঘটেছে। ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ তৈরির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। তবে তা অপরিকল্পিতভাবে। আমাদের কত চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও অন্য পেশা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ লাগবে তা বিবেচনায় রেখে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে না। তার চেয়ে বড় কথা, দক্ষ শ্রমিক ও কারিগর গড়ে তোলার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত।
উন্নত বিশ্বে শিক্ষার আয়োজন এখন প্রধানত কর্মমুখী। কোথায়ও মাধ্যমিক, কোথায়ও-বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এশিয়ার দেশ চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সমধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আমরা পিছিয়ে রয়েছি। ইন্টারনেট ঘেঁটে যে তথ্য পেলাম তাতে বাংলাদেশে কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ৩ শতাংশের নিচে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ অনেক দেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব দেশে ব্যাপকভাবে কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে। অনেক দেশেই সেটি শিক্ষার প্রধান ধারা। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশেও এটি হতে হবে শিক্ষার প্রধান ধারা। এটি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
এ বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় নেই তা বলছি না। সম্প্রতি শিক্ষানীতিতে এ দিকনির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলছেন। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু অগ্রগতি হচ্ছে? নতুন কারিগরি স্কুল স্থাপন কিংবা জুনিয়র ও হাই স্কুলগুলোতে কারিগরি শাখা খোলার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হওয়া দরকার সেটি দেওয়া হচ্ছে না। এখনও জিডিপির মাত্র ২.২৩ শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ। সেটি ৬ শতাংশে আনার প্রস্তাব যখন অর্থমন্ত্রী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন এবং সাংসদরা কথা বলেন না তখন কী করে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হবে? এই অতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে উপেক্ষা থাকলেও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসারে সব সরকারই অতি উৎসাহী। এর পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নয়, ভোটের রাজনীতিই যে ক্রিয়াশীল তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।
আজ সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রসারই হবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নতুন করে কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি সুপরিকল্পিতভাবে মাদ্রাসা ও সাধারণ স্কুলগুলোতে কারিগরি শাখা খুলতে হবে। সব শাখার ছাত্রদের খানিকটা কারিগরি জ্ঞান দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরই হবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য। জনশক্তি হচ্ছে সেই দক্ষ শ্রমিক থেকে বিশেষজ্ঞ_ যারা হবে কৃষি ও শিল্প উন্নয়নের বাহক।
কৃষি আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল খাত, শত প্রতিকূলতার মুখেও কৃষক সোনালি ফসল ফলিয়ে চলেছেন। কৃষকের ঘামে-শ্রমে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটিকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষির আরও আধুনিকায়ন জরুরি। এ জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার সেই সংযোজন দরকার, যা কৃষিতে দক্ষ লোকবল সরবরাহ করবে, শিল্পের জন্য দক্ষ শ্রমিক-কারিগর তৈরি করবে। নিশ্চিত করবে স্বাস্থ্যসহ সব বিভাগে দক্ষ জনবল।
এই শিক্ষা পরিকল্পনার মধ্যে কেবল সরকারি ও অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, কিন্ডারগার্টেনসহ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অননুমোদিত কওমি মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গেও সমন্বয় ঘটাতে হবে। কওমি মাদ্রাসাগুলোতে সাধারণত হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানরা পড়ে। তাদের পরিকল্পনার বাইরে রেখে দেশের কল্যাণের চিন্তা অলীক। বরং এ ক্ষেত্রে যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যেন বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা লাভ করতে পারে, সে সুযোগ নিশ্চিত হওয়া দরকার।
