সম্প্রচার নীতিমালা-আমরা কি ফিরছি হীরক রাজার যুগে? by রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
রাজা দেবতুল্য। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা মহা অপরাধ। সমালোচনা করলে পেতে হবে মহা শাস্তি। এমনটাই ছিল প্রাচীন যুগে রাজদরবারের বিধান। হীরক রাজার দেশে চালু ছিল এমন আইন। রাজার সমালোচক যারা হতে পারে বলে মনে হতো তাদের অঙ্কুরেই শেষ করে দেওয়া হতো। বন্ধ করে দেওয়া হতো লেখাপড়া।
মগজ ধোলাই করে রাজার শেখানো মন্ত্র বলতে বাধ্য করা হতো। বলা হতো, ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।’
আগের যুগে জনগণ কিছুই জানতে পারত না। জানলেও বলতে পারত না। বলতে চাইলে দরবারে এসে বলত, ‘মহারাজ, ভয়ে বলব না নির্ভয়ে?’ এখন কিন্তু এমনটা আর হয় না, যদিও ব্রিটিশ শাসকেরা ১৯২৩ সালে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন করেছিল। আইনে ছিল, সরকারের ভেতরের কোনো খবর প্রকাশ করা যাবে না। এমন আইন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অনেক দেশে প্রচলিত ছিল। ফলে জনগণ শাসকদের দুঃশাসনের কথা, লুটপাট ও দুর্নীতির কথা জানতে পারত না। বলাও ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বর্তমান যুগে এমন আইন বা বিধান প্রয়োগ করা অসম্ভব ব্যাপার।
জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে মানুষের জানার আর বলার অধিকারকে দিয়েছে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। ফলে আমাদের দেশেও তথ্য অধিকার আইনপাস করা হয়েছে। আইনটি পাস করার জন্য আমরা দাবি করেছিলাম, যাতে সমাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। আর বলার অধিকার ও চিন্তার স্বাধীনতা সংবিধানের ৩৯ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে। এ অধিকার হরণ করা মানে সংবিধান লঙ্ঘন।
আজ যাঁরা আমাদের শাসক, তাঁরাই যখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, তখন এসব দাবির পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। দুর্ভাগ্য আমাদের, তাঁরাই ক্ষমতায় বসে নিজেদের ওয়াদা আর দাবির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন বলে মনে হয়। তাই আজ যখন তাঁরা সমালোচিত হচ্ছেন তাঁদের ব্যর্থতার জন্য, তখন নানাভাবে মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ করার চেষ্টা করছেন। আরোপ করতে চাইছেন গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা।
এরই অংশ হিসেবে অতীতে বিশেষ ক্ষমতা আইন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করা হয়। খবরের কাগজের প্রকাশনা বন্ধ করার ক্ষমতা ছিল সরকারের হাতে। বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায়, তাঁরাও এ আইন বাতিল সমর্থন করেছিলেন, যদিও তাঁদেরই পূর্বসূরিরা এ আইন প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। আইনটি বাতিল করা হয় এরশাদের পতনের পর। কিন্তু শাসকেরা যখনই সমালোচিত হন তাঁদের ব্যর্থতার জন্য, দুর্নীতির জন্য, তখনই গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার উদ্যোগ নেন। এমনই একটি উদ্যোগ নিয়ে বর্তমানে আলোচনা চলছে। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারি সম্প্রচার নীতিমালা নামে একটি খসড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কমিটি সেটি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। খসড়া নীতিমালাটি মানবজমিন পত্রিকায় যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
কোনো আলোচনামূলক অনুষ্ঠান, কোনো প্রকার অসংগতিপূর্ণ বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বা উপাত্ত দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টেলিভিশন বা রেডিও বা অনুষ্ঠান পরিচালক জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। জাতীয় আদর্শ বা উদ্দেশ্যের প্রতি কোনো প্রকার ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ, বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ অথবা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অখণ্ডতা বা সংহতি ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন প্রবণতা-সম্পর্কিত কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন করতে পারে এমন ধরনের সামরিক বা সরকারি কোনো তথ্য ফাঁস করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হয় এমন অনুষ্ঠানও প্রচার করা যাবে না। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে কোনো ধরনের প্রচারণা, যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের বিরোধের কোনো একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে; কিংবা একটি বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচারণা, যার ফলে সেই রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, এমন অনুষ্ঠানও করা যাবে না। দেখানো যাবে না কোনো জনগোষ্ঠী, জাতি বা দেশের মর্যাদা বা ইতিহাসের ঘটনা বা দৃশ্যবিন্যাস।
