দ্রব্যমূল্য-সংযম_ জীবনে ও বাজারে by এসএম নাজের হোসাইন
আসুন কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা কেনা ও মজুদের জন্য হন্যে হয়ে না পড়ে খোঁজখবর নিই। প্রয়োজনে বিকল্প হিসেবে অন্য পণ্য কিনি এবং ওই পণ্যটি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হই। এ ছাড়াও যেসব উৎপাদক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী তিনি পাইকারি ও খুচরা হোক না কেন, যারাই ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে কৃত্রিমভাবে পণ্য কেনাবেচায় সংকট তৈরি করছে তাদের
বয়কট করি পবিত্র রমজান, ঈদ, পূজা-পার্বণ এলেই আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনে অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করে থাকেন। রমজান সামনে রেখে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটে। এসব ব্যবসায়ী রমজান উপলক্ষে চিনি, ছোলা, ডাল, চাল, সয়াবিন, খেজুর, পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদি পণ্যের পসরা সাজিয়ে থাকেন। অনেকে আবার ডিও ব্যবসার মতো পণ্যদ্রব্যের আমদানি ও বাজারজাত করে থাকেন। জানা যায়, এসব ব্যবসায়ী বলে থাকেন, রমজানে এক মাস ব্যবসা করব, সারা বছর আরামে কাটাব। পবিত্র রমজান মাস মুসলিম বিশ্বের জন্য আল্লাহর দান এবং এটি সংযম ও নাজাতের মাস, যা পাপমুক্তির মাস হলেও এসব মৌসুমি ব্যবসায়ী নামধারী মূল্য সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যের কারণে জনজীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস দেখলে জানা যায়, পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রমজানের ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী, পবিত্র বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে পণ্যসামগ্রীর বাজারে মূল্যহ্রাস প্রথা চালু আছে। কিন্তু তার বিপরীতে আমাদের দেশে পরিস্থিতি উল্টো। রমজান, ঈদ বা পূজা এলেই আমাদের দেশের খুচরা থেকে মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কাটার উৎসবে মাতোয়ারা হন। ফলে জনজীবনে ওঠে নাভিশ্বাস।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেই আমরা প্রায়শ সরকারকে দোষারোপ করে থাকি। এটি ঠিক যে, সরকারের যথাযথ মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগ আর দ্রব্যমূল্য মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত আমলাদের খামখেয়ালির কারণে কিছু মুনাফাখোর, মজুদদার, সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজণীয় দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল হয়। এক শ্রেণীর নীতি-আদর্শহীন, অতি মুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ীদের কোটিপতি হওয়ার বাসনা তাদের ইচ্ছামতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করে ও দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অচল করে দেয়। যার ফলে সাধারণ মানুষের জন্য জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন ও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ালেও ওই পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য কমলেও তারা আর কমায় না। আর যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে তা কিনতে। দাম বাড়ার গুজবে নিজেরাই ওই পণ্য মজুদে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। আমাদের সবার জানা, বিগত বছর ভারতে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি হলে সারা ভারতে ভোক্তারা পেঁয়াজ কেনায় সাশ্রয়ী হয়ে ওঠেন এবং বিকল্প ব্যবহার শুরু করেন। ফলে এক পর্যায়ে ভারতে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি স্তিমিত হয়ে যায়। পরে পেঁয়াজের মূল্য এত কমে যায় যে, অনেক ব্যবসায়ী পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অনেককে লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু একজন সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা সবসময় আমাদের অধিকারের কথা বলি। অধিকার ভোগ করতে গিয়ে আমাদের ওপর যে দায়িত্বগুলো বর্তায় তা কিন্তু একেবারেই ভুলে যাই। একজন ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলো হলো_ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার। ঠিক একই সঙ্গে আমাদের রয়েছে ৫টি দায়িত্ব। এগুলো হলো_ পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হওয়া, দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করা, আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া, ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হওয়া। উপরোক্ত বিষয়গুলো জাতিসংঘ স্বীকৃত ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব হলেও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়তই এবং প্রতি পদে এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর দায়িত্ব সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক দাতাগোষ্ঠী দুর্নীতি হ্রাস, সুশাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরব থাকলেও জনগণের নিত্যদিনের এ অধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এই ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে মানবাধিকার সুরক্ষার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো_ আমরা কি আমাদের অধিকার ও দায়িত্বগুলো সম্পর্কে সচেতন ও জ্ঞাত? যদি তাই হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে থাকে, তাহলে ভোক্তা হিসেবে আমরা কেন তাদের সেই ফাঁদে পা দেব? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তারাই পণ্যের নিয়ামক। কারণ ভোক্তারা পণ্যটি ব্যবহার করলেই উৎপাদক ও বিক্রেতারা লাভবান হবেন। সে কারণে উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তাদের সম্রাট উপাধি প্রদান করা হয়। আর আমরা অনেকেই জানি, বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা গার্মেন্ট পণ্য ক্রয়ের সময় ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা গার্মেন্ট পণ্যটি স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রস্তুত কি-না তা সরেজমিন দেখার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ক্রেতাদের সরেজমিন পরিদর্শনের পর আস্থা অর্জিত হলেই বিক্রেতারা পণ্যগুলো বাজারজাত করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি তার উল্টো। ব্যবসায়ীরা একদিকে যেমন পণ্যদ্রব্যের মূল্য বেশি নিয়ে সাধারণ জনগণের পকেট কাটছে, অন্যদিকে দুধ ও মাছে ফরমালিন, ইউরিয়া, ফলমূলে কার্বাইডসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে এবং এগুলো তাজা রাখার জন্য ব্যবহার করছে সালফার, ইথেন। শাক-সবজি তাজা রাখার জন্য ব্যবহার করছে হরেক রকমের কেমিক্যাল। নষ্ট চানাবুট ভালো চানাবুটের সঙ্গে ও পচা চাল ভালো চালের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করছে। বিভিন্ন গুঁড়া মসলায় ইটের গুঁড়াসহ বিভিন্ন ক্ষতকর দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করছে। সরিষার তেলে মিশাচ্ছে সাইট্রিক এসিড। একই সঙ্গে শিঙ্গাড়া, সমুচা তৈরিতে সয়াবিনের সঙ্গে দিচ্ছে পোড়া মবিল। ভোক্তা হিসেবে এগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আসুন একসঙ্গে এক মাসের বাজার না কিনে সপ্তাহে সপ্তাহে কিনি। পণ্য ক্রয় করার সময় যাচাই-বাছাই করে কিনি। কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা কেনা ও মজুদের জন্য হন্যে হয়ে না পড়ে খোঁজখবর নিই। প্রয়োজনে বিকল্প হিসেবে অন্য পণ্য কিনি এবং ওই পণ্যটি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হই। এ ছাড়াও যেসব উৎপাদক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী তিনি পাইকারি ও খুচরা হোক না কেন, যারাই ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে কৃত্রিমভাবে পণ্য কেনাবেচায় সংকট তৈরি করছে তাদের বয়কট করি। বিদেশি আমদানি করা পণ্য ব্যবহার বাদ দিয়ে দেশীয় পণ্য কিনি। আমদানি করা পণ্যের বাহারি বিজ্ঞাপনে সাড়া না দিয়ে স্থানীয় পণ্য ব্যবহার করি। দেশকে অন্যের পণ্যের বাজারে ও তাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে উদ্ধার করি। তাই আসুন, মুনাফাখোর, মজুদদার, সিন্ডিকেট, ভেজাল, নিম্নমান ও মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়া দুধ, শিশুখাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানি, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে জড়িত অসৎ ব্যবসায়ী ও এ ধরনের মানববিধ্বংসী কাজে জড়িত ভেজাল মিশ্রণকারী, অসাধু ব্যবসায়ী ও তাদের দোসরদের বাজারজাতকৃত পণ্য ও তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করি। আর ভোক্তা হিসেবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হই।
এসএম নাজের হোসাইন : কেন্দ্রীয় কার্যকরী পর্ষদ সদস্য, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেই আমরা প্রায়শ সরকারকে দোষারোপ করে থাকি। এটি ঠিক যে, সরকারের যথাযথ মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগ আর দ্রব্যমূল্য মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত আমলাদের খামখেয়ালির কারণে কিছু মুনাফাখোর, মজুদদার, সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজণীয় দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল হয়। এক শ্রেণীর নীতি-আদর্শহীন, অতি মুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ীদের কোটিপতি হওয়ার বাসনা তাদের ইচ্ছামতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করে ও দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অচল করে দেয়। যার ফলে সাধারণ মানুষের জন্য জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন ও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ালেও ওই পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য কমলেও তারা আর কমায় না। আর যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে তা কিনতে। দাম বাড়ার গুজবে নিজেরাই ওই পণ্য মজুদে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। আমাদের সবার জানা, বিগত বছর ভারতে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি হলে সারা ভারতে ভোক্তারা পেঁয়াজ কেনায় সাশ্রয়ী হয়ে ওঠেন এবং বিকল্প ব্যবহার শুরু করেন। ফলে এক পর্যায়ে ভারতে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি স্তিমিত হয়ে যায়। পরে পেঁয়াজের মূল্য এত কমে যায় যে, অনেক ব্যবসায়ী পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অনেককে লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু একজন সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা সবসময় আমাদের অধিকারের কথা বলি। অধিকার ভোগ করতে গিয়ে আমাদের ওপর যে দায়িত্বগুলো বর্তায় তা কিন্তু একেবারেই ভুলে যাই। একজন ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলো হলো_ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার। ঠিক একই সঙ্গে আমাদের রয়েছে ৫টি দায়িত্ব। এগুলো হলো_ পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হওয়া, দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করা, আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া, ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হওয়া। উপরোক্ত বিষয়গুলো জাতিসংঘ স্বীকৃত ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব হলেও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়তই এবং প্রতি পদে এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর দায়িত্ব সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক দাতাগোষ্ঠী দুর্নীতি হ্রাস, সুশাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরব থাকলেও জনগণের নিত্যদিনের এ অধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এই ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে মানবাধিকার সুরক্ষার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো_ আমরা কি আমাদের অধিকার ও দায়িত্বগুলো সম্পর্কে সচেতন ও জ্ঞাত? যদি তাই হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে থাকে, তাহলে ভোক্তা হিসেবে আমরা কেন তাদের সেই ফাঁদে পা দেব? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তারাই পণ্যের নিয়ামক। কারণ ভোক্তারা পণ্যটি ব্যবহার করলেই উৎপাদক ও বিক্রেতারা লাভবান হবেন। সে কারণে উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তাদের সম্রাট উপাধি প্রদান করা হয়। আর আমরা অনেকেই জানি, বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা গার্মেন্ট পণ্য ক্রয়ের সময় ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা গার্মেন্ট পণ্যটি স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে প্রস্তুত কি-না তা সরেজমিন দেখার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ক্রেতাদের সরেজমিন পরিদর্শনের পর আস্থা অর্জিত হলেই বিক্রেতারা পণ্যগুলো বাজারজাত করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি তার উল্টো। ব্যবসায়ীরা একদিকে যেমন পণ্যদ্রব্যের মূল্য বেশি নিয়ে সাধারণ জনগণের পকেট কাটছে, অন্যদিকে দুধ ও মাছে ফরমালিন, ইউরিয়া, ফলমূলে কার্বাইডসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে কৃত্রিমভাবে পাকিয়ে এবং এগুলো তাজা রাখার জন্য ব্যবহার করছে সালফার, ইথেন। শাক-সবজি তাজা রাখার জন্য ব্যবহার করছে হরেক রকমের কেমিক্যাল। নষ্ট চানাবুট ভালো চানাবুটের সঙ্গে ও পচা চাল ভালো চালের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করছে। বিভিন্ন গুঁড়া মসলায় ইটের গুঁড়াসহ বিভিন্ন ক্ষতকর দ্রব্য মিশিয়ে বিক্রি করছে। সরিষার তেলে মিশাচ্ছে সাইট্রিক এসিড। একই সঙ্গে শিঙ্গাড়া, সমুচা তৈরিতে সয়াবিনের সঙ্গে দিচ্ছে পোড়া মবিল। ভোক্তা হিসেবে এগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আসুন একসঙ্গে এক মাসের বাজার না কিনে সপ্তাহে সপ্তাহে কিনি। পণ্য ক্রয় করার সময় যাচাই-বাছাই করে কিনি। কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা কেনা ও মজুদের জন্য হন্যে হয়ে না পড়ে খোঁজখবর নিই। প্রয়োজনে বিকল্প হিসেবে অন্য পণ্য কিনি এবং ওই পণ্যটি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হই। এ ছাড়াও যেসব উৎপাদক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী তিনি পাইকারি ও খুচরা হোক না কেন, যারাই ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে কৃত্রিমভাবে পণ্য কেনাবেচায় সংকট তৈরি করছে তাদের বয়কট করি। বিদেশি আমদানি করা পণ্য ব্যবহার বাদ দিয়ে দেশীয় পণ্য কিনি। আমদানি করা পণ্যের বাহারি বিজ্ঞাপনে সাড়া না দিয়ে স্থানীয় পণ্য ব্যবহার করি। দেশকে অন্যের পণ্যের বাজারে ও তাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে উদ্ধার করি। তাই আসুন, মুনাফাখোর, মজুদদার, সিন্ডিকেট, ভেজাল, নিম্নমান ও মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়া দুধ, শিশুখাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানি, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে জড়িত অসৎ ব্যবসায়ী ও এ ধরনের মানববিধ্বংসী কাজে জড়িত ভেজাল মিশ্রণকারী, অসাধু ব্যবসায়ী ও তাদের দোসরদের বাজারজাতকৃত পণ্য ও তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করি। আর ভোক্তা হিসেবে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হই।
এসএম নাজের হোসাইন : কেন্দ্রীয় কার্যকরী পর্ষদ সদস্য, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
No comments