থাইল্যান্ডের বানলু, বাংলাদেশের সোবহান, দুই দেহে এক প্রাণ!-ধর নির্ভয় গান by আলী যাকের
আজ থেকে বছর দুয়েক আগে আমি ব্যাংককের পাতায়াতে গিয়েছিলাম কোনো একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সেখানে সকালবেলায় আমার হোটেল কক্ষে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সেদিনের ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকাটি চোখের সামনে মেলে ধরলাম। ওইদিনের ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছিল, যেটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক দরিদ্র কৃষক হতাশ নয়নে তার জমির দিকে তাকিয়ে বসে আছে; সঙ্গে তার অভুক্ত গাভী এবং বাছুর। সামনেই একটি গর্ত, যেখানে পানি থাকার কথা, কিন্তু সেটি একেবারে খটখটে শুকনো। যদি আমার স্মরণে থেকে থাকে, তবে জায়গাটির নাম ছিল সুরিন এবং সেটি থাইল্যান্ডের প্রসাত জেলায় অবস্থিত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনাবৃষ্টির ফলে সেই সময় ওই জেলার প্রায় সব জলাশয়, জলাধার এবং খালবিল একেবারে শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মানুষ এবং পশু কেউই তেষ্টা নিবারণের জন্য যথেষ্ট পানি পাচ্ছে না। যে কৃষকটির ছবি দেখানো হয়েছে, তার নাম বানলু ইয়ামজিদ। বানলুর শরীর-স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছে। তার চেহারায় হতাশার চিহ্ন স্পষ্ট প্রতীয়মান এবং মনে হচ্ছে, সে প্রায় নিশ্চিত যে জীবন থেকে আর তার কিছুই পাওয়ার নেই। বানলু ইয়ামজিদের ওই ছবি দেখছিলাম আমার বিলাসবহুল হোটেল কক্ষের ভেতরে আরামদায়ক সোফার ওপরে বসে। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার চোখের ওপর ভেসে উঠল আমার গ্রামেরই এক গরিব কৃষক সোবহানের চেহারা। আমাদের বাংলাদেশের সর্বত্র, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের যে কোনো জায়গায় গেলে এ ধরনের অসংখ্য অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা মানুষের দেখা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই বানলু ইয়ামজিদদের কমতি নেই। বানলু ইয়ামজিদের এই অবস্থা একটু ভিন্ন এই কারণে যে, যে স্থানে তার বাস, সে স্থানটি সুরম্য ব্যাংকক থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ব্যাংকক বিমানবন্দরে নামার পরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি যখন একটি গাড়িতে উঠে বসলাম, সেই গাড়িটি প্রায় পঙ্খিরাজের মতো আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল শহরের তাবৎ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে। চলল, চলতেই থাকল। এটি একটি বিশাল দীর্ঘ ফ্লাইওভার পাড়ি দিল, যে ফ্লাইওভার যখন মাটিতে এসে মেশে তখন ব্যাংকক শহরের সীমানা আমরা পেরিয়ে এসেছি। দু'দিকে দেখা যাচ্ছে থাইল্যান্ডের গ্রামের দৃশ্য। এই অতি সামান্য যে দূরত্ব, এখানেও চন্দন-চর্চিত ব্যাংককের কোনো ছাপ এসে পড়েনি কোনোভাবেই। ঠিক একই বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। দিলি্লতে গেলে কারও কল্পনা করারও উপায় নেই যে, পার্শ্ববর্তী মধ্য ভারতীয় কোনো গ্রামে এক বা একাধিক কৃষক খেতে না পেয়ে অবলীলায় আত্মহত্যা করছে। অর্থাৎ বিশ্বায়নের নামে ঝটিতি সমৃদ্ধি সাধনের আশায় আমরা নগর এবং গ্রামের মধ্যে ধনী এবং দরিদ্রের মাঝে তফাতটা এমনই বাড়িয়ে চলেছি যে, আমাদের শহরগুলোতে এলে বোঝারও উপায় নেই, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি কী। আমাদের বাংলাদেশেও কি একইভাবে ধনী-দরিদ্র এবং নেই এর মাঝে দূরত্বটি এ রকম ভয়াবহভাবেই বাড়ছে না?
যা হোক, ফিরে আসি আমার পাতায়ার অভিজ্ঞতায়। আমি গিয়েছিলাম বিজ্ঞাপন বিষয়ে একটি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উৎসবে। এখানে এসেই বানলু ইয়ামজিদের সাক্ষাৎ পেলাম এই অতি ঝকঝকে তকতকে রিসোর্ট শহরে আমার পাঁচতারা হোটেলের নিভৃত কক্ষের ভেতরে বসে। ভাবলাম তাহলে এদেরও আছে বানলু, ঠিক যেমন আমাদের আছে সোবহান! এখানে আমার মনে হয় কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার আছে, আমার ওপরে কেন এই পুরনো স্মৃতি হঠাৎ করেই সওয়ার হলো। আমার মনে হয়, এশিয়া-প্যাসিফিক শব্দযুগল, অথবা এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হিসেবে যে অঞ্চলগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয় সেগুলো হলো দূরপ্রাচ্য আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি, আফ্রিকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোকে। এই অঞ্চলের কোথাও দক্ষিণ এশিয়ার কোনো স্থান নেই। যা হোক, এই বিভাজনে আমার কিছু যায় আসে না। এই উৎসবে প্রদর্শিত প্রায় সব বিজ্ঞাপনে, তাদের চমক এবং আকর্ষণে, কোথাও এশীয় মহাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমারের কোনো প্রতিচ্ছবি কোনোভাবেই দেখা যায় না। অথচ এসব দেশ অথবা এর বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত ভিয়েতনাম, লাওস কিংবা কম্বোডিয়া_ এসব অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই বিজ্ঞাপনের চিত্র, দৃশ্য অথবা ভাষার সঙ্গে পরিচিত নয়। এখানে প্রদর্শিত সব বিজ্ঞাপনই ছিল অতি চমকপ্রদ, যা সবদিক থেকেই ভীষণ আকর্ষণীয়। তবে এর সবগুলোই সাধারণ মানুষের মাথার ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায় কোন সুদূরে, তা বোঝারও সাধ্য নেই। যে বিজ্ঞাপন কোনো একটি দরিদ্র দেশের, বানলু কিংবা সোবহানের মতোই, সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয় না, তা দিয়ে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। এটাই প্রতীয়মান হয়েছিল আমার কাছে ওই উৎসবে গিয়ে। অথচ অবাক লাগে, আমাদের ভোক্তা-বিশ্বকে বাড়ানোর জন্য ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারী সব প্রতিষ্ঠান এই অতি সাধারণ মানুষের ভেতরেই বাজার পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ওই উৎসবে গিয়েই আমার মনে হলো যে, 'সাধারণ মানুষরা বোধহয় বাস করে না এসব প্রান্তিক দেশে। এখানে কোনো গ্রাম নেই, এখানে শিক্ষিত