জাতির পিতার প্রতি কোনো প্রকার অবজ্ঞা বা অসম্মান করা যাবে না। সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামতও প্রচার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, বিদেশি কূটনীতিক ও জাতীয় বীরদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ওয়াজ মাহফিল, ওরস, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি ধর্মবিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত অনুষ্ঠান, যেমন—রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানের ভাষণ, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা বা প্রেসনোট, জরুরি আবহাওয়া বা স্বাস্থ্যবার্তা এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করতে হবে। সব ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। কোনো জাতি, ধর্মসম্প্রদায় বা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি কোনোরূপ অবমাননা বা শ্লেষ, কটাক্ষ বা সমালোচনা করা যাবে না। সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করতে হবে। দেশি ও বিদেশি ছবি বা অনুষ্ঠানে অশ্লীল চুম্বনের দৃশ্য সর্বতোভাবে পরিহার করতে হবে। হিংসাত্মক, সন্ত্রাসমূলক এবং দেশীয় সংস্কৃতির মূল্যবোধের পরিপন্থী কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। বেসরকারি সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে পরিবেশিত অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে ১৯৬৩ সালের ফিল্ম সেন্সরশিপ অ্যাক্টের অধীনে প্রণীত বিধি বা নীতিমালা অনুযায়ী কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, উল্লেখ না থাকা সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তথ্য মন্ত্রণালয়। রেডিও ও টিভি চ্যানেলকে নিজ দায়িত্বে বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত ছাড়পত্র প্রদান করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন নীতিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করা না হলে তথ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
খসড়া নীতিমালায় যা আছে তা বাস্তবায়িত হলে আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। খসড়ায় যেসব বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে তা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। চালানোর চেষ্টা করা হলে তা প্রতিহত হবে। আবার এর মধ্যে অনেকগুলো বিষয় আছে, যা সাংবাদিকতার নীতিমালার অঙ্গ। আবার অনেকগুলো বিধান সংবিধানের ৩৯ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে। এগুলো নীতিমালার মধ্যে আনার কোনো অর্থ হয় না।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা আজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছি। স্বৈরশাসনের দিন আবার ফিরে আসবে, এটা ভাবা যায় না। দুই বছরের সেনা-সমর্থিত শাসনামলেও এমন একটা নীতিমালার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের ও বাকস্বাধীনতার রক্ষক বলে দাবি করে। তাদের কাছ থেকে এমন বাধানিষেধযুক্ত নীতিমালা আমরা আশা করি না। যে নীতিমালার কথা আমরা বলেছিলাম তা হলো, কীভাবে এবং কারা টেলিভিশন-রেডিওর লাইসেন্স পাবেন। বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এমন নীতিমালা আমরা চাই যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, স্বাধীন নীতির ভিত্তিতে যে কেউ লাইসেন্স পেতে পারেন। এমন নীতিমালা চাই যাতে থাকবে স্বাধীনতা, আর সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা। একটা কথা ভুললে চলবে না, হীরক রাজাদের দিন শেষ, এখন দিন গণমানুষের আর মুক্তচিন্তার। হীরক রাজার যুুগে আর ফেরা যাবে না।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: সম্পাদক, নিউজ টুডে।
আগের যুগে জনগণ কিছুই জানতে পারত না। জানলেও বলতে পারত না। বলতে চাইলে দরবারে এসে বলত, ‘মহারাজ, ভয়ে বলব না নির্ভয়ে?’ এখন কিন্তু এমনটা আর হয় না, যদিও ব্রিটিশ শাসকেরা ১৯২৩ সালে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন করেছিল। আইনে ছিল, সরকারের ভেতরের কোনো খবর প্রকাশ করা যাবে না। এমন আইন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অনেক দেশে প্রচলিত ছিল। ফলে জনগণ শাসকদের দুঃশাসনের কথা, লুটপাট ও দুর্নীতির কথা জানতে পারত না। বলাও ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বর্তমান যুগে এমন আইন বা বিধান প্রয়োগ করা অসম্ভব ব্যাপার।
জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে মানুষের জানার আর বলার অধিকারকে দিয়েছে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি। ফলে আমাদের দেশেও তথ্য অধিকার আইনপাস করা হয়েছে। আইনটি পাস করার জন্য আমরা দাবি করেছিলাম, যাতে সমাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। আর বলার অধিকার ও চিন্তার স্বাধীনতা সংবিধানের ৩৯ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে। এ অধিকার হরণ করা মানে সংবিধান লঙ্ঘন।
আজ যাঁরা আমাদের শাসক, তাঁরাই যখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন, তখন এসব দাবির পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। দুর্ভাগ্য আমাদের, তাঁরাই ক্ষমতায় বসে নিজেদের ওয়াদা আর দাবির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন বলে মনে হয়। তাই আজ যখন তাঁরা সমালোচিত হচ্ছেন তাঁদের ব্যর্থতার জন্য, তখন নানাভাবে মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ করার চেষ্টা করছেন। আরোপ করতে চাইছেন গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা।
এরই অংশ হিসেবে অতীতে বিশেষ ক্ষমতা আইন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করা হয়। খবরের কাগজের প্রকাশনা বন্ধ করার ক্ষমতা ছিল সরকারের হাতে। বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায়, তাঁরাও এ আইন বাতিল সমর্থন করেছিলেন, যদিও তাঁদেরই পূর্বসূরিরা এ আইন প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। আইনটি বাতিল করা হয় এরশাদের পতনের পর। কিন্তু শাসকেরা যখনই সমালোচিত হন তাঁদের ব্যর্থতার জন্য, দুর্নীতির জন্য, তখনই গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার উদ্যোগ নেন। এমনই একটি উদ্যোগ নিয়ে বর্তমানে আলোচনা চলছে। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারি সম্প্রচার নীতিমালা নামে একটি খসড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কমিটি সেটি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। খসড়া নীতিমালাটি মানবজমিন পত্রিকায় যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
