চলতি পথে-আমঝুপি নীলকুঠি
মেহেরপুর শহর মাইল খানেক দূরে তখনো। আকাশে ছড়ানো শেষ বিকেলের আবীর। চট করে নেমে পড়লাম বাস থেকে। আমঝুপি নামের ছোট্ট বাজারে পা রাখলাম আমরা। তারপর রিকশা নিলাম। অল্প পথ অতিক্রমের পর পৌঁছালাম ব্যতিক্রমী একটি স্থাপনার সামনে। বিভিন্ন বৃক্ষশোভিত এই স্থাপনাই আমঝুপি নীলকুঠি।
নীলকুঠির সম্পৃক্ততা কৃষিজাত ফসল নীলের সঙ্গে। বাংলাদেশের কৃষকেরা নীল চাষে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না কখনোই। প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য এবং প্রচলিত কিছু অর্থকরী ফসল উৎপাদনের মধ্যেই খুঁজে নিতেন তাঁরা যাপিত জীবনের সুখ। তাই বাংলাদেশে কখনোই সৃষ্টি হয়নি নীল চাষের ব্যাপক প্রচলন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বাংলাদেশের জমির উর্বরতা সম্পর্কে উচ্চমহল অবগত ছিল ভালোভাবেই। ১৭৮৮ সালের ১ নভেম্বর লন্ডনে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে এক বার্তা পাঠালেন বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ। পাঠানো সেই বার্তায় তিনি জানালেন, ‘বাংলাদেশের নীল ইউরোপের বিরাট একটি অংশের চাহিদা মেটাতে সমর্থ হবে।’
বাংলাদেশে নীল চাষের ব্যাপারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু বড়লাটের দিকনির্দেশনায় তাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান হলো। বাংলাদেশে নীল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করলেন কোম্পানির কর্মকর্তারা। উৎপাদন ও মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে নীল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন অভিজ্ঞ নীলকর সাহেবকে এ দেশে আনলেন তাঁরা। তৈরি করে দিলেন নীল ব্যবসা করার যথাযথ সুযোগ।
নীলকর সাহেবরা বাংলাদেশের কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করলেন। বিভিন্ন জেলায় তাঁরা গড়ে তুললেন নীল কারখানা। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে তৈরি করলেন একের পর এক নীলকুঠি। আমঝুপি নীলকুঠিটিও তৈরি হয়েছিল এ দেশে নীল চাষ শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে।
কৃষকদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের সাক্ষী এই নীলকুঠির অভ্যন্তরে চারটি কক্ষ। প্রথমেই যে কক্ষটিতে প্রবেশ করলাম আমরা, নীলকুঠির কক্ষগুলোর মধ্যে সেটিই সর্ববৃহৎ। কাঠের মেঝে যুক্ত অর্ধগোলাকার এই কক্ষের এক কোনায় একটা ফায়ার প্লেস। কক্ষটির সামনের দেয়ালের উপরিভাগে টাঙানো বড় একটি মহিষের মাথা। বাকি তিনটি কক্ষ তুলনামূলক ছোট আকারের। কক্ষগুলো ঘুরে দেখলাম আমরা। পুরোনো সময়ের চিহ্ন বলতে আজ আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই এই নীলকুঠিতে।
কক্ষ পরিদর্শনের পর বারান্দায় এলাম। বারান্দার শেষ প্রান্তে কয়েক স্তরবিশিষ্ট সিঁড়ি। অপ্রশস্ত এই সিঁড়িগুলো নেমে গেছে সুসজ্জিত একটি বাগানের দিকে। বাগানের সীমানাদেয়াল ঘেঁষেই ক্ষীণস্রোতা কাজলা নদী। নদীতীরে কয়েকটি সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চ। সেই বেঞ্চগুলোর একটিতে বসে ছিলেন রাজানগর এ আর বি কলেজের ছাত্র হাবিবুল ইসলাম। স্থানীয় এই যুবকের পাশে বসে কথা বললাম কিছুক্ষণ। আমঝুপি নীলকুঠিসংক্রান্ত আরও কিছু তথ্য আমাদের জানালেন হাবিবুল ইসলাম। তিনি বললেন, আবাদ-প্রক্রিয়া গতিশীল করতে নীলকর সাহেবরা বেশ কয়েকটি যৌথ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এ দেশে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বলা হতো কনসার্ন। আমঝুপি নীলকুঠিটি ছিল জেমস হিলস কনসার্নের অন্তর্ভুক্ত। এই নীলকুঠির কুঠিয়াল এবং তার সতীর্থদের অত্যাচারে এই এলাকার কৃষকদের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। অত্যাচারের এই চিত্র শুধু আমঝুপিতেই নয়, বিদ্যমান ছিল প্রতিটি নীলকুঠির অন্তর্গত আবাদি এলাকায়। কিন্তু কোনো অন্যায়-অত্যাচারই চিরকালীন নয়, প্রতিকারহীন নয় পৃথিবীতে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ কৃষকেরা প্রতিবাদমুখর হতে থাকেন ধীরে ধীরে। তাঁদের এই প্রতিবাদ ইস্পাতদৃঢ় হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে সংঘবদ্ধ আন্দোলন। শুরু হয় বিদ্রোহ। বিদ্রোহের চূড়ান্ত লগ্নে বাংলার বুক থেকে উৎপাটিত হয় নীল চাষের শিকড়।
নীলকর সাহেবদের কর্মকাণ্ড স্তিমিত হওয়ার পর বহুদিন নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকে নীলকুঠিগুলো। কোনো কোনো কুঠির মালিকানা বদল হয়। আমঝুপি নীলকুঠিটি পরিণত হয় মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির কাছারিতে। দেশভাগের পর উচ্ছেদ হয় জমিদারি-প্রথা। কিছুদিন পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকে আমঝুপি নীলকুঠি। তারপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর গ্রহণ করে আমঝুপি নীলকুঠির দায়িত্ব।
হাবিবুল ইসলাম প্রায় প্রতি বিকেলেই ঘুরতে আসেন নীলকুঠি এলাকায়। একজন এলাকাবাসী হিসেবে কেমন লাগে তাঁর কাছে আমঝুপি নীলকুঠিটি? প্রশ্ন করি আমরা। প্রত্যুত্তরে হাবিবুল ইসলাম ছোট্ট করে বলেন, ‘ভালোই।’ কিন্তু ‘ভালো’ শব্দটির শেষাংশে যুক্ত থাকা ‘ই’ প্রত্যয়টি কেন জানি দ্বিধাগ্রস্ত করে আমাদের। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হাবিবুল ইসলাম যে কথাগুলো তুলে ধরেন আমাদের কাছে, তার প্রতিটি ছত্রে মিশে থাকে নীলকুঠি সংরক্ষণ-প্রক্রিয়ায় বিরাজমান অব্যবস্থাপনার বর্ণনা। এসব অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তাঁরা মাঝে মাঝেই, কিন্তু প্রতিকার হয় না মোটেই। হাবিবুল ইসলামের কথাটি কি সত্য সম্পূর্ণভাবে? না, কারণ প্রতিবাদের ধরন ইস্পাতদৃঢ় হলে প্রতিকারহীন কিছুই থাকে না পৃথিবীতে।
দীপংকর চন্দ
লক্ষ করুন
১৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর খোলা কলম অংশে চলতি পথে ফিচারটিতে যে সৌধটিকে মণি সিংহের স্মৃতিসৌধ নামে অভিহিত করা হয়েছে, সেটি মূলত তাঁর নেতৃত্বে সফল হওয়া টংক আন্দোলনে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভটি দুর্গাপুর এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে মণি সিংহ স্মৃতিসৌধ নামে পরিচিত বলেই এই বিভ্রান্তি। দুঃখিত। বি.স.
বাংলাদেশে নীল চাষের ব্যাপারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু বড়লাটের দিকনির্দেশনায় তাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান হলো। বাংলাদেশে নীল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করলেন কোম্পানির কর্মকর্তারা। উৎপাদন ও মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে নীল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন অভিজ্ঞ নীলকর সাহেবকে এ দেশে আনলেন তাঁরা। তৈরি করে দিলেন নীল ব্যবসা করার যথাযথ সুযোগ।
নীলকর সাহেবরা বাংলাদেশের কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করলেন। বিভিন্ন জেলায় তাঁরা গড়ে তুললেন নীল কারখানা। ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে তৈরি করলেন একের পর এক নীলকুঠি। আমঝুপি নীলকুঠিটিও তৈরি হয়েছিল এ দেশে নীল চাষ শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে।
কৃষকদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের সাক্ষী এই নীলকুঠির অভ্যন্তরে চারটি কক্ষ। প্রথমেই যে কক্ষটিতে প্রবেশ করলাম আমরা, নীলকুঠির কক্ষগুলোর মধ্যে সেটিই সর্ববৃহৎ। কাঠের মেঝে যুক্ত অর্ধগোলাকার এই কক্ষের এক কোনায় একটা ফায়ার প্লেস। কক্ষটির সামনের দেয়ালের উপরিভাগে টাঙানো বড় একটি মহিষের মাথা। বাকি তিনটি কক্ষ তুলনামূলক ছোট আকারের। কক্ষগুলো ঘুরে দেখলাম আমরা। পুরোনো সময়ের চিহ্ন বলতে আজ আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই এই নীলকুঠিতে।
কক্ষ পরিদর্শনের পর বারান্দায় এলাম। বারান্দার শেষ প্রান্তে কয়েক স্তরবিশিষ্ট সিঁড়ি। অপ্রশস্ত এই সিঁড়িগুলো নেমে গেছে সুসজ্জিত একটি বাগানের দিকে। বাগানের সীমানাদেয়াল ঘেঁষেই ক্ষীণস্রোতা কাজলা নদী। নদীতীরে কয়েকটি সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চ। সেই বেঞ্চগুলোর একটিতে বসে ছিলেন রাজানগর এ আর বি কলেজের ছাত্র হাবিবুল ইসলাম। স্থানীয় এই যুবকের পাশে বসে কথা বললাম কিছুক্ষণ। আমঝুপি নীলকুঠিসংক্রান্ত আরও কিছু তথ্য আমাদের জানালেন হাবিবুল ইসলাম। তিনি বললেন, আবাদ-প্রক্রিয়া গতিশীল করতে নীলকর সাহেবরা বেশ কয়েকটি যৌথ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এ দেশে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বলা হতো কনসার্ন। আমঝুপি নীলকুঠিটি ছিল জেমস হিলস কনসার্নের অন্তর্ভুক্ত। এই নীলকুঠির কুঠিয়াল এবং তার সতীর্থদের অত্যাচারে এই এলাকার কৃষকদের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। অত্যাচারের এই চিত্র শুধু আমঝুপিতেই নয়, বিদ্যমান ছিল প্রতিটি নীলকুঠির অন্তর্গত আবাদি এলাকায়। কিন্তু কোনো অন্যায়-অত্যাচারই চিরকালীন নয়, প্রতিকারহীন নয় পৃথিবীতে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ কৃষকেরা প্রতিবাদমুখর হতে থাকেন ধীরে ধীরে। তাঁদের এই প্রতিবাদ ইস্পাতদৃঢ় হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে সংঘবদ্ধ আন্দোলন। শুরু হয় বিদ্রোহ। বিদ্রোহের চূড়ান্ত লগ্নে বাংলার বুক থেকে উৎপাটিত হয় নীল চাষের শিকড়।
নীলকর সাহেবদের কর্মকাণ্ড স্তিমিত হওয়ার পর বহুদিন নিষ্ক্রিয় পড়ে থাকে নীলকুঠিগুলো। কোনো কোনো কুঠির মালিকানা বদল হয়। আমঝুপি নীলকুঠিটি পরিণত হয় মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির কাছারিতে। দেশভাগের পর উচ্ছেদ হয় জমিদারি-প্রথা। কিছুদিন পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকে আমঝুপি নীলকুঠি। তারপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর গ্রহণ করে আমঝুপি নীলকুঠির দায়িত্ব।
হাবিবুল ইসলাম প্রায় প্রতি বিকেলেই ঘুরতে আসেন নীলকুঠি এলাকায়। একজন এলাকাবাসী হিসেবে কেমন লাগে তাঁর কাছে আমঝুপি নীলকুঠিটি? প্রশ্ন করি আমরা। প্রত্যুত্তরে হাবিবুল ইসলাম ছোট্ট করে বলেন, ‘ভালোই।’ কিন্তু ‘ভালো’ শব্দটির শেষাংশে যুক্ত থাকা ‘ই’ প্রত্যয়টি কেন জানি দ্বিধাগ্রস্ত করে আমাদের। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হাবিবুল ইসলাম যে কথাগুলো তুলে ধরেন আমাদের কাছে, তার প্রতিটি ছত্রে মিশে থাকে নীলকুঠি সংরক্ষণ-প্রক্রিয়ায় বিরাজমান অব্যবস্থাপনার বর্ণনা। এসব অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তাঁরা মাঝে মাঝেই, কিন্তু প্রতিকার হয় না মোটেই। হাবিবুল ইসলামের কথাটি কি সত্য সম্পূর্ণভাবে? না, কারণ প্রতিবাদের ধরন ইস্পাতদৃঢ় হলে প্রতিকারহীন কিছুই থাকে না পৃথিবীতে।
দীপংকর চন্দ
লক্ষ করুন
১৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর খোলা কলম অংশে চলতি পথে ফিচারটিতে যে সৌধটিকে মণি সিংহের স্মৃতিসৌধ নামে অভিহিত করা হয়েছে, সেটি মূলত তাঁর নেতৃত্বে সফল হওয়া টংক আন্দোলনে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভটি দুর্গাপুর এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে মণি সিংহ স্মৃতিসৌধ নামে পরিচিত বলেই এই বিভ্রান্তি। দুঃখিত। বি.স.
No comments