নিরক্ষর প্রবাসীদের বিড়ম্বনা পথে পথে by মেহেদী হাসান,

ভাই, আপনার ফরমটা পূরণ করা শেষ হলে আমারটাও পূরণ কইর‌্যা দেন' শ্রীলঙ্কায় প্রবেশের জন্য বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভিবাসন কর্মকর্তার কাউন্টারের সামনে অ্যারাইভাল ফরম নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশি রজব আলী। ফরম পূরণ করার সময় বললেন, 'দেশি মানুষ পাইয়া ভালা অইল। না হইলে আমার ফরমটা কেডা পূরণ করত?'


ফরিদপুরের রজব মালদ্বীপের রাজধানী মালের একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন। পড়তে ও লিখতে পারেন না। কোনো রকমে স্বাক্ষর দিতে পারেন। রজব আলী জানালেন, কয়েক বছর আগে বিমানযোগে মালদ্বীপের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার সময় এভাবেই একজন তাঁর বহির্গমন ফরম পূরণ করে দিয়েছিলেন। কলম্বো গিয়ে মালেগামী আরেক বাংলাদেশির সঙ্গে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওই বাংলাদেশি যাত্রী যে ফ্লাইটে ওঠেছেন তিনিও তাঁকে অনুসরণ করে সেই ফ্লাইটে ওঠেন। বিমানের টিকিটে কী লেখা আছে, তা তিনি সেদিন যেমন বুঝতে পারেননি, এখনো পারেন না। বিমানবন্দরে বোর্ডগুলোতে ইংরেজিতে ফ্লাইট স্ট্যাটাস, স্পিকারে ইংরেজি ভাষায় জরুরি ঘোষণা কিছুই বোঝেন না তিনি। অনিশ্চয়তা আর বিড়ম্বনাকে সঙ্গী করে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।
গত রবিবার মধ্যরাতে শ্রীলঙ্কার ওই বিমানবন্দরে রজব আলীর মতো আরো কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শীর্ষ সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহ করে মালদ্বীপ থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে। কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদকের মতো অন্য সাংবাদিকরাও প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের শ্রীলঙ্কায় ঢোকার অভিবাসন ফরম পূরণ করে দেন। পরদিন সোমবার দুপুরে শ্রীলঙ্কা ছাড়ার সময় আরো কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী এগিয়ে আসেন তাঁদের ফরম পূরণ করে দেওয়ার জন্য। তাঁদের একজন কুমিল্লার মো. মহসিন। তিনি বলেন, আরেকজনের মাধ্যমে ফরম পূরণ করতে গিয়ে কাউন্টারের লোকজনের ধমক খেতে হয় কখনো কখনো। অনেকে আবার বিরক্তির চোখে তাকায়।
অভিবাসন কাউন্টার পার হওয়ার পর ফ্লাইটের জন্য বিমানবন্দরের বহির্গামী লাউঞ্জে অপেক্ষার সময় মো. মহসিন জানান, লিখতে-পড়তে না জানার কারণে প্রবাসে পদে পদে তাঁদের বিপদের মধ্যে পড়তে হয়। বাংলা জানেন এমন লোকও অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। নতুন একটি দেশে গিয়ে ফোন করার জন্যও বাংলা জানেন এমন লোক খুঁজতে হয়।
মহসিন আরো জানান, মালদ্বীপে প্রথম যখন তিনি কাজের জন্য গিয়েছিলেন তখন বিমানবন্দরে তাঁকে কেউ নিতে আসেনি। কিছুই চেনেন না, জানেন না। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা তিনি থাকার পর এক পুলিশ এসে প্রথমে দিভেহি (মালদ্বীপের ভাষা) ও পরে ইংরেজিতে তাঁকে কী বলেছিলেন বুঝতে পারেননি। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তাই বিমানবন্দরের টার্মিনাল থেকে এক বাংলাদেশিকে ডেকে এনে তাঁর মাধ্যমে প্রশ্ন করেন।
মো. মহসিন বলেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তা ভালো ছিল। তিনি কোনো সমস্যায় পড়েছেন তা ওই পুলিশ কর্মকর্তা আঁচ করতে পেরে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ইংরেজি ও দিভেহি কোনো ভাষাই না জানায় মো. মহসিন পুলিশের কোনো প্রশ্নই বুঝতে পারেননি। এখন অবশ্য দিভেহি ভাষা বোঝেন।
বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডিপার্চার লাউঞ্জে অপেক্ষমান বাংলাদেশি ফজলুল হক কুয়েত থেকে ঢাকা ফিরছিলেন। তিনি জানান, মধ্যপ্রাচ্যের বিমানবন্দরগুলোতেও অনেক বাংলাদেশি কর্মী আগমন/ বহির্গমন ফরম পূরণের জন্য অন্যদের অনুরোধ করেন। ইংরেজি বুঝতে না পারায় তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই অভিবাসন কাউন্টারে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। ফলে বিড়ম্বনায় পড়তে হতে হয়। আবার অনেক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি কর্মী দেখলেই আলাদা লাইনে পাঠানো হয়। কারণ, তাঁদের অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অন্যদের চেয়ে বেশি সময় লাগে।
ফ্লাইটের ভেতরও দেখা গেল, এয়ার হোস্টেসরা যখন হাসিমুখে যাত্রীদের সাধ্যমত সেবা দিতে ব্যস্ত, তখন নিরক্ষর বাংলাদেশিরা অবহেলার শিকার। এয়ার হোস্টেসরা তাঁদের খাবারের তালিকা থেকে যাত্রীদের পছন্দ অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করছিলেন। এ প্রতিবেদকের পাশের আসনে বসা এক বাংলাদেশি কর্মীকে পছন্দ সম্পর্কে না জেনেই খাবার পরিবেশন করা হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই এয়ার হোস্টেস ইংরেজিতে বলেন, 'কিছু মনে করবেন না। আমি ধারণা করছি, তিনি আমার প্রশ্ন বুঝবেন না।'
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকায় তাঁর কার্যালয়ে। তিনি বলেন, এসব বিড়ম্বনা সম্পর্কে তাঁরা অবগত। এ জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে বিএমইটির পক্ষ থেকে যে ব্রিফিং দেওয়া হয়, সেখানে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো লেখাপড়া শিখে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নূ্যনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বেধে দেওয়া নেই। এটা করলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, আমাদের প্রবাসী কর্মীদের অনেকেই অশিক্ষিত।'
বিএমইটির মহাপরিচালক আরো বলেন, 'যে ব্যক্তি ইংরেজিকে নূ্যনতম যোগাযোগটুকুও করতে পারে না, তাঁর জন্য বিদেশে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁকে সব সময় অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তিনি যে কাগজে স্বাক্ষর দেন, তাতে কি লেখা আছে_তাও তিনি জানেন না। তাই আমরা আশা করি, কর্মীরা নিজেদের স্বার্থেই যোগাযোগ করার সক্ষমতা অর্জন করার মতো শিক্ষা নিয়ে বিদেশে যাবেন'।

No comments

Powered by Blogger.