কোনো আলোচনামূলক অনুষ্ঠান, কোনো প্রকার অসংগতিপূর্ণ বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বা উপাত্ত দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে টেলিভিশন বা রেডিও বা অনুষ্ঠান পরিচালক জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। জাতীয় আদর্শ বা উদ্দেশ্যের প্রতি কোনো প্রকার ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ, বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ অথবা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অখণ্ডতা বা সংহতি ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন প্রবণতা-সম্পর্কিত কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন করতে পারে এমন ধরনের সামরিক বা সরকারি কোনো তথ্য ফাঁস করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হয় এমন অনুষ্ঠানও প্রচার করা যাবে না। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে কোনো ধরনের প্রচারণা, যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের বিরোধের কোনো একটি বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে; কিংবা একটি বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচারণা, যার ফলে সেই রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, এমন অনুষ্ঠানও করা যাবে না। দেখানো যাবে না কোনো জনগোষ্ঠী, জাতি বা দেশের মর্যাদা বা ইতিহাসের ঘটনা বা দৃশ্যবিন্যাস।
জাতির পিতার প্রতি কোনো প্রকার অবজ্ঞা বা অসম্মান করা যাবে না। সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামতও প্রচার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য এবং হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, বিদেশি কূটনীতিক ও জাতীয় বীরদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ওয়াজ মাহফিল, ওরস, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি ধর্মবিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত অনুষ্ঠান, যেমন—রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানের ভাষণ, গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা বা প্রেসনোট, জরুরি আবহাওয়া বা স্বাস্থ্যবার্তা এবং সরকার কর্তৃক অনুমোদিত অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করতে হবে। সব ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। কোনো জাতি, ধর্মসম্প্রদায় বা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি কোনোরূপ অবমাননা বা শ্লেষ, কটাক্ষ বা সমালোচনা করা যাবে না। সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করতে হবে। দেশি ও বিদেশি ছবি বা অনুষ্ঠানে অশ্লীল চুম্বনের দৃশ্য সর্বতোভাবে পরিহার করতে হবে। হিংসাত্মক, সন্ত্রাসমূলক এবং দেশীয় সংস্কৃতির মূল্যবোধের পরিপন্থী কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। বেসরকারি সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে পরিবেশিত অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে ১৯৬৩ সালের ফিল্ম সেন্সরশিপ অ্যাক্টের অধীনে প্রণীত বিধি বা নীতিমালা অনুযায়ী কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, উল্লেখ না থাকা সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তথ্য মন্ত্রণালয়। রেডিও ও টিভি চ্যানেলকে নিজ দায়িত্বে বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত ছাড়পত্র প্রদান করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন নীতিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করা না হলে তথ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
খসড়া নীতিমালায় যা আছে তা বাস্তবায়িত হলে আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকবে না। খসড়ায় যেসব বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে তা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। চালানোর চেষ্টা করা হলে তা প্রতিহত হবে। আবার এর মধ্যে অনেকগুলো বিষয় আছে, যা সাংবাদিকতার নীতিমালার অঙ্গ। আবার অনেকগুলো বিধান সংবিধানের ৩৯ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে। এগুলো নীতিমালার মধ্যে আনার কোনো অর্থ হয় না।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা আজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছি। স্বৈরশাসনের দিন আবার ফিরে আসবে, এটা ভাবা যায় না। দুই বছরের সেনা-সমর্থিত শাসনামলেও এমন একটা নীতিমালার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের ও বাকস্বাধীনতার রক্ষক বলে দাবি করে। তাদের কাছ থেকে এমন বাধানিষেধযুক্ত নীতিমালা আমরা আশা করি না। যে নীতিমালার কথা আমরা বলেছিলাম তা হলো, কীভাবে এবং কারা টেলিভিশন-রেডিওর লাইসেন্স পাবেন। বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এমন নীতিমালা আমরা চাই যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, স্বাধীন নীতির ভিত্তিতে যে কেউ লাইসেন্স পেতে পারেন। এমন নীতিমালা চাই যাতে থাকবে স্বাধীনতা, আর সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নিশ্চয়তা। একটা কথা ভুললে চলবে না, হীরক রাজাদের দিন শেষ, এখন দিন গণমানুষের আর মুক্তচিন্তার। হীরক রাজার যুুগে আর ফেরা যাবে না।
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ: সম্পাদক, নিউজ টুডে।
No comments