আমাদের কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য ফরমাল-ইনফরমাল সেক্টরে শিক্ষিত যুবকরা কি আসছে না? অবশ্যই আসছে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি-শিল্পসহ সর্বত্রই শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু তারা আসছে সাধারণ শিক্ষা নিয়ে, প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান নিয়ে নয়। এখানে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তাদের আগমন স্বতঃস্ফূর্ত ও আত্মবলে বলীয়ান হয়ে নয়। খানিকটা যেন নিরুপায় হয়ে।
এ প্রসঙ্গে আমি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের কথা উল্লেখ করতে চাই। তাদের একাংশ পুনরায় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। আর একাংশ জীবনযুদ্ধে শরিক হয়। অনিবার্যভাবে তারা আসছে কৃষিতে, গার্মেন্ট-সিরামিক-ওষুধসহ বিভিন্ন শিল্পে কিংবা পরিবহন-হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যারা কলেজে ভর্তি হয় তাদের একাংশও কোর্স অসমাপ্ত রেখেই কাজে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এখানে যদি প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকত, দিকনির্দেশনা থাকত_ তবে সেই কোর্স সমাপন করে তারা কাজে নামত উদ্যম ও মনোবল নিয়ে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে দেশের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে।
অতএব যুগের চাহিদা বিবেচনায় রেখে জীবনমুখী, কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব, অন্য কোনো গোঁজামিল দিয়ে নয়।
এ লেখা পড়ে কারও মনে হতে পারে, আমি উচ্চশিক্ষার ওপর কম গুরুত্ব দিচ্ছি। মোটেও তা নয়। বরং আমি মনে করি, সর্বক্ষেত্রেই কর্তৃত্বে নেতৃত্বে মেধার যোগ প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষাই সে চাহিদা মেটাতে পারে, জাতির মননে দিতে পারে নতুন দিশা। তাই উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে হবে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ সবার জন্য। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হবে নিয়মিত-অনিয়মিত সব শিক্ষার্থীর জন্য। তথাকথিত 'ব্রেক অব স্টাডি'র খৰ উঁচিয়ে কোনো জ্ঞানপিপাসু মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পথে বাধা সৃষ্টি কাম্য নয়। সামগ্রিক বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার দ্বার হবে মেধাবীদের জন্য উন্মুক্ত। এর লক্ষ্য হবে শিক্ষিত বেকার তৈরি নয়, বরং উচ্চতর শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত মানুষ গড়া_ যারা নিবেদিত হবেন সৃষ্টিশীল কাজে, গবেষণায় ও দেশের সামগ্রিক কল্যাণে।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
কাজে, গবেষণায় ও দেশের সামগ্রিক কল্যাণে
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে সম্প্রতি। কৃতকার্য ছেলেমেয়েদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ_ প্রত্যাশিত বিষয় ও পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আশ্বাস দিয়েছেন, সারাদেশে কলেজগুলোর যে ধারণ ক্ষমতা আছে তাতে আসন সংকট হবে না; তবে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হবে। আমরাও ধরে নিচ্ছি, কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে। তবে দেখা যাবে_ যে ডাক্তারি পড়তে চাইছে তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছে তাকে হয়তো পদার্থ বা রসায়ন বিজ্ঞানে ভর্তি হতে হবে। এমনকি ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা আছে, এমন শিক্ষার্থীকে হয়তো ইতিহাস বা সাহিত্যে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নিজস্ব পছন্দ বা প্রত্যাশার মূল্য সামান্যই। এটি শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক অদ্ভুত নিয়ম চালু করেছে। সেটি হলো অনুষদ বা ফ্যাকাল্টিই নম্বর অনুসারে শিক্ষার্থীর জন্য বিষয় ঠিক করে দিচ্ছে। হয়তো একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে চাইল, কিন্তু বাস্তবে তাকে পালি কিংবা ইতিহাসে পড়তে হয়। নম্বরই এখানে মুখ্য। এই নম্বরের কারণে বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির কোনো ছাত্রকে কলা কিংবা সোশ্যাল সায়েন্সে আসতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে শিক্ষার সঙ্গে মনের যোগ থাকে না সে শিক্ষা কতটুকু স্বাস্থ্যকর এবং এমন শিক্ষায় একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে কতটুকু সাফল্য দেখানো সম্ভব?
