নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি-বাকি মেয়াদ কি সরকার উল্টা পথে চলবে? by এ কে এম জাকারিয়া
দেশের ‘সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ নিয়ে এক আলোচনা হয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগের। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিরোধী দলের পাল্টা কোনো কর্মসূচি দেবে না আওয়ামী লীগ। খুবই ভালো কথা। আর দলের শীর্ষ নেতারা নাকি এখন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন।
ক্ষমতার অর্ধেক মেয়াদ পার করার পর দলের শীর্ষ নেতাদের এই বোধোদয় হলো! কখনো না হওয়ার চেয়ে নাকি দেরিতে হওয়াও ভালো। বিখ্যাত এই ইংরেজি প্রবাদ মানলে এটাকে ভালো বলেই মানতে হচ্ছে। তবে কথা হচ্ছে, দলটির যে এখন নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত, তা শীর্ষ নেতারা ‘মনে’ করেন। শীর্ষ নেতারা মনে করলেই কি দলটি সব বাদ দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে কী প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়বে? দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন না। তিনি যে সভায় অনুপস্থিত, সেখানে নেওয়া সিদ্ধান্ত বা মতামত কি খুব গুরুত্ব বহন করে? আওয়ামী লীগের নেতারা এ ধরনের প্রশ্নে খুবই বিরক্ত, বিব্রত ও মনঃক্ষুণ্ন হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ দলটি যে কতটা ‘গণতান্ত্রিক’ তা দলের মুখপাত্র অন্তত আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা আর বাস্তবতা যে আমাদের আশাবাদী হতে দেয় না।
আওয়ামী লীগের ‘শীর্ষ’ নেতাদের এই বোধোদয় শেষ পর্যন্ত দলটি বিবেচনায় নিক বা না নিক, তাঁরা তো দলীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে হলেও অন্তত তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। এটাই বা কম কি! সরকারের মেয়াদ পার হয়েছে আধাআধি, বলা যায় হাফটাইম। প্রথমার্ধের আড়াই বছরের খেলাটি কেমন হলো, সরকারের এই মূল্যায়ন তো দলের মধ্যে হতেই পারে। দলের যেসব শীর্ষ নেতা নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়ার পক্ষে, তাঁরা হয়তো মূল্যায়নের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। আর দল ও সরকার—এই দুটির বাইরে যাঁরা আছেন, মানে জনগণ, তাঁদের মূল্যায়নটা কী রকম হতে পারে?
গত কয়েক দিনে অনেকটা জরিপের মতো করে ২০ জনের কাছে একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম। প্রশ্নটি অনেকটা এ রকম—এই সরকারের আড়াই বছরে সরকার ভুলত্রুটি নিশ্চয় করেছে, কোন তিনটি ভুলকে আপনি সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল বলে মনে করেন? এই ২০ জনের প্রত্যেকে যে তিনটি ভুল চিহ্নিত করেছেন তা অবশ্যই এক নয়। আর এগুলো এমন আলাদাও নয় যে ২০ জন তিনটি করে সরকারের ৬০টি ভুল চিহ্নিত করেছেন। সব মিলিয়ে সাধারণ যে ভুলগুলোর কথা উঠে এসেছে, তার সংখ্যা ছয়টি।
বলে রাখি, এটা কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে করা জরিপ নয়। অধিকাংশ মত নেওয়া হয়েছে টেলিফোনে এবং সবাই ঢাকায় থাকেন। তবে শ্রেণী ও পেশায় বৈচিত্র্য রয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, আইনজীবী, সরকারি চাকরিজীবী, বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দোকানকর্মী ও অটোরিকশাচালক। সবাই নিয়মিত পত্রিকা পড়েন, অনেকে টিভি টক শো—এসব দেখেন।
এই সরকারের ‘ভুলগুলোর’ একটি তালিকা করা যাক। ১. মন্ত্রিসভা ২. প্রতিহিংসা ৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, ৪. শেয়ারবাজার ৫. দ্রব্যমূল্য ৬. বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ। ক্রম মেনে তালিকাটি করা হয়েছে। মানে ২০ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক সরকারের মন্ত্রিসভাকে একটি ‘ভুল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সবগুলো বিষয় একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। যাঁরা মন্ত্রিসভাকে সরকারের একটি ভুল হিসেবে দেখছেন, কারও কাছে এই মন্ত্রিসভা ‘কচিকাঁচা’, কারও কাছে ‘অথর্ব’। ‘অদক্ষ লোকজনকে দিয়ে মন্ত্রিসভা করা সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল। যেসব মন্ত্রী ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের সরানোও হয়নি, জবাবদিহির কোনো ব্যাপার নেই। সব মিলিয়ে সরকার অকার্যকর হয়ে পড়েছে।’ এটা একজনের মন্তব্য।
সরকারের কিছু কিছু আচরণকে প্রতিহিংসার প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকে। এ ধরনের আচরণ সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে তাঁরা মনে করেন। অনেকের কাছে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আওয়ামী লীগের ‘সংস্কারবাদীদের’ প্রতি সরকারের আচরণকে প্রতিহিংসামূলক বলেছেন অনেকে। বলেছেন ইউনূসের কথা। ‘আইনগতভাবে ইউনূস হয়তো গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে পারেন না, কিন্তু সরকার বিষয়টি যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে, তাতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া এই ব্যক্তিটির প্রতি সরকার যে প্রতিহিংসাপরায়ণ, তা প্রকাশ পেয়েছে। বিষয়টি অনেকের কাছেই ভালো লাগেনি। প্রতিহিংসা বিষয়টি জনগণ পছন্দ করে না।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করাকে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা বলে মনে করেন অধিকাংশ লোক। তবে এই চেষ্টা যে চূড়ান্ত বিচারে কাজে দেয় না, সেটাও মানেন সবাই। ‘বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য হেন চেষ্টা নাই যে করে নাই। নানা কিছু সাজিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন সেই একই পথ ধরেছে, মনে হয় সারা জীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি যে ভুল করেছিল, আওয়ামী লীগও একই ভুল করতে যাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে।’
এসেছে শেয়ারবাজারের প্রসঙ্গ। কিন্তু শেয়ারবাজার সরকারের ‘ভুল’ হিসেবে বিবেচিত হয় কীভাবে? সরকারের এ ক্ষেত্রে করার কী ছিল? যে উত্তর পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এ রকম: সাধারণ লোকজন মনে করে যে শেয়ারবাজারের এই পরিণতি বা কেলেঙ্কারির জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁরা সরকারের কাছের লোক। সরকারের কাছের লোক বলেই তাঁরা এসব করতে পেরেছেন। সাধারণ লোকজন যাঁদের অভিযুক্ত বলে মনে করে, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এবং তাঁরা এখনো সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে রয়ে গেছেন বলেই জনমনে ধারণা।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাও সরকারের বড় ভুল বা ত্রুটি বলে মনে করেন কেউ কেউ। অভিযোগ হচ্ছে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারেনি। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বা মাত্রায় বেড়েছে, তাকে যৌক্তিক বলে মানতে চান না তাঁরা। সে কারণেই সরকারের কিছু করণীয় আছে এবং সরকার তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
একটি একক ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতা তাহেরের ছেলে বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের বিষয়টি। এই কাজটি করে আওয়ামী লীগ একটি বড় ভুল করেছে বলে মনে করেন অনেকে। ‘একটি মাত্র লোকের জন্য আওয়ামী লীগ তার ভাবমূর্তির এত বড় ক্ষতি কেন করল, তা মাথায় ঢোকেনি। এই ঘটনা দলটি সম্পর্কে অনেকের মনে বাজে ধারণার সৃষ্টি করছে।’
আগেই বলেছি, এটা কোনো তত্ত্ব বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে করা জরিপ নয়, সাধারণ লোকজনের কিছু ধারণা ও প্রতিক্রিয়া। সরকারের কাছে হয়তো এর কোনো মূল্য নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ক্ষমতার মেয়াদের মধ্যভাগে এসে দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে পরামর্শ দিচ্ছেন কেন? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতির অভাব নেই। বাকি আড়াই বছরে কোনগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব, তার কি কোনো তালিকা তৈরি করেছেন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ইচ্ছুক নেতারা? সরকারের যে ভুলগুলো চিহ্নিত করেছেন কয়েকজন, এর সঙ্গে কি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কোনো সম্পর্ক রয়েছে? নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কিছু কিছু অংশ আমরা আবার স্মরণ করে দেখতে পারি। ‘একটি প্রকৃত অংশীদারিমূলক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, দূষণমুক্ত পরিবেশ, গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র’ (আমাদের অঙ্গীকার, কর্মসূচি ও ঘোষণা)। ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে (অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয় ১.১ দ্রব্যমূল্য)। ‘জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে’ (সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ৫.৩)। ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ করা হবে’ (সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ৫.৪)।
সরকারের যে ছয়টি ‘ভুল’ উঠে এসেছে কয়েকজনের ‘জরিপে’, সেগুলোর সঙ্গে আইনের শাসন, সুশাসন, জবাবদিহি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সহিষ্ণুতা, দ্রব্যমূল্য—এসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সম্পর্ক রয়েছে। শীর্ষ নেতাদের কথা মেনে সরকার যদি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথ ধরে, তাহলে গত আড়াই বছর যেভাবে চলল, বাকি আড়াই বছরে তো তার উল্টো পথে চলতে হবে। সরকারের পক্ষে কি উল্টো পথে চলা সম্ভব?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
আওয়ামী লীগের ‘শীর্ষ’ নেতাদের এই বোধোদয় শেষ পর্যন্ত দলটি বিবেচনায় নিক বা না নিক, তাঁরা তো দলীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে হলেও অন্তত তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। এটাই বা কম কি! সরকারের মেয়াদ পার হয়েছে আধাআধি, বলা যায় হাফটাইম। প্রথমার্ধের আড়াই বছরের খেলাটি কেমন হলো, সরকারের এই মূল্যায়ন তো দলের মধ্যে হতেই পারে। দলের যেসব শীর্ষ নেতা নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়ার পক্ষে, তাঁরা হয়তো মূল্যায়নের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। আর দল ও সরকার—এই দুটির বাইরে যাঁরা আছেন, মানে জনগণ, তাঁদের মূল্যায়নটা কী রকম হতে পারে?
গত কয়েক দিনে অনেকটা জরিপের মতো করে ২০ জনের কাছে একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম। প্রশ্নটি অনেকটা এ রকম—এই সরকারের আড়াই বছরে সরকার ভুলত্রুটি নিশ্চয় করেছে, কোন তিনটি ভুলকে আপনি সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল বলে মনে করেন? এই ২০ জনের প্রত্যেকে যে তিনটি ভুল চিহ্নিত করেছেন তা অবশ্যই এক নয়। আর এগুলো এমন আলাদাও নয় যে ২০ জন তিনটি করে সরকারের ৬০টি ভুল চিহ্নিত করেছেন। সব মিলিয়ে সাধারণ যে ভুলগুলোর কথা উঠে এসেছে, তার সংখ্যা ছয়টি।
বলে রাখি, এটা কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে করা জরিপ নয়। অধিকাংশ মত নেওয়া হয়েছে টেলিফোনে এবং সবাই ঢাকায় থাকেন। তবে শ্রেণী ও পেশায় বৈচিত্র্য রয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন সাংবাদিক, আইনজীবী, সরকারি চাকরিজীবী, বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দোকানকর্মী ও অটোরিকশাচালক। সবাই নিয়মিত পত্রিকা পড়েন, অনেকে টিভি টক শো—এসব দেখেন।
এই সরকারের ‘ভুলগুলোর’ একটি তালিকা করা যাক। ১. মন্ত্রিসভা ২. প্রতিহিংসা ৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, ৪. শেয়ারবাজার ৫. দ্রব্যমূল্য ৬. বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ। ক্রম মেনে তালিকাটি করা হয়েছে। মানে ২০ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক সরকারের মন্ত্রিসভাকে একটি ‘ভুল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সবগুলো বিষয় একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। যাঁরা মন্ত্রিসভাকে সরকারের একটি ভুল হিসেবে দেখছেন, কারও কাছে এই মন্ত্রিসভা ‘কচিকাঁচা’, কারও কাছে ‘অথর্ব’। ‘অদক্ষ লোকজনকে দিয়ে মন্ত্রিসভা করা সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল। যেসব মন্ত্রী ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের সরানোও হয়নি, জবাবদিহির কোনো ব্যাপার নেই। সব মিলিয়ে সরকার অকার্যকর হয়ে পড়েছে।’ এটা একজনের মন্তব্য।
সরকারের কিছু কিছু আচরণকে প্রতিহিংসার প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকে। এ ধরনের আচরণ সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে তাঁরা মনে করেন। অনেকের কাছে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আওয়ামী লীগের ‘সংস্কারবাদীদের’ প্রতি সরকারের আচরণকে প্রতিহিংসামূলক বলেছেন অনেকে। বলেছেন ইউনূসের কথা। ‘আইনগতভাবে ইউনূস হয়তো গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে পারেন না, কিন্তু সরকার বিষয়টি যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে, তাতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া এই ব্যক্তিটির প্রতি সরকার যে প্রতিহিংসাপরায়ণ, তা প্রকাশ পেয়েছে। বিষয়টি অনেকের কাছেই ভালো লাগেনি। প্রতিহিংসা বিষয়টি জনগণ পছন্দ করে না।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করাকে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা বলে মনে করেন অধিকাংশ লোক। তবে এই চেষ্টা যে চূড়ান্ত বিচারে কাজে দেয় না, সেটাও মানেন সবাই। ‘বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য হেন চেষ্টা নাই যে করে নাই। নানা কিছু সাজিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন সেই একই পথ ধরেছে, মনে হয় সারা জীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি যে ভুল করেছিল, আওয়ামী লীগও একই ভুল করতে যাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে।’
এসেছে শেয়ারবাজারের প্রসঙ্গ। কিন্তু শেয়ারবাজার সরকারের ‘ভুল’ হিসেবে বিবেচিত হয় কীভাবে? সরকারের এ ক্ষেত্রে করার কী ছিল? যে উত্তর পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এ রকম: সাধারণ লোকজন মনে করে যে শেয়ারবাজারের এই পরিণতি বা কেলেঙ্কারির জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁরা সরকারের কাছের লোক। সরকারের কাছের লোক বলেই তাঁরা এসব করতে পেরেছেন। সাধারণ লোকজন যাঁদের অভিযুক্ত বলে মনে করে, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এবং তাঁরা এখনো সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে রয়ে গেছেন বলেই জনমনে ধারণা।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাও সরকারের বড় ভুল বা ত্রুটি বলে মনে করেন কেউ কেউ। অভিযোগ হচ্ছে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এ ক্ষেত্রে কিছু করতে পারেনি। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বা মাত্রায় বেড়েছে, তাকে যৌক্তিক বলে মানতে চান না তাঁরা। সে কারণেই সরকারের কিছু করণীয় আছে এবং সরকার তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
একটি একক ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতা তাহেরের ছেলে বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের বিষয়টি। এই কাজটি করে আওয়ামী লীগ একটি বড় ভুল করেছে বলে মনে করেন অনেকে। ‘একটি মাত্র লোকের জন্য আওয়ামী লীগ তার ভাবমূর্তির এত বড় ক্ষতি কেন করল, তা মাথায় ঢোকেনি। এই ঘটনা দলটি সম্পর্কে অনেকের মনে বাজে ধারণার সৃষ্টি করছে।’
আগেই বলেছি, এটা কোনো তত্ত্ব বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে করা জরিপ নয়, সাধারণ লোকজনের কিছু ধারণা ও প্রতিক্রিয়া। সরকারের কাছে হয়তো এর কোনো মূল্য নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ক্ষমতার মেয়াদের মধ্যভাগে এসে দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে পরামর্শ দিচ্ছেন কেন? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতির অভাব নেই। বাকি আড়াই বছরে কোনগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব, তার কি কোনো তালিকা তৈরি করেছেন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ইচ্ছুক নেতারা? সরকারের যে ভুলগুলো চিহ্নিত করেছেন কয়েকজন, এর সঙ্গে কি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কোনো সম্পর্ক রয়েছে? নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কিছু কিছু অংশ আমরা আবার স্মরণ করে দেখতে পারি। ‘একটি প্রকৃত অংশীদারিমূলক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, দূষণমুক্ত পরিবেশ, গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র’ (আমাদের অঙ্গীকার, কর্মসূচি ও ঘোষণা)। ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে (অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয় ১.১ দ্রব্যমূল্য)। ‘জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে’ (সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ৫.৩)। ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ করা হবে’ (সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ৫.৪)।
সরকারের যে ছয়টি ‘ভুল’ উঠে এসেছে কয়েকজনের ‘জরিপে’, সেগুলোর সঙ্গে আইনের শাসন, সুশাসন, জবাবদিহি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সহিষ্ণুতা, দ্রব্যমূল্য—এসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সম্পর্ক রয়েছে। শীর্ষ নেতাদের কথা মেনে সরকার যদি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথ ধরে, তাহলে গত আড়াই বছর যেভাবে চলল, বাকি আড়াই বছরে তো তার উল্টো পথে চলতে হবে। সরকারের পক্ষে কি উল্টো পথে চলা সম্ভব?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments