মনের কোণে হীরে-মুক্তো-ভাষাশহীদদের হত্যাকারী শনাক্তকরণ by ড. সা'দত হুসাইন
একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি বরাবরই এক অবর্ণনীয় রোমাঞ্চ নিয়ে পরিষ্কারভাবে আমার সামনে ভেসে ওঠে। সেই ছাত্রজীবন থেকে একুশের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম। মনে পড়ে, নোয়াখালী শহরের রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী হিসেবে রাখা ইটের স্তূপ থেকে দু-একটি করে ইট হাতে বা মাথায় নিয়ে আমরা বন্ধুরা প্রতিবছরই কোর্ট চত্বরে একটি ছোট্ট শহীদ মিনার তৈরি
করতাম। নোয়াখালী শহরে তেমন ফুলের বাগান ছিল না। তাই মূলত সরকারি অফিসের বাগান থেকে গুটিকয়েক ফুল তুলে নিয়ে শহীদ মিনারে দিতাম। সারা দিন বিরুদ্ধপন্থী লোকদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে মিনারটি টিকিয়ে রাখলেও রাতের অন্ধকারে মালি, নৈশপ্রহরী এবং সরকার সমর্থক লোকরা শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলত, ২২ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের এক দিন স্থায়ী শহীদ মিনারের তেমন কোনো চিহ্ন থাকত না। সত্যি বলতে কি, আমরাও বিষয়টি এভাবেই মেনে নিতাম। এ নিয়ে কোনো তুলকালাম কাণ্ড হতো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর শহীদ দিবস অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি বিরাট তাৎপর্য এবং দ্যোতনা নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়। আমি যেহেতু ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, তাই এ দিনটি যথামর্যাদায় পালনের জন্য আমাদের সংগঠন থেকে আমরা কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি নিতাম। প্রভাতফেরি থেকে শুরু করে সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঘিরে সারা দিন ব্যস্ত থাকতাম। ক্লান্তি-শ্রান্তি নামে কিছু ছিল বলে মনে হয় না। এসব অনুষ্ঠানের রেশ একাধিক দিন ধরে চলত। এ কয়টি দিন ছিল আমাদের জীবনের বড় রকমের আনন্দঘন সময়।
একুশে উপলক্ষে যেসব ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকা বেরোত আমি গভীর অভিনিবেশ সহকারে সেগুলো পড়ে দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলা একাডেমী চত্বরে যেসব আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো সেগুলোতে উপস্থিত থাকতাম। আলোচকদের বক্তব্য শুনতাম, ভালো লাগত। অনেক তথ্য জানতে পারতাম। এসব অনুষ্ঠান এবং পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনের বক্তব্য থেকে শহীদদের বিশদ জীবনবৃত্তান্ত, যা বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হতো, জানতে পারি। ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত, এর গতি-প্রকৃতি, কৌশল সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাই। ভাষা আন্দোলনের নায়ক-মহানায়কদের পরিচয় জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে। এদের অনেককেই বাস্তবজীবনে দেখার সুযোগ হয়, কয়েকজনের কাছে আসারও সুযোগ হয়। একুশ হয়ে উঠে সত্যিকার গর্ব এবং প্রত্যয়ের দিন। আমাদের জীবনের সঙ্গে এ দিনটি তার সমগ্র মহিমা আর তাৎপর্য নিয়ে মিশে যায় অবিচ্ছেদ্যভাবে ।
ছাত্রজীবন শেষ করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষা মাত্র শেষ করেছি, এ সময় শুরু হলো ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন। সতীর্থ-স্বজন আসাদ পুলিশের গুলিতে মারা গেল। তার পর পরই মতিউর। আমরা বন্ধুরা আবার রাজপথে। আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। টালমাটাল সরকার। এমনি রক্তঝরা সময়ে পালিত হলো ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি। কত বিপ্লবী কবিতা, কত রোমাঞ্চকর কবিতা, কত অন্তর কাঁপানো গান ধ্বনিত হলো রথী-মহারথীদের গলায় তার কোনো শেষ নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি সেদিন হয়ে উঠেছিল একটি উন্মাদনার দিন। আমার মনে হয়েছিল, দেশের প্রায় সব নামিদামি সংস্কৃতিবান, সমাজদর্শী ব্যক্তির সঙ্গে আমরা একাকার হয়ে পুরো দিনটা কাটিয়েছি। জীবনের যে কয়টি সাজিয়ে