সেনাকুঞ্জের বৈঠক ছিল অতি ঝুঁকিপূর্ণ
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ২০০৯ সালের ১ মার্চ ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে একটি তারবার্তা পাঠান। ওই তারবার্তায় সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠককে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরে উইকিলিকস ফাঁস করে দেয় তারবার্তাটি।
তারবার্তায় বলা হয়, বিডিআর বিদ্রোহ দমনের তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৫০০ উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সহকর্মীরা বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়ায় সেনা কর্মকর্তারা তখন রাগে-ক্ষোভে রীতিমতো ফুঁসছিলেন। সেনা কর্মকর্তারা মনে করছিলেন, বিদ্রোহীদের ‘বেতন ভাতাদি-সংক্রান্ত বঞ্চনা’র প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল, বিদ্রোহ দমনে তাৎক্ষণিক সেনা অভিযানের নির্দেশ দেওয়া। তারবার্তায় বলা হয়, বিদ্রোহের শুরুতেই বেশির ভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে শেষ পর্যন্ত রক্তপাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে সক্ষম হওয়ায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে শেখ হাসিনা ব্যাপক প্রশংসিত হন।
মরিয়ার্টির পাঠানো ওই তারবার্তায় বলা হয়, হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া বিডিআর সদস্যদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা, ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা এবং নিহত কর্মকর্তাদের স্বজনদের আর্থিক সহায়তাদানের ঘোষণা দেওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরই হাসিনা সেনা কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পরও তিনি সেনানিবাসকে শান্ত করতে ব্যর্থ হন। বার্তায় ‘নোট’ আকারে বলা হয়, শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক দূতাবাসের (মার্কিন দূতাবাস) কর্মকর্তাদের বলেছেন, মন্ত্রিসভার সদস্যরা শেখ হাসিনাকে ওই বৈঠকে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের কথা না শুনে ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও তারিক আহমেদ সিদ্দিককে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা প্রায় ৫০০ সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। সেখানে তিনি ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উত্তপ্ত বাক্যবাণের মুখে পড়েন। বার্তায় বলা হয়, তারিক সিদ্দিক দূতাবাসের কর্মকর্তাদের জানান, শোরগোলরত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি এমন অনেককেই চেনেন, যাঁরা কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধী। তিনি বলেন, প্রচণ্ড উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হলেও দোয়া ও মোনাজাতের পর পরিস্থিতি অনেক শান্ত হয়ে আসে। তিনি বলেন, বৈঠকে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে প্রধানমন্ত্রীর অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসার বিষয়টি এখনো তাঁকে অবাক করে।
তারবার্তায় বলা হয়, কয়েকটি সূত্র দূতাবাসের কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল, বৈঠকে কিছু সেনা কর্মকর্তা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের অপসারণ দাবি করেন। বৈঠক চলাকালে কয়েকজন উত্তেজিত কর্মকর্তা চেয়ার ভাঙচুর করেন এবং দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকেন। অনেক কর্মকর্তা বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের দ্রুত বিচার এবং দোষীদের প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি জানান।
২০০৯ সালের ৫ মার্চ ওয়াশিংটনে পাঠানো অপর একটি তারবার্তায় বলা হয়, বিদ্রোহের ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর বাংলাদেশ দৃশ্যত ঘোরতর সংকট থেকে উতরে গেলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকেই যায়।
তারবার্তায় বলা হয়, বিরোধী দল বিএনপি শুরুতে এ ঘটনা তদন্তে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও পরে এ জন্য তারা সরকারকে দায়ী করতে শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, গণতন্ত্র নস্যাৎ করতে কুচক্রী মহল আবার এ ধরনের হামলা চালাতে পারে।
বিএনপি অভিযোগ করে, বিদ্রোহ দমনে প্রধানমন্ত্রী সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের পদত্যাগ দাবি করেন।
বিষয়টি নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ঘুরপাক খেতে থাকে। অনেকে বিদ্রোহের মূল পরিকল্পক হিসেবে ভারতকে, অনেকে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে, অনেকে আবার জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন।
৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটাতে আরও নাশকতামূলক ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
তারবার্তায় বলা হয়, আপাতত মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা বড় ধরনের সংকট কাটিয়ে উঠেছেন। রক্তপাতের পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ায় স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় ও অন্যান্য গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়। গণমাধ্যমে বলা হয়, শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে আলোচনা করে শত শত সেনা কর্মকর্তার ক্ষোভ প্রশমন করেন, যা সেনা অভ্যুত্থানের সমূহ আশঙ্কাকে স্তিমিত করে দিতে সক্ষম হয়।
শেখ হাসিনা সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষোভ প্রশমনে পলাতক বিদ্রোহীদের ধরতে সেনাবাহিনীকে অনুমতি দেওয়ার মতো বিভিন্ন দাবি মেনে নেন। দুই দিনব্যাপী ‘অগ্নিপরীক্ষা’ চলাকালে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ দৃশ্যত শেখ হাসিনার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন এবং তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। তথাপি, সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্পর্কে জটিলতা রয়েই গেছে। দোষীদের বিচার না হলে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগসহ সেনাবাহিনীর অন্যান্য দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া না হলে শেখ হাসিনা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আবারও বিবাদ বাধতে সময় লাগবে না।
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
মরিয়ার্টির পাঠানো ওই তারবার্তায় বলা হয়, হত্যাযজ্ঞে অংশ নেওয়া বিডিআর সদস্যদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা, ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা এবং নিহত কর্মকর্তাদের স্বজনদের আর্থিক সহায়তাদানের ঘোষণা দেওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরই হাসিনা সেনা কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পরও তিনি সেনানিবাসকে শান্ত করতে ব্যর্থ হন। বার্তায় ‘নোট’ আকারে বলা হয়, শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক দূতাবাসের (মার্কিন দূতাবাস) কর্মকর্তাদের বলেছেন, মন্ত্রিসভার সদস্যরা শেখ হাসিনাকে ওই বৈঠকে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের কথা না শুনে ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও তারিক আহমেদ সিদ্দিককে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা প্রায় ৫০০ সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। সেখানে তিনি ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উত্তপ্ত বাক্যবাণের মুখে পড়েন। বার্তায় বলা হয়, তারিক সিদ্দিক দূতাবাসের কর্মকর্তাদের জানান, শোরগোলরত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি এমন অনেককেই চেনেন, যাঁরা কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধী। তিনি বলেন, প্রচণ্ড উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হলেও দোয়া ও মোনাজাতের পর পরিস্থিতি অনেক শান্ত হয়ে আসে। তিনি বলেন, বৈঠকে পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে প্রধানমন্ত্রীর অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসার বিষয়টি এখনো তাঁকে অবাক করে।
তারবার্তায় বলা হয়, কয়েকটি সূত্র দূতাবাসের কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল, বৈঠকে কিছু সেনা কর্মকর্তা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের অপসারণ দাবি করেন। বৈঠক চলাকালে কয়েকজন উত্তেজিত কর্মকর্তা চেয়ার ভাঙচুর করেন এবং দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকেন। অনেক কর্মকর্তা বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের দ্রুত বিচার এবং দোষীদের প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি জানান।
২০০৯ সালের ৫ মার্চ ওয়াশিংটনে পাঠানো অপর একটি তারবার্তায় বলা হয়, বিদ্রোহের ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর বাংলাদেশ দৃশ্যত ঘোরতর সংকট থেকে উতরে গেলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকেই যায়।
তারবার্তায় বলা হয়, বিরোধী দল বিএনপি শুরুতে এ ঘটনা তদন্তে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও পরে এ জন্য তারা সরকারকে দায়ী করতে শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, গণতন্ত্র নস্যাৎ করতে কুচক্রী মহল আবার এ ধরনের হামলা চালাতে পারে।
বিএনপি অভিযোগ করে, বিদ্রোহ দমনে প্রধানমন্ত্রী সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের পদত্যাগ দাবি করেন।
বিষয়টি নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ঘুরপাক খেতে থাকে। অনেকে বিদ্রোহের মূল পরিকল্পক হিসেবে ভারতকে, অনেকে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে, অনেকে আবার জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন।
৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটাতে আরও নাশকতামূলক ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
তারবার্তায় বলা হয়, আপাতত মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনা বড় ধরনের সংকট কাটিয়ে উঠেছেন। রক্তপাতের পুনরাবৃত্তি এড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ায় স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় ও অন্যান্য গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়। গণমাধ্যমে বলা হয়, শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে আলোচনা করে শত শত সেনা কর্মকর্তার ক্ষোভ প্রশমন করেন, যা সেনা অভ্যুত্থানের সমূহ আশঙ্কাকে স্তিমিত করে দিতে সক্ষম হয়।
শেখ হাসিনা সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষোভ প্রশমনে পলাতক বিদ্রোহীদের ধরতে সেনাবাহিনীকে অনুমতি দেওয়ার মতো বিভিন্ন দাবি মেনে নেন। দুই দিনব্যাপী ‘অগ্নিপরীক্ষা’ চলাকালে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ দৃশ্যত শেখ হাসিনার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন এবং তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। তথাপি, সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্পর্কে জটিলতা রয়েই গেছে। দোষীদের বিচার না হলে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগসহ সেনাবাহিনীর অন্যান্য দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া না হলে শেখ হাসিনা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আবারও বিবাদ বাধতে সময় লাগবে না।
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
No comments