সিভিএফ ঢাকা সম্মেলন-বিপন্নদের ঐক্যই বিপদের জবাব

ঢাকায় সিভিএফ (ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম) মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন এমন সময় অনুষ্ঠিত হলো, যখন বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত বিপদ মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বহুরৈখিক বিরূপতাও এখন অবিসংবাদিত। সর্বব্যাপ্ত এই সংকটের কারণে বিশেষভাবে বিপন্ন অথচ অনুন্নত দেশগুলোর এই জোটের দুই দিনের আলোচনা ও শেষ দিনের ঘোষণাপত্রে এসব বিষয় স্বভাবতই প্রতিফলিত হয়েছে।


আমরা আশা করি, সিভিএফ ঢাকা ঘোষণার পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ একই ইস্যুতে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিতব্য শীর্ষ সম্মেলনের আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলবে। আমাদের মনে আছে, ২০০৯ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপের রাজধানীতে এই ফোরাম গঠিত হয়েছিল বহুল আলোচিত কোপেনহেগেন সম্মেলনে বিপন্ন ও দরিদ্র দেশগুলোর কণ্ঠস্বর যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য। অনেক আশা জাগানো 'কোপ-ফিফটিন' মুখরক্ষার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলেও সিভিএফ তার লক্ষ্য পূরণে শতভাগ সফল হয়েছিল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, সংবাদমাধ্যম এবং ধরিত্রী রক্ষায় উদ্বিগ্ন কোটি কোটি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল এক মাসেরও কম বয়সী জোট। ঢাকায় যখন এর তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন সিভিএফ কেবল বয়স ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ নয়, শক্তিশালীও। সদস্যসংখ্যা তিনগুণ হওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও এর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ২৫টি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশকে পর্যবেক্ষক হিসেবে হাজির করার ক্ষমতাও তৈরি হয়েছে। এখন প্রয়োজন ঐক্য ও দিকনির্দেশনা। মনে রাখা জরুরি, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ঐক্যের কারণেই কানকুনে কোপেনহেগেনের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী উন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক বিপদটি মোকাবেলায় তহবিল গঠনের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল বলা চলে। আমরা চাই, ডারবান সম্মেলনে ওইসব প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং সবুজ গ্রহটিকে বাঁচানোর পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারিত হবে। সিভিএফ সম্মেলনে যোগ দিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও একই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। সম্মেলনে উপস্থিত উন্নত বিশ্বের প্রতিনিধিরাও বিষয়টির তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে সবার আগে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় তহবিলের ব্যাপারে অগ্রগতি জরুরি। দুর্ভাগ্যের সঙ্গে আমরা দেখেছি যে জলবায়ু পরিবর্তন, এর প্রভাব, তা মোকাবেলার উপায় নিয়ে গত তিন বছরে বিশ্বব্যাপী যে আলোচনা ও সভা-সেমিনার হয়েছে, তহবিল জোগানোর ব্যাপারে তার সিকিভাগ সাফল্য নেই। প্রতিশ্রুতির তুলনায় যে সামান্য অর্থ জমা হয়েছে, তার বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে অনেক জটিলতা, শর্তের বেড়াজাল। সিভিএফ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য যে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সহায়তা দ্রুত ও শর্তহীন হতে হবে। তার বক্তব্যে বিপন্ন দেশগুলোর সবার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে। দ্রুত ও শর্তহীন তহবিল নিশ্চিত করার বিকল্পও নেই। কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন প্রক্রিয়া উন্নত বিশ্বের গড়িমসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্লথ হয়ে নেই। প্রাকৃতিকভাবে সর্বনাশা পরিবর্তন খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব ইতিমধ্যে পড়ে গেছে বলে গত বছরের 'ক্লাইমেট ভালনারেবিলিটি মনিটর রিপোর্ট' নিশ্চিত করেছে। এখন আর বসে থাকার অবকাশ নেই। এও মনে রাখা জরুরি, সিভিএফভুক্ত ৩৩ দেশই কেবল বিপন্ন নয়; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় এখনই উদ্যোগী না হলে অন্যদেরও সমান বিপদে পড়তে হবে। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় সুরক্ষিত থাকবে না। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের নেতৃত্বে সিভিএফ ডারবান সম্মেলনে উন্নত বিশ্বকে বিষয়টি কার্যকরভাবে বোঝাতে সক্ষম হবে।

No comments

Powered by Blogger.