যারা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই হকিকত জানেন না তাদের মনে হতে পারে, অধিক মাত্রায় পরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে এটি হচ্ছে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে, এখানে শিক্ষার সঙ্গে কর্মযোগের বিষয়টি একেবারেই গৌণ। সাহিত্য বা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে ব্যাংকের হিসাবরক্ষক হতে হয়েছে, এমন উদাহরণ অনেক। অথচ এ কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল হিসাববিজ্ঞানের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা। একইভাবে নাট্যতত্ত্ব বা সঙ্গীতের ডিগ্রিধারীদের শিল্পকলা একাডেমী বা সংশ্লিষ্ট পেশায় চাকরি হচ্ছে না। পুরাতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রদের পুরাতত্ত্ব অধিদফতর বা জাদুঘরগুলোতে চাকরি হচ্ছে না। কাউকে কাউকে এমবিবিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট হতে দেখেছি। মানুষের পেশা পরিবর্তনের অধিকার আছে। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পেশায় কাজ করার মধ্য দিয়ে যে অধিকতর যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখা সম্ভব, অন্য বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের দিয়ে সে কাজ করানো দুরূহ।
শিক্ষাঙ্গনের অভিজ্ঞতা অনুসারে পেশা চয়নের সুযোগ নেই। এ কারণে সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে এক ধরনের হাতুড়েপনা। এ হাতুড়েপনায় আমাদের জাতীয় উন্নয়নের ধারা হচ্ছে বাধাগ্রস্ত, কর্মশক্তির হচ্ছে অপচয়।
আমরা শিক্ষা বলতে সাধারণ শিক্ষাকেই বিবেচনা করছি, যা উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসক প্রবর্তিত। যে শিক্ষার লক্ষ্য ছিল_ এমন একদল বশংবদ তৈরি করা, যারা মানসিকতায়, মেজাজে সাহেব_ রক্ত-মাংসে ভারতীয়। খানিকটা ইংরেজি শিখিয়ে তাদের ব্যবহার করা অর্থাৎ কেরানি তৈরিই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। সেই বিবেচনায় বিএ-এমএ পাস করে অফিসার হওয়া থেকে কেরানি-আরদালির চাকরি পাবে এমন আশায় বঙ্গসন্তানদের স্কুলে পাঠানো হতো। শিক্ষার লক্ষ্য একমাত্র সরকারি চাকরি পাওয়ার মানসিকতার ওপর শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে নেই। পরিবর্তন ঘটেছে। ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ তৈরির জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। তবে তা অপরিকল্পিতভাবে। আমাদের কত চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও অন্য পেশা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ লাগবে তা বিবেচনায় রেখে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে না। তার চেয়ে বড় কথা, দক্ষ শ্রমিক ও কারিগর গড়ে তোলার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত।
উন্নত বিশ্বে শিক্ষার আয়োজন এখন প্রধানত কর্মমুখী। কোথায়ও মাধ্যমিক, কোথায়ও-বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এশিয়ার দেশ চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সমধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আমরা পিছিয়ে রয়েছি। ইন্টারনেট ঘেঁটে যে তথ্য পেলাম তাতে বাংলাদেশে কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ৩ শতাংশের নিচে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ অনেক দেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব দেশে ব্যাপকভাবে কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে। অনেক দেশেই সেটি শিক্ষার প্রধান ধারা। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশেও এটি হতে হবে শিক্ষার প্রধান ধারা। এটি বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকে সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
এ বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় নেই তা বলছি না। সম্প্রতি শিক্ষানীতিতে এ দিকনির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলছেন। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু অগ্রগতি হচ্ছে? নতুন কারিগরি স্কুল স্থাপন কিংবা জুনিয়র ও হাই স্কুলগুলোতে কারিগরি শাখা খোলার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হওয়া দরকার সেটি দেওয়া হচ্ছে না। এখনও জিডিপির মাত্র ২.২৩ শতাংশ শিক্ষার জন্য বরাদ্দ। সেটি ৬ শতাংশে আনার প্রস্তাব যখন অর্থমন্ত্রী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন এবং সাংসদরা কথা বলেন না তখন কী করে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হবে? এই অতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে উপেক্ষা থাকলেও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসারে সব সরকারই অতি উৎসাহী। এর পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নয়, ভোটের রাজনীতিই যে ক্রিয়াশীল তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।