রাখা অসাধারণ দিন আমার জীবনকে সংজ্ঞায়িত করে ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি যে তার একটি এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পরের বছরের একুশে ফেব্রুয়ারির চিত্র আমার কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিমধ্যে আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশে সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। রাজপথে থাকা বন্ধুদের মধ্যে আমরা তিনজন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দিয়েছি। লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমীতে অক্টোবর ১৯৬৯ থেকে আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে একাডেমী খোলা। ট্রেনিং পুরোদমে চলছে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানি সিএসপিরা এর প্রতিবাদ জানালাম এবং ঠিক করলাম যে এই দিন আমরা ড্রেস কোড মানব না। আমাদের পোশাকে আমরা কালোব্যাজ ধারণ করব। তাই করা হলো। একাডেমী কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কোনো তোলপাড় করেনি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। একাডেমীর উপপরিচালক ড. তারেক সিদ্দিকি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, এরূপ নমনীয়তা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে হয়তো তাঁর অবদান থাকতে পারে ।
স্বাধীনতার পর প্রতিবছর যথামর্যাদায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে। প্রায় দুই দশক যাওয়ার পর আমরা হৃদয়ঙ্গম করলাম যে বিশ্বাস, প্রত্যয়, সংগ্রাম এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বা শহীদ দিবস অর্জিত হয়েছে তার তুলনা বিশ্বে বিরল। পৃথিবীতে এর চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বা কম মর্যাদাপূর্ণ দিন আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ঘটা করে পালিত হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিতে হবে, ইউনেসকোতে এ দাবি তোলা হলো। বহু বিতর্ক-আলোচনার পর ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে চূড়ান্ত স্বীকৃতির লক্ষ্যে এ দাবি ইউনেসকোর সাধারণ অধিবেশনে উপস্থাপন করা হলো। আল্লাহর অসীম রহমতে ১৭ নভেম্বরের এই চূড়ান্ত অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি আমি। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেল। এটি আমার জীবনে এক দুর্লভ গৌরব বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে তথ্য এবং ইতিহাসের যাতে বিকৃতি না ঘটতে পারে সে জন্য দেশে ফিরেই ঘটনার বিশদ বিবরণ বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করেছি। পরের বছরগুলোতেও এ বিবরণ অনেকবার প্রকাশিত হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও যে তথ্যটি আমার চোখে পড়েনি (ভুল হলে মাফ করে আমাকে তথ্যাদি সরবরাহ করবেন) তা হলো, ভাষাশহীদদের কে বা কারা হত্যা করেছিল। তাঁদের গায়ে গুলি ছুড়েছিল পুলিশ বা ইপিআরের কোন জওয়ান বা কর্মকর্তা? তার বা তাদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় কী? ঠিকানা কী? গুলিবর্ষণের পর নিশ্চয়ই অন্ততপক্ষে একটি নির্বাহী বিভাগীয় তদন্ত হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে গুলিবর্ষণকে যথার্থ কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গুলিবর্ষণকারীকে দায়মুক্ত করা হয়েছিল। সেসব রেকর্ড তো থাকার কথা। কিন্তু আমরা তা কখনো দেখেছি বা পর্যালোচনা করেছি কি? আমার জানা মতে, এ ব্যাপারে প্রামাণ্য তথ্যগুলো এখনো সংগৃহীত হয়নি। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব (পরবর্তী সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা) ফখরুদ্দিন আহমেদ গুলিবর্ষণের সময় অকুস্থলে অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে উপস্থিত ছিলেন। বরকত তাঁর সঙ্গেই বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। গুলিবর্ষণের মাত্র কয়েক মিনিট আগে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ 'ক্রিটিকাল টাইমস'-এ ফখরুদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, একুশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক মামলা হয়েছিল, এর অধিকাংশই ছাত্রদের আসামি করে। মামলা উপলক্ষে তারা তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা এবং আইনজীবীদের কাছে একাধিকবার যাওয়া-আসা করেছেন। বিরোধীদলীয় আইনজীবীরা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে ছাত্রদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট সালাম খান তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমেদকে প্রধান আসামি করে একটি ফৌজদারি মামলা করেছিলেন। কিন্তু নিম্ন-আদালতে অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে সে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। সাধারণ প্রচেষ্টায় ম্যাজিস্ট্রেটের নাম-পরিচয় জানতে পারিনি। সালাম খান হাইকোর্টে আপিল দায়ের করার প্রস্তুতি নিলেও সে আপিল মামলা সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি। স্বাভাবিকভাবে আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, এই ম্যাজিস্ট্রেটের নাম-ঠিকানা কী? তাঁর পরিচয় কী? পরবর্তীকালে তিনি কোথায় কী পদে চাকরি করেছেন। সে ম্যাজিস্ট্রেটকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, কিন্তু ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এসব তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের এদিকটার অনেকটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস।
আসলে গণ-আন্দোলনের নায়ক-মহানায়কদের সম্পর্কে আমরা অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাদের জয়গান গেয়ে আসর মাতিয়েছি, নিজেদের জন্য প্রসিদ্ধি কুড়িয়েছি। কিন্তু গণ-আন্দোলনের বিপরীত স্রোতে থাকা গণদ্রোহী খলনায়কদের সম্পর্কে তথ্যাদি আন্তরিকতার সঙ্গে সংগ্রহ করা হয়নি (একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া)। ফলে এসব খলনায়ক বা তাদের দোসরদের সম্পর্কে দেশের মানুষ অন্ধকারে রয়ে গেছে। এদের থেকে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের খলনায়করা অনেকেই ইতিমধ্যে মারা গেছে। নায়ক-মহানায়ক এবং প্রত্যক্ষদর্শীরাও বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু খলনায়কদের তথ্য এবং কার্যাবলি এখনো তাদের স্মৃতিতে আছে। অবিলম্বে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব অপকর্মের মূল তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু করা হোক। এ কাজ সম্পন্ন হতে হয়তো সময় লাগবে; কিন্তু একবার শুরু হলে অচিরেই অনেক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর শহীদ দিবস অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি বিরাট তাৎপর্য এবং দ্যোতনা নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়। আমি যেহেতু ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, তাই এ দিনটি যথামর্যাদায় পালনের জন্য আমাদের সংগঠন থেকে আমরা কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি নিতাম। প্রভাতফেরি থেকে শুরু করে সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ঘিরে সারা দিন ব্যস্ত থাকতাম। ক্লান্তি-শ্রান্তি নামে কিছু ছিল বলে মনে হয় না। এসব অনুষ্ঠানের রেশ একাধিক দিন ধরে চলত। এ কয়টি দিন ছিল আমাদের জীবনের বড় রকমের আনন্দঘন সময়।
একুশে উপলক্ষে যেসব ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকা বেরোত আমি গভীর অভিনিবেশ সহকারে সেগুলো পড়ে দেখতাম। বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলা একাডেমী চত্বরে যেসব আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো সেগুলোতে উপস্থিত থাকতাম। আলোচকদের বক্তব্য শুনতাম, ভালো লাগত। অনেক তথ্য জানতে পারতাম। এসব অনুষ্ঠান এবং পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনের বক্তব্য থেকে শহীদদের বিশদ জীবনবৃত্তান্ত, যা বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হতো, জানতে পারি। ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত, এর গতি-প্রকৃতি, কৌশল সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাই। ভাষা আন্দোলনের নায়ক-মহানায়কদের পরিচয় জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে। এদের অনেককেই বাস্তবজীবনে দেখার সুযোগ হয়, কয়েকজনের কাছে আসারও সুযোগ হয়। একুশ হয়ে উঠে সত্যিকার গর্ব এবং প্রত্যয়ের দিন। আমাদের জীবনের সঙ্গে এ দিনটি তার সমগ্র মহিমা আর তাৎপর্য নিয়ে মিশে যায় অবিচ্ছেদ্যভাবে ।
ছাত্রজীবন শেষ করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষা মাত্র শেষ করেছি, এ সময় শুরু হলো ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন। সতীর্থ-স্বজন আসাদ পুলিশের গুলিতে মারা গেল। তার পর পরই মতিউর। আমরা বন্ধুরা আবার রাজপথে। আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। টালমাটাল সরকার। এমনি রক্তঝরা সময়ে পালিত হলো ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি। কত বিপ্লবী কবিতা, কত রোমাঞ্চকর কবিতা, কত অন্তর কাঁপানো গান ধ্বনিত হলো রথী-মহারথীদের গলায় তার কোনো শেষ নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি সেদিন হয়ে উঠেছিল একটি উন্মাদনার দিন। আমার মনে হয়েছিল, দেশের প্রায় সব নামিদামি সংস্কৃতিবান, সমাজদর্শী ব্যক্তির সঙ্গে আমরা একাকার হয়ে পুরো দিনটা কাটিয়েছি। জীবনের যে কয়টি সাজিয়ে রাখা অসাধারণ দিন আমার জীবনকে সংজ্ঞায়িত করে ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি যে তার একটি এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পরের বছরের একুশে ফেব্রুয়ারির চিত্র আমার কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিমধ্যে আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশে সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। রাজপথে থাকা বন্ধুদের মধ্যে আমরা তিনজন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দিয়েছি। লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমীতে অক্টোবর ১৯৬৯ থেকে আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে একাডেমী খোলা। ট্রেনিং পুরোদমে চলছে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানি সিএসপিরা এর প্রতিবাদ জানালাম এবং ঠিক করলাম যে এই দিন আমরা ড্রেস কোড মানব না। আমাদের পোশাকে আমরা কালোব্যাজ ধারণ করব। তাই করা হলো। একাডেমী কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কোনো তোলপাড় করেনি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। একাডেমীর উপপরিচালক ড. তারেক সিদ্দিকি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, এরূপ নমনীয়তা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে হয়তো তাঁর অবদান থাকতে পারে ।
স্বাধীনতার পর প্রতিবছর যথামর্যাদায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে। প্রায় দুই দশক যাওয়ার পর আমরা হৃদয়ঙ্গম করলাম যে বিশ্বাস, প্রত্যয়, সংগ্রাম এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বা শহীদ দিবস অর্জিত হয়েছে তার তুলনা বিশ্বে বিরল। পৃথিবীতে এর চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বা কম মর্যাদাপূর্ণ দিন আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ঘটা করে পালিত হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিতে হবে, ইউনেসকোতে এ দাবি তোলা হলো। বহু বিতর্ক-আলোচনার পর ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে চূড়ান্ত স্বীকৃতির লক্ষ্যে এ দাবি ইউনেসকোর সাধারণ অধিবেশনে উপস্থাপন করা হলো। আল্লাহর অসীম রহমতে ১৭ নভেম্বরের এই চূড়ান্ত অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি আমি। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেল। এটি আমার জীবনে এক দুর্লভ গৌরব বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে তথ্য এবং ইতিহাসের যাতে বিকৃতি না ঘটতে পারে সে জন্য দেশে ফিরেই ঘটনার বিশদ বিবরণ বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করেছি। পরের বছরগুলোতেও এ বিবরণ অনেকবার প্রকাশিত হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও যে তথ্যটি আমার চোখে পড়েনি (ভুল হলে মাফ করে আমাকে তথ্যাদি সরবরাহ করবেন) তা হলো, ভাষাশহীদদের কে বা কারা হত্যা করেছিল। তাঁদের গায়ে গুলি ছুড়েছিল পুলিশ বা ইপিআরের কোন জওয়ান বা কর্মকর্তা? তার বা তাদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় কী? ঠিকানা কী? গুলিবর্ষণের পর নিশ্চয়ই অন্ততপক্ষে একটি নির্বাহী বিভাগীয় তদন্ত হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে গুলিবর্ষণকে যথার্থ কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গুলিবর্ষণকারীকে দায়মুক্ত করা হয়েছিল। সেসব রেকর্ড তো থাকার কথা। কিন্তু আমরা তা কখনো দেখেছি বা পর্যালোচনা করেছি কি? আমার জানা মতে, এ ব্যাপারে প্রামাণ্য তথ্যগুলো এখনো সংগৃহীত হয়নি। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব (পরবর্তী সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা) ফখরুদ্দিন আহমেদ গুলিবর্ষণের সময় অকুস্থলে অর্থাৎ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে উপস্থিত ছিলেন। বরকত তাঁর সঙ্গেই বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। গুলিবর্ষণের মাত্র কয়েক মিনিট আগে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ 'ক্রিটিকাল টাইমস'-এ ফখরুদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, একুশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক মামলা হয়েছিল, এর অধিকাংশই ছাত্রদের আসামি করে। মামলা উপলক্ষে তারা তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা এবং আইনজীবীদের কাছে একাধিকবার যাওয়া-আসা করেছেন। বিরোধীদলীয় আইনজীবীরা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে ছাত্রদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট সালাম খান তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমেদকে প্রধান আসামি করে একটি ফৌজদারি মামলা করেছিলেন। কিন্তু নিম্ন-আদালতে অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে সে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। সাধারণ প্রচেষ্টায় ম্যাজিস্ট্রেটের নাম-পরিচয় জানতে পারিনি। সালাম খান হাইকোর্টে আপিল দায়ের করার প্রস্তুতি নিলেও সে আপিল মামলা সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি। স্বাভাবিকভাবে আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, এই ম্যাজিস্ট্রেটের নাম-ঠিকানা কী? তাঁর পরিচয় কী? পরবর্তীকালে তিনি কোথায় কী পদে চাকরি করেছেন। সে ম্যাজিস্ট্রেটকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, কিন্তু ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এসব তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের এদিকটার অনেকটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস।
আসলে গণ-আন্দোলনের নায়ক-মহানায়কদের সম্পর্কে আমরা অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাদের জয়গান গেয়ে আসর মাতিয়েছি, নিজেদের জন্য প্রসিদ্ধি কুড়িয়েছি। কিন্তু গণ-আন্দোলনের বিপরীত স্রোতে থাকা গণদ্রোহী খলনায়কদের সম্পর্কে তথ্যাদি আন্তরিকতার সঙ্গে সংগ্রহ করা হয়নি (একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া)। ফলে এসব খলনায়ক বা তাদের দোসরদের সম্পর্কে দেশের মানুষ অন্ধকারে রয়ে গেছে। এদের থেকে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের খলনায়করা অনেকেই ইতিমধ্যে মারা গেছে। নায়ক-মহানায়ক এবং প্রত্যক্ষদর্শীরাও বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু খলনায়কদের তথ্য এবং কার্যাবলি এখনো তাদের স্মৃতিতে আছে। অবিলম্বে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব অপকর্মের মূল তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু করা হোক। এ কাজ সম্পন্ন হতে হয়তো সময় লাগবে; কিন্তু একবার শুরু হলে অচিরেই অনেক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments