পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ৩ বছর-মেজর মেহেদী ও বাকরুদ্ধ এক কন্যার করুণ কাহিনি by মাহবুবুর রহমান
তিন বছর আগে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত হয় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ও বিদ্রোহ। এতে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এই ঘটনা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে কী অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল, তা বিশ্লেষণ করেছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
তিন বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। ওই সময়ে দৈনিক মানবজমিন-এ মেজর মো. মেহেদী ফিরোজ খান মৃত্যুপুরী থেকে তাঁর অলৌকিকভাবে বেঁচে আসার কাহিনি ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি সংখ্যায় বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বিডিআর প্রশিক্ষণকেন্দ্র, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইতুল ইজ্জতে তখন প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সদর দপ্তর পিলখানায় যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, এর মারাত্মক মহাকম্পনের অভিঘাত পিলখানা থেকে বহুদূরে সুদূর খাগড়াছড়ির পাহাড়ের শিলারাশিতে অরণ্যের বৃক্ষরাজিতেও অনুভূত হয়। বাইতুল ইজ্জতে অবস্থিত বিডিআরের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণকেন্দ্র সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য একটি আদর্শ স্থান। আছে উঁচু পাহাড়, আছে গভীর খাদ, আছে অরণ্য, বৃক্ষরাজি, আছে লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন উন্মুক্ত প্রান্তর। বাইতুল ইজ্জতের এ প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্বাচন ও স্থাপনে লেখকের ব্যক্তিগত কিছু ভূমিকা ছিল। এটি ছিল রক্ষীবাহিনীর একটি পরিত্যক্ত প্রশিক্ষণ শিবির। ১৯৭৮ সালে তিনি বিডিআর পরিচালকের (অপারেশন ও প্রশিক্ষণ) দায়িত্ব পান। বিডিআরের জন্য পিলখানার বাইরে এক্সক্লুসিভ একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের অভাব তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। বাইতুল ইজ্জতের জায়গাটা তিনি সরেজমিনে রেকি করতে জিপ চালিয়ে সেখানে যান। দিন কয়েক অবস্থানও করেন। সমস্ত এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেন। তাঁর ভালো লাগে এবং মোটামুটি পরিকল্পনার একটা রূপরেখা ঠিক করে ফেলেন। তিনি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আতিকুর রহমানের (পরবর্তী সময় সেনাপ্রধান) কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন। মহাপরিচালক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে পুরো এলাকা বিডিআরের জন্য অনুমোদন নিতে সক্ষম হন।
আগেই উল্লেখ করেছি ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সময়ে মেজর মেহেদী বাইতুল ইজ্জতে কর্মরত ছিলেন। মেজর মেহেদী পেশায় নিবেদিত, সাহসী, কঠোর পরিশ্রমী সেনা কর্মকর্তা হিসেবে নাম করেছিলেন। তিনি ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু ও কৃচ্ছ্রসাধনে বিশ্বাসী এবং সেনা সদস্যদের সাধারণ কল্যাণ ও মঙ্গলে অত্যন্ত মনোযোগী। ঘাতক দল ক্ষুধিত নেকড়ের মতো হন্যে হয়ে মেজর মেহেদীকে হত্যার জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘাতকদের ঝাঁকে ঝাঁকে বর্ষিত গুলি ভাগ্যগুণে এড়িয়ে তিনতলা উঁচু এক বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে নেমে সুউচ্চ কাঁটাতারে ঘেরা সীমানাপ্রাচীর ডিঙিয়ে কোনোমতে পালাতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু ঘাতকের দল গ্রামের পর গ্রাম তাঁকে খুঁজে বেড়ায়, চিরুনি অভিযান চালায়। মেজর মেহেদী বিস্ময়করভাবে কেমন করে যেন প্রাণে বেঁচে যান। তাঁর জীবন রক্ষার এ কাহিনি একদিকে যেমন মর্মস্তুদ ও হূদয়বিদারী, অন্যদিকে তেমনি দুঃসাহসী শ্বাসরুদ্ধকর—যেন এক অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হলিউডের নামকরা সিনেমা গ্রেড এক্সেপকেও যেন হার মানায়।
মেজর মেহেদীর লেখাজুড়ে একটা করুণ আকুতি বারবার ভেসে আসে। ভেসে আসে অভিমানভরা একরাশি প্রশ্ন। কী ছিল তাঁর অপরাধ? কেন বরণ করতে হলো এমন করুণ একটি পরিণতি? তিনি তাঁর সমস্ত দেহ-মন দিয়ে বিডিআরকেই তো ভালোবেসেছিলেন। সমস্ত চেতনায় ও বিশ্বাসে বিডিআরের প্রতি নিবেদিত থেকে তার সুপ্রশিক্ষণ ও কল্যাণের জন্যই তো কাজ করছিলেন। ঠিক এমন প্রশ্ন মেজর মেহেদীর মতো, সহস্র মৃত্যু পার হয়ে আসা অনেক সেনা কর্মকর্তার। আর যাঁরা মৃত্যু-উপত্যকা লঙ্ঘন করতে পারেননি—এই একই প্রশ্ন ছিল তাঁদের আপন-স্বজনদেরও।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে নৃশংসতম নারকীয় হত্যাকাণ্ড ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহ। নির্মমভাবে অর্ধশতাধিক মেধাবী সেনা অফিসার, পেশায় দক্ষ, প্রশিক্ষিত, চৌকস, তরতাজা তরুণকে একসঙ্গে হত্যা করা হলো। নিহত হলো বিডিআরের সৈনিক, সেনাসৈনিক, হত্যা হলো বেসামরিক জনগণ, নারী ও শিশু। সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। সেনাবাহিনীও তদন্ত করেছিল। সিআইডিকেও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআইও এসেছিল। দীর্ঘদিন তদন্তকাজ চলল। দেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে তাকিয়েছিল তদন্তের ফলাফল কী দাঁড়ায়। অপরাধী বিডিআর বিদ্রোহীদের এখন বিচার চলছে। বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তিও আদালত দিচ্ছেন। কিন্তু এটা সত্য, জনগণ আজও জানে না পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খলনায়ক কারা? নেপথ্যের গডফাদারই বা কে? কোথায় তাদের আবাস? পিলখানার এ মর্মস্তুদ হূদয়বিদারক ঘটনা কারা ঘটাল? কেন ঘটাল? কী তাদের উদ্দেশ্য-অভিলাষ?
তারা কি কোনো ভিন গ্রহ বা উপগ্রহ থেকে আগত? তারা কি স্টারওয়ারের কোনো মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্রধারী দল? কোথায় তাদের শক্তির উৎস? তিন বছর অতিবাহিত, শোকের প্রলম্বিত ছায়া আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। মানুষের চোখের জলও শুকিয়ে গেছে। জীবন আবার প্রবহমান হতে হয়েছে। জীবনের তাগিদে মানুষ ব্যস্ত হয়েছে। এসবই বাস্তবতা। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হেলার। সময়ই সব বেদনার উপশম এনে দেয়। কিন্তু... না। কিছু কিছু বেদনা আছে, আছে কিছু কিছু যন্ত্রণা, যা মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। ভোলেও না। তাকে অহর্নিশ কশাঘাত করে, যাতনা দেয়, কাতর করে, দাউ দাউ করে অন্তরে আগুন জ্বালায়। আমার বাবার হত্যা, আমার মায়ের অপমান, আমার কচি বোনটির লাঞ্ছনা আমি কি ভুলতে পারি? এ যে রক্তের ঋণ। রক্ত দিয়েছি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে লাখ শহীদের কথা কি আমরা ভুলতে পারি? আজ ৪০ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গোটা জাতি সোচ্চার।