আজ সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রসারই হবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নতুন করে কারিগরি প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি সুপরিকল্পিতভাবে মাদ্রাসা ও সাধারণ স্কুলগুলোতে কারিগরি শাখা খুলতে হবে। সব শাখার ছাত্রদের খানিকটা কারিগরি জ্ঞান দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরই হবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য। জনশক্তি হচ্ছে সেই দক্ষ শ্রমিক থেকে বিশেষজ্ঞ_ যারা হবে কৃষি ও শিল্প উন্নয়নের বাহক।
কৃষি আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল খাত, শত প্রতিকূলতার মুখেও কৃষক সোনালি ফসল ফলিয়ে চলেছেন। কৃষকের ঘামে-শ্রমে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটিকে এগিয়ে নিতে হলে কৃষির আরও আধুনিকায়ন জরুরি। এ জন্য শিক্ষিত ও দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার সেই সংযোজন দরকার, যা কৃষিতে দক্ষ লোকবল সরবরাহ করবে, শিল্পের জন্য দক্ষ শ্রমিক-কারিগর তৈরি করবে। নিশ্চিত করবে স্বাস্থ্যসহ সব বিভাগে দক্ষ জনবল।
এই শিক্ষা পরিকল্পনার মধ্যে কেবল সরকারি ও অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, কিন্ডারগার্টেনসহ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অননুমোদিত কওমি মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গেও সমন্বয় ঘটাতে হবে। কওমি মাদ্রাসাগুলোতে সাধারণত হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানরা পড়ে। তাদের পরিকল্পনার বাইরে রেখে দেশের কল্যাণের চিন্তা অলীক। বরং এ ক্ষেত্রে যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যেন বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা লাভ করতে পারে, সে সুযোগ নিশ্চিত হওয়া দরকার।
আমাদের কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য ফরমাল-ইনফরমাল সেক্টরে শিক্ষিত যুবকরা কি আসছে না? অবশ্যই আসছে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি-শিল্পসহ সর্বত্রই শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু তারা আসছে সাধারণ শিক্ষা নিয়ে, প্রয়োজনীয় কারিগরি জ্ঞান নিয়ে নয়। এখানে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তাদের আগমন স্বতঃস্ফূর্ত ও আত্মবলে বলীয়ান হয়ে নয়। খানিকটা যেন নিরুপায় হয়ে।
এ প্রসঙ্গে আমি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের কথা উল্লেখ করতে চাই। তাদের একাংশ পুনরায় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। আর একাংশ জীবনযুদ্ধে শরিক হয়। অনিবার্যভাবে তারা আসছে কৃষিতে, গার্মেন্ট-সিরামিক-ওষুধসহ বিভিন্ন শিল্পে কিংবা পরিবহন-হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যারা কলেজে ভর্তি হয় তাদের একাংশও কোর্স অসমাপ্ত রেখেই কাজে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এখানে যদি প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকত, দিকনির্দেশনা থাকত_ তবে সেই কোর্স সমাপন করে তারা কাজে নামত উদ্যম ও মনোবল নিয়ে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে দেশের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে।
অতএব যুগের চাহিদা বিবেচনায় রেখে জীবনমুখী, কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব, অন্য কোনো গোঁজামিল দিয়ে নয়।
এ লেখা পড়ে কারও মনে হতে পারে, আমি উচ্চশিক্ষার ওপর কম গুরুত্ব দিচ্ছি। মোটেও তা নয়। বরং আমি মনে করি, সর্বক্ষেত্রেই কর্তৃত্বে নেতৃত্বে মেধার যোগ প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষাই সে চাহিদা মেটাতে পারে, জাতির মননে দিতে পারে নতুন দিশা। তাই উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে দিতে হবে ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ সবার জন্য। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় হবে নিয়মিত-অনিয়মিত সব শিক্ষার্থীর জন্য। তথাকথিত 'ব্রেক অব স্টাডি'র খৰ উঁচিয়ে কোনো জ্ঞানপিপাসু মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পথে বাধা সৃষ্টি কাম্য নয়। সামগ্রিক বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার দ্বার হবে মেধাবীদের জন্য উন্মুক্ত। এর লক্ষ্য হবে শিক্ষিত বেকার তৈরি নয়, বরং উচ্চতর শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত মানুষ গড়া_ যারা নিবেদিত হবেন সৃষ্টিশীল কাজে, গবেষণায় ও দেশের সামগ্রিক কল্যাণে।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments