চারদিক-চার যুগে সুধীজন পাঠাগার by ফারজানা নাজ
মহান ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছর বা পাঁচ যুগ উদ্যাপনের সঙ্গে যখন মিলে গেল, তখন সংগঠকেরা কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন বৈকি। তবে তা তাঁদের উৎসাহ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। আর তাই নারায়ণগঞ্জের বৃহত্তম বেসরকারি গণগ্রন্থাগার সুধীজন পাঠাগারের চার যুগ পূর্তির আয়োজনটা চলল ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই।
১৯৬৪ সালে মাত্র ১০টি বই, বই রাখার একটি আলমারি, একটি টেবিল, ১০টি চেয়ার আর দুটি হারিকেন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। ওই বছর ২ ফেব্রুয়ারি গঠনতন্ত্র চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হওয়ায় এ তারিখটি বিবেচিত হয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে।
চার যুগ পূর্তিতে বা ৪৮ বছরে পদার্পণ কালে দাঁড়িয়ে তাই প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠকেরা যথেষ্ট আবেগাপ্লুতও বটে। ৩৫ হাজারের বেশি বই রয়েছে যার সংগ্রহে এবং দৈনিক যেখানে গড়ে ১৬০টি বই ইস্যু হয়, সেখানে কর্মতৎপরতার বৈচিত্র্যও নেহাত কম নয়। তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা ১৯৭৮ সালে একখণ্ড জমি লিজ হিসেবে দেয় সুধীজন পাঠাগারকে। তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান আলী আহমদ চুনকা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বিশাল সহযোগিতার হাত। সেই জমির ওপর আজকে তিনতলা ভবনে কাজ চলছে পাঠাগারটির। ভবনের একতলা ও দোতলায় কৃষি ব্যাংক ভাড়া নিয়ে আছে সেই শুরু থেকে, যা প্রতিষ্ঠানটির আয়ের প্রধান উৎস।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. হায়াৎ মামুদ আনুষ্ঠানিকভাবে এই চার যুগ পূর্তি উদ্যাপন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এতে তিনি যুগপূর্তির ধারণাটিকে সমর্থন দিয়ে বলেন যে দশকের উদ্যাপন (১০ বছর ও গুণিতক) মূলত পশ্চিমা জগতে অনুসৃত। যুগপূর্তি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার অংশ। তাঁর এই বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই সংগঠকদের উদ্দীপ্ত করেছে।
এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ছিল হোসেন জামাল স্মৃতি পুরস্কার প্রদান। সুধীজন পাঠাগারের অকালপ্রয়াত নিবেদিতপ্রাণ এই কর্মীর স্মরণে পাঠাগার ও জামাল পরিবারের যৌথ অর্থায়নে এ পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে। চেষ্টা থাকে যেন জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা বিস্তার, গ্রন্থ উন্নয়ন ও গ্রন্থাগার সংগঠনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের কাজের এক বিনীত স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দেওয়া যায়। সেই প্রয়াসেই এবার ৫০ হাজার টাকা মূল্যমানের পুরস্কারটি পেলেন গোপালগঞ্জের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির প্রায় ৬০ বছর ধরে অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক মঈন উদ্দিন। তাঁর হাতে চেক ও সনদপত্র তুলে দেন সুধীজন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা কর্মাধ্যক্ষ ফজলে রাব্বি। ফজলে রাব্বিকে বাংলাদেশে গ্রন্থাগার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর একই অনুষ্ঠানে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খানের প্রায় ৪০ মিনিটের জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মুগ্ধ হন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা। তিনি জানান, কোনো গ্রন্থাগারের শেলফে রক্ষিত বইগুলো নাড়াচাড়া করে যদি দেখা যায় যে বইগুলো কিছু ছেঁড়া-ফাড়া, কিছু এক বা একাধিকবার সেলাই-বাঁধাই করা, কিছু জীর্ণ হয়ে গেছে, তাহলে ওই গ্রন্থাগারটিকে সক্রিয় বলা যায়। কেননা, বইগুলো নিয়মিত ব্যবহূত হয়। সুধীজন পাঠাগারকেও তিনি এই সক্রিয়তার কাতারে ফেলেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী বাংলা বানানের কর্মশালা আয়োজন করা হয়। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলের ৩৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা এতে অংশ নেন। কর্মশালাটি পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল হক। মাহবুবুল হক তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় ভাষার প্রবহমানতা ও বানানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করেন। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের একটি অভিধান, বানানের নিয়মের একটি বই ও ভাতা দেওয়া হয়। সুধীজন পাঠাগার অবশ্য এর আগে ২০০২ সালেও একই ধরনের কর্মশালার আয়োজন করেছিল। সেটা ছিল পাঁচ দিনের। তাতে প্রশিক্ষক ছিলেন বশির আল হেলাল ও করুণাময় গোস্বামী। আবার সেই বছর ছিল ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর। ওই বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ভাষাসৈনিকদের সংবর্ধনা দিয়েছিল এই সুধীজন পাঠাগার। আর তা করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের ভাষাসৈনিকদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যা এখন অত্যন্ত মূল্যবান কাজ বলে বিবেচিত হয়।
তবে এই উদ্যাপনের একটি বড় আয়োজন ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠচক্র। গত ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়ে যা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে শেষ হয়েছে। এতে ৩০ জন পাঠক ভাষা আন্দোলনের বাছাই করা পাঁচটি বই পড়েছেন ও সেগুলোর ওপর আলোচনা লিখেছেন। আর ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা সুধীজন পাঠাগারে জড়ো হয়। তারা সেখানে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি বই পড়ে ও তাৎক্ষণিক কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এই পাঠচক্রের সেরা পাঠক ও কুইজে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হবে। আর এই পুরস্কার বিতরণ করবেন বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিক। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপন কার্যক্রম শেষ হবে।
তবে উদ্যাপনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও গ্রন্থসেবার নিরন্তর কাজে কোনো বিরতি দিতে চান না সংগঠকেরা। বরং সুধীজন পাঠাগারকে কেন্দ্র করে জ্ঞানচর্চা ও মুক্তবুদ্ধির অনুশীলনের প্রসার ঘটাতে আর আলোকময় সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যেতেই আগ্রহী তাঁরা।
ফারজানা নাজ
চার যুগ পূর্তিতে বা ৪৮ বছরে পদার্পণ কালে দাঁড়িয়ে তাই প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠকেরা যথেষ্ট আবেগাপ্লুতও বটে। ৩৫ হাজারের বেশি বই রয়েছে যার সংগ্রহে এবং দৈনিক যেখানে গড়ে ১৬০টি বই ইস্যু হয়, সেখানে কর্মতৎপরতার বৈচিত্র্যও নেহাত কম নয়। তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা ১৯৭৮ সালে একখণ্ড জমি লিজ হিসেবে দেয় সুধীজন পাঠাগারকে। তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান আলী আহমদ চুনকা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বিশাল সহযোগিতার হাত। সেই জমির ওপর আজকে তিনতলা ভবনে কাজ চলছে পাঠাগারটির। ভবনের একতলা ও দোতলায় কৃষি ব্যাংক ভাড়া নিয়ে আছে সেই শুরু থেকে, যা প্রতিষ্ঠানটির আয়ের প্রধান উৎস।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. হায়াৎ মামুদ আনুষ্ঠানিকভাবে এই চার যুগ পূর্তি উদ্যাপন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এতে তিনি যুগপূর্তির ধারণাটিকে সমর্থন দিয়ে বলেন যে দশকের উদ্যাপন (১০ বছর ও গুণিতক) মূলত পশ্চিমা জগতে অনুসৃত। যুগপূর্তি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার অংশ। তাঁর এই বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই সংগঠকদের উদ্দীপ্ত করেছে।
এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ছিল হোসেন জামাল স্মৃতি পুরস্কার প্রদান। সুধীজন পাঠাগারের অকালপ্রয়াত নিবেদিতপ্রাণ এই কর্মীর স্মরণে পাঠাগার ও জামাল পরিবারের যৌথ অর্থায়নে এ পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে। চেষ্টা থাকে যেন জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা বিস্তার, গ্রন্থ উন্নয়ন ও গ্রন্থাগার সংগঠনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের কাজের এক বিনীত স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দেওয়া যায়। সেই প্রয়াসেই এবার ৫০ হাজার টাকা মূল্যমানের পুরস্কারটি পেলেন গোপালগঞ্জের নজরুল পাবলিক লাইব্রেরির প্রায় ৬০ বছর ধরে অবৈতনিক গ্রন্থাগারিক মঈন উদ্দিন। তাঁর হাতে চেক ও সনদপত্র তুলে দেন সুধীজন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা কর্মাধ্যক্ষ ফজলে রাব্বি। ফজলে রাব্বিকে বাংলাদেশে গ্রন্থাগার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর একই অনুষ্ঠানে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খানের প্রায় ৪০ মিনিটের জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মুগ্ধ হন উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা। তিনি জানান, কোনো গ্রন্থাগারের শেলফে রক্ষিত বইগুলো নাড়াচাড়া করে যদি দেখা যায় যে বইগুলো কিছু ছেঁড়া-ফাড়া, কিছু এক বা একাধিকবার সেলাই-বাঁধাই করা, কিছু জীর্ণ হয়ে গেছে, তাহলে ওই গ্রন্থাগারটিকে সক্রিয় বলা যায়। কেননা, বইগুলো নিয়মিত ব্যবহূত হয়। সুধীজন পাঠাগারকেও তিনি এই সক্রিয়তার কাতারে ফেলেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী বাংলা বানানের কর্মশালা আয়োজন করা হয়। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলের ৩৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা এতে অংশ নেন। কর্মশালাটি পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল হক। মাহবুবুল হক তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় ভাষার প্রবহমানতা ও বানানের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করেন। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের একটি অভিধান, বানানের নিয়মের একটি বই ও ভাতা দেওয়া হয়। সুধীজন পাঠাগার অবশ্য এর আগে ২০০২ সালেও একই ধরনের কর্মশালার আয়োজন করেছিল। সেটা ছিল পাঁচ দিনের। তাতে প্রশিক্ষক ছিলেন বশির আল হেলাল ও করুণাময় গোস্বামী। আবার সেই বছর ছিল ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর। ওই বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ভাষাসৈনিকদের সংবর্ধনা দিয়েছিল এই সুধীজন পাঠাগার। আর তা করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের ভাষাসৈনিকদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়, যা এখন অত্যন্ত মূল্যবান কাজ বলে বিবেচিত হয়।
তবে এই উদ্যাপনের একটি বড় আয়োজন ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠচক্র। গত ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়ে যা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে শেষ হয়েছে। এতে ৩০ জন পাঠক ভাষা আন্দোলনের বাছাই করা পাঁচটি বই পড়েছেন ও সেগুলোর ওপর আলোচনা লিখেছেন। আর ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা সুধীজন পাঠাগারে জড়ো হয়। তারা সেখানে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি বই পড়ে ও তাৎক্ষণিক কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এই পাঠচক্রের সেরা পাঠক ও কুইজে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হবে। আর এই পুরস্কার বিতরণ করবেন বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিক। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপন কার্যক্রম শেষ হবে।
তবে উদ্যাপনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও গ্রন্থসেবার নিরন্তর কাজে কোনো বিরতি দিতে চান না সংগঠকেরা। বরং সুধীজন পাঠাগারকে কেন্দ্র করে জ্ঞানচর্চা ও মুক্তবুদ্ধির অনুশীলনের প্রসার ঘটাতে আর আলোকময় সমাজ বিনির্মাণে কাজ করে যেতেই আগ্রহী তাঁরা।
ফারজানা নাজ
No comments