বাংলাদেশে আমাদের তদন্ত কমিটিগুলোর অতীত ইতিহাস সুখকর নয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেডে হত্যা, জিয়া হত্যা, মঞ্জুর হত্যা, রমনা বটমূল হত্যা, কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা এমনি অনেক হত্যার সত্য, নেপথ্যের নায়ক কখনোই উদ্ঘাটিত হয়নি। মানুষ আড়ালের খলনায়কদের, গডফাদারদের দৃশ্যমান দেখেনি। সব তদন্তই যেন এক জায়গায় এসে থমকে যায়। আটকে পড়ে। আর সামনে এগোতে পারে না। যেন এক চক্রব্যূহের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে, যা ভেদ করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করার শক্তি কেউ রাখে না। আমরা দেখেছি গডফাদারদের হাত অনেক শক্তিশালী, অনেক নির্মম। তাদের রক্তচক্ষুর হানা বাণ কমিটিকে স্তব্ধ করে ধরাশায়ী করেছে।
আমার মনে পড়ছে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি কোনো একসময়ে আমি ঢাকা সেনানিবাস সোনালী ব্যাংক শাখায় গিয়েছিলাম পেনশন তুলতে। তখন মাসের প্রথম সপ্তাহ, তাই অনেক লোক সমাগম ছিল ম্যানেজারের ঘরে। অনেকেই আমার বন্ধু, সহকর্মী, সবাই পরিচিত। দেখা হলো সম্প্রতি রিটায়ার্ড জনৈক কর্নেলের সঙ্গে (নামটি ইচ্ছা করেই উহ্য রাখছি)। আমি হাত বাড়িয়ে তার কুশল জিজ্ঞাস করলাম, সে উত্তর দিল না। কেমন আছ? মন খারাপ কেন? না। সে নিরুত্তর। শুধু আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আমি মনে করলাম হয়তো দায়িত্বরত অবস্থায় আমি তার কোনো ক্ষোভের কারণ হয়েছি। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কথা বলছ না কেন? তোমার কি আমার ওপর কোনো কারণে ক্ষোভ, অভিযোগ আছে? দেখলাম তার চোখ পানিতে ভিজে আসছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, আমার তো কিচ্ছু নাই, সব শেষ হয়ে গেছে।’ পাশে একটি মেয়ে সালোয়ার-কামিজ পরা মাথায় সাদা ওড়না। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমার মেয়ে, ব্যাংকে এসেছি ওরই কিছু কাজের জন্য। ওর স্বামী পিলখানায় মারা গেছে। ওরা একে খুব কষ্ট দিয়েছে আর ও তখন থেকে বোবা হয়ে গেছে।’ আমি এমনটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কী বলব, কী করব বুঝে উঠতে পারিনি। মেয়েটির মাথায় আমার ভিরু সান্ত্বনার হাতটি আস্তে করে রাখলাম। দেখলাম তার দুটি বড় বড় চোখে অবিরাম জলের ধারা। এ দৃশ্য আমার অন্তরকে দারুণভাবে দলিত-মথিত করে। কর্নেল বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাংলাদেশ কী করে হলো, স্যার? সে বলে চলল, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশের মানুষ অস্ত্র ধরেছে পিতৃহত্যার শোধ নিতে, মায়ের অসম্মান, বোনের লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে। প্রতিশোধের অদম্য স্পৃহাই তাদের যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে।
সে বলে চলল ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যা ঘটেছে, ২৫ মার্চ একাত্তরের হত্যাকাণ্ডকে তা হার মানায়, লজ্জা দেয়। পিলখানার ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি নারকীয়, অনেক বেশি মর্মন্তুদ। আমরা এর পূর্ণ তদন্ত চাই। খলনায়ক, গডফাদারদের বিচারের কাঠগড়ায় দেখতে চাই। রক্তের ঋণ রক্তে শোধ নিতে চাই। এর ফল কী হবে, ভালো না মন্দ আমরা কেয়ার করি না, স্যার। এটাই আমাদের শেষ প্রতিজ্ঞা।’ আমি তার কথা শুনে শিউরে উঠলাম। কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। তার আবেগের তীব্রতা আমাকে অনেকক্ষণের জন্য বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে স্থবির রাখল।
লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান: সাবেক সেনাপ্রধান।
আগেই উল্লেখ করেছি ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সময়ে মেজর মেহেদী বাইতুল ইজ্জতে কর্মরত ছিলেন। মেজর মেহেদী পেশায় নিবেদিত, সাহসী, কঠোর পরিশ্রমী সেনা কর্মকর্তা হিসেবে নাম করেছিলেন। তিনি ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু ও কৃচ্ছ্রসাধনে বিশ্বাসী এবং সেনা সদস্যদের সাধারণ কল্যাণ ও মঙ্গলে অত্যন্ত মনোযোগী। ঘাতক দল ক্ষুধিত নেকড়ের মতো হন্যে হয়ে মেজর মেহেদীকে হত্যার জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘাতকদের ঝাঁকে ঝাঁকে বর্ষিত গুলি ভাগ্যগুণে এড়িয়ে তিনতলা উঁচু এক বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে নেমে সুউচ্চ কাঁটাতারে ঘেরা সীমানাপ্রাচীর ডিঙিয়ে কোনোমতে পালাতে সক্ষম হন তিনি। কিন্তু ঘাতকের দল গ্রামের পর গ্রাম তাঁকে খুঁজে বেড়ায়, চিরুনি অভিযান চালায়। মেজর মেহেদী বিস্ময়করভাবে কেমন করে যেন প্রাণে বেঁচে যান। তাঁর জীবন রক্ষার এ কাহিনি একদিকে যেমন মর্মস্তুদ ও হূদয়বিদারী, অন্যদিকে তেমনি দুঃসাহসী শ্বাসরুদ্ধকর—যেন এক অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হলিউডের নামকরা সিনেমা গ্রেড এক্সেপকেও যেন হার মানায়।
মেজর মেহেদীর লেখাজুড়ে একটা করুণ আকুতি বারবার ভেসে আসে। ভেসে আসে অভিমানভরা একরাশি প্রশ্ন। কী ছিল তাঁর অপরাধ? কেন বরণ করতে হলো এমন করুণ একটি পরিণতি? তিনি তাঁর সমস্ত দেহ-মন দিয়ে বিডিআরকেই তো ভালোবেসেছিলেন। সমস্ত চেতনায় ও বিশ্বাসে বিডিআরের প্রতি নিবেদিত থেকে তার সুপ্রশিক্ষণ ও কল্যাণের জন্যই তো কাজ করছিলেন। ঠিক এমন প্রশ্ন মেজর মেহেদীর মতো, সহস্র মৃত্যু পার হয়ে আসা অনেক সেনা কর্মকর্তার। আর যাঁরা মৃত্যু-উপত্যকা লঙ্ঘন করতে পারেননি—এই একই প্রশ্ন ছিল তাঁদের আপন-স্বজনদেরও।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে নৃশংসতম নারকীয় হত্যাকাণ্ড ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহ। নির্মমভাবে অর্ধশতাধিক মেধাবী সেনা অফিসার, পেশায় দক্ষ, প্রশিক্ষিত, চৌকস, তরতাজা তরুণকে একসঙ্গে হত্যা করা হলো। নিহত হলো বিডিআরের সৈনিক, সেনাসৈনিক, হত্যা হলো বেসামরিক জনগণ, নারী ও শিশু। সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। সেনাবাহিনীও তদন্ত করেছিল। সিআইডিকেও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআইও এসেছিল। দীর্ঘদিন তদন্তকাজ চলল। দেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে তাকিয়েছিল তদন্তের ফলাফল কী দাঁড়ায়। অপরাধী বিডিআর বিদ্রোহীদের এখন বিচার চলছে। বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তিও আদালত দিচ্ছেন। কিন্তু এটা সত্য, জনগণ আজও জানে না পিলখানার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খলনায়ক কারা? নেপথ্যের গডফাদারই বা কে? কোথায় তাদের আবাস? পিলখানার এ মর্মস্তুদ হূদয়বিদারক ঘটনা কারা ঘটাল? কেন ঘটাল? কী তাদের উদ্দেশ্য-অভিলাষ?
তারা কি কোনো ভিন গ্রহ বা উপগ্রহ থেকে আগত? তারা কি স্টারওয়ারের কোনো মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্রধারী দল? কোথায় তাদের শক্তির উৎস? তিন বছর অতিবাহিত, শোকের প্রলম্বিত ছায়া আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। মানুষের চোখের জলও শুকিয়ে গেছে। জীবন আবার প্রবহমান হতে হয়েছে। জীবনের তাগিদে মানুষ ব্যস্ত হয়েছে। এসবই বাস্তবতা। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হেলার। সময়ই সব বেদনার উপশম এনে দেয়। কিন্তু... না। কিছু কিছু বেদনা আছে, আছে কিছু কিছু যন্ত্রণা, যা মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। ভোলেও না। তাকে অহর্নিশ কশাঘাত করে, যাতনা দেয়, কাতর করে, দাউ দাউ করে অন্তরে আগুন জ্বালায়। আমার বাবার হত্যা, আমার মায়ের অপমান, আমার কচি বোনটির লাঞ্ছনা আমি কি ভুলতে পারি? এ যে রক্তের ঋণ। রক্ত দিয়েছি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে লাখ শহীদের কথা কি আমরা ভুলতে পারি? আজ ৪০ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গোটা জাতি সোচ্চার।
বাংলাদেশে আমাদের তদন্ত কমিটিগুলোর অতীত ইতিহাস সুখকর নয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেডে হত্যা, জিয়া হত্যা, মঞ্জুর হত্যা, রমনা বটমূল হত্যা, কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা এমনি অনেক হত্যার সত্য, নেপথ্যের নায়ক কখনোই উদ্ঘাটিত হয়নি। মানুষ আড়ালের খলনায়কদের, গডফাদারদের দৃশ্যমান দেখেনি। সব তদন্তই যেন এক জায়গায় এসে থমকে যায়। আটকে পড়ে। আর সামনে এগোতে পারে না। যেন এক চক্রব্যূহের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে, যা ভেদ করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করার শক্তি কেউ রাখে না। আমরা দেখেছি গডফাদারদের হাত অনেক শক্তিশালী, অনেক নির্মম। তাদের রক্তচক্ষুর হানা বাণ কমিটিকে স্তব্ধ করে ধরাশায়ী করেছে।
আমার মনে পড়ছে ২০০৯ সালের মাঝামাঝি কোনো একসময়ে আমি ঢাকা সেনানিবাস সোনালী ব্যাংক শাখায় গিয়েছিলাম পেনশন তুলতে। তখন মাসের প্রথম সপ্তাহ, তাই অনেক লোক সমাগম ছিল ম্যানেজারের ঘরে। অনেকেই আমার বন্ধু, সহকর্মী, সবাই পরিচিত। দেখা হলো সম্প্রতি রিটায়ার্ড জনৈক কর্নেলের সঙ্গে (নামটি ইচ্ছা করেই উহ্য রাখছি)। আমি হাত বাড়িয়ে তার কুশল জিজ্ঞাস করলাম, সে উত্তর দিল না। কেমন আছ? মন খারাপ কেন? না। সে নিরুত্তর। শুধু আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আমি মনে করলাম হয়তো দায়িত্বরত অবস্থায় আমি তার কোনো ক্ষোভের কারণ হয়েছি। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কথা বলছ না কেন? তোমার কি আমার ওপর কোনো কারণে ক্ষোভ, অভিযোগ আছে? দেখলাম তার চোখ পানিতে ভিজে আসছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, আমার তো কিচ্ছু নাই, সব শেষ হয়ে গেছে।’ পাশে একটি মেয়ে সালোয়ার-কামিজ পরা মাথায় সাদা ওড়না। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমার মেয়ে, ব্যাংকে এসেছি ওরই কিছু কাজের জন্য। ওর স্বামী পিলখানায় মারা গেছে। ওরা একে খুব কষ্ট দিয়েছে আর ও তখন থেকে বোবা হয়ে গেছে।’ আমি এমনটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কী বলব, কী করব বুঝে উঠতে পারিনি। মেয়েটির মাথায় আমার ভিরু সান্ত্বনার হাতটি আস্তে করে রাখলাম। দেখলাম তার দুটি বড় বড় চোখে অবিরাম জলের ধারা। এ দৃশ্য আমার অন্তরকে দারুণভাবে দলিত-মথিত করে। কর্নেল বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাংলাদেশ কী করে হলো, স্যার? সে বলে চলল, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশের মানুষ অস্ত্র ধরেছে পিতৃহত্যার শোধ নিতে, মায়ের অসম্মান, বোনের লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে। প্রতিশোধের অদম্য স্পৃহাই তাদের যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে।
সে বলে চলল ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যা ঘটেছে, ২৫ মার্চ একাত্তরের হত্যাকাণ্ডকে তা হার মানায়, লজ্জা দেয়। পিলখানার ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি নারকীয়, অনেক বেশি মর্মন্তুদ। আমরা এর পূর্ণ তদন্ত চাই। খলনায়ক, গডফাদারদের বিচারের কাঠগড়ায় দেখতে চাই। রক্তের ঋণ রক্তে শোধ নিতে চাই। এর ফল কী হবে, ভালো না মন্দ আমরা কেয়ার করি না, স্যার। এটাই আমাদের শেষ প্রতিজ্ঞা।’ আমি তার কথা শুনে শিউরে উঠলাম। কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। তার আবেগের তীব্রতা আমাকে অনেকক্ষণের জন্য বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে স্থবির রাখল।
লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান: সাবেক সেনাপ্রধান।
No comments