স্মরণ-অনুভবে আছ by লবী রহমান

এই অপূরণীয় ক্ষতির মাশুল কি সম্ভব? কাকে করব এ প্রশ্ন? কে ছিল এ লোমহর্ষক কাহিনীর নেপথ্যে? কী ছিল তার স্বার্থ? কিসের ওপর চালিয়ে দিল ব্রেকহীন বুলডোজার? স্তব্ধ করে দিল জীবনের গতি। ভাবছেন বলব 'প্রশ্ন করুন বিবেককে', জানি বিবেকের বিকৃত লাশ_ এখন নর্দমার ভেতর।


সেদিন ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি, নিয়মিত উঠেছিল সূর্য, দিন শেষে অস্তও গেল ঝর্ণার মৃদু চঞ্চল চরণ প্রান্তরে নূপুর বাজিয়ে অনুস্টুপ ছন্দে যে সময় কাটত, তা যেন আজ প্রকৃতির মতো প্রশান্ত। বনহরিণীর সে চঞ্চলতা আজ আর নেই। ফুল ঝরে গেছে উন্মুক্ত সবুজ চত্বরে। দূর্বাদলের মৃদু শিহরণ আজ বিদায় নিয়েছে। গিরিলালিত জীবন স্পন্দের শিশির বিন্দু শুকিয়ে গেছে করালগ্রাসী সূর্যোদাহের নিষ্ঠুর সামাজিকতার কঠিন বিষবাষ্পে; হারিয়ে গেছে হেমন্তের ঝরা ফসলের মতো আমার সোনালি দিন।
ঠিক যেন শৈলচূড়ায় বরফের আলো ঠিকরায়ে পড়েছে, কিন্তু বরফ এখনও গলল না, আমি জানি_ সে ছিল অকলঙ্ক শুভ্র, সে কী নিবিড় পবিত্র! সাড়া দেওয়া বিজয়ের পর বিসর্জনের সানাইয়ের সুরের মাঝে শুনতে পাই আজও সেই মধুর ডাক_ লবী তুমি কোথায়?
এ কী হলো! এমন তো কথা ছিল না! এতগুলো প্রাণ অকালে কেনইবা কেড়ে নিলো হায়েনার কালো থাবায়। এই অপূরণীয় ক্ষতির মাশুল কি সম্ভব? কাকে করব এ প্রশ্ন? কে ছিল এ লোমহর্ষক কাহিনীর নেপথ্যে? কী ছিল তার স্বার্থ? কিসের ওপর চালিয়ে দিল ব্রেকহীন বুলডোজার? স্তব্ধ করে দিল জীবনের গতি। ভাবছেন বলব 'প্রশ্ন করুন বিবেককে', জানি বিবেকের বিকৃত লাশ_ এখন নর্দমার ভেতর। সেদিন ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি, নিয়মিত উঠেছিল সূর্য, দিন শেষে অস্তও গেল। কিন্তু আমার জীবনে সুখের সূর্যটা কালের করালগ্রাসে অস্ত হলো অনন্তকালের জন্য। এখন একমাত্রই অবলম্বন তা হলো স্মৃতি, সেই মধুর স্মৃতির মাঝে নিজেকে সান্ত্বনা দিই_
'পৃথিবীটা সুন্দর ছিল
তুমি ছিলে বলে
আজও আছে সুন্দর
সেই পৃথিবী
অনুভবে তুমি আছ বলে'
জীবনের নিয়মে হচ্ছে সকাল, কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙছে সবার, দখিনা জানালাও খুলছে সবাই। হিমেল সি্নগ্ধ বাতাসও বইছে, ঘরে_ কল্পনার রঙে রাঙাচ্ছে সবার জীবন। দীর্ঘ সুখোময় ক্লান্তি শেষে ঘুমাচ্ছে সবাই আর আমার অন্তর্দহনে জ্বলছে বুক, বইছে খরাময়ী বিষবাষ্পভরা দূষিত বাতাস, আর নয়ন গড়ানো জলে ভিজছে বালিশ। সে সঙ্গে চিন্তা-ক্লান্তি শেষে লম্বা দীর্ঘশ্বাস!
কিন্তু কেন? কী ছিল মোদের অপরাধ? সততার তো কোনো ঘাটতি ছিল না। শপথ অনুযায়ী ছিল কর্ম তৎপরতা। অন্যায়ের সঙ্গে ছিল না কোনো আপস। তবে কি এটাই ছিল অপরাধ?
মাঝে মধ্যে মনে হয় কবর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে চিৎকার করে বলি, আর একদিনের জন্য জেগে ধরো অস্ত্র, নির্দেশ দাও তোমার প্লাটুনকে। সবার মুখোশ দাও খুলে, করো না তাদের কোনো ক্ষমা। এসব ভেবে আবার ক্লান্ত হয়ে যাই আর অস্থিরতায় এপাশ-ওপাশ করি।
জানি, সারাজীবন কলম চালিয়ে আমার লেখা হবে না শেষ। জানতেও পারব না কাকে লিখব। লিখে আর জানিয়েও কোনো লাভ হবে না কারও। পূরণ হবে না সে ক্ষতির। এ বিষবাষ্পপূর্ণ সমাজ শুধু ব্ল্যাকহোলের মতো কেড়ে নিতেই জানে, জানে না কিছু দিতে। যারা করেছে আমার এ হাল, তাদের বলছি :
আজ যদি জানতে ভালো লাগার মানুষকে এভাবে কেড়ে নিলে যে কী যন্ত্রণা হয়, তাহলে করতে না এ তাণ্ডবলীলা। ডানাভাঙা পাখির মতো এতগুলো পরিবারকে করতে না সর্বস্বান্ত, এ যে কী কষ্ট! প্রতিটি নিঃশ্বাসেই শুধু হতাশা, হাহাকার...
ইলাহী তোমাকেই লিখছি :
'জানি না তো শুনছ কি ওপার বসে
আমার এ বেদনার ডাক
তোমায় পেয়েও যদি সব হারাতাম
মিছে যত থাক পড়ে থাক'
'সেই মধুডাক
আজও প্রতিটি প্রহরজুড়ে,
প্রতি নিঃশ্বাসে আমি করি যে স্মরণ;
যেদিন থেমে যাবে করতে স্মরণ,
জেনে নিও, সেদিনই হবে
সাথীহারা এ হৃদয়েরই মৃত্যুবরণ'

লবী রহমান :পিলখানায় নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহীর সহধর্মিণী

No comments

Powered by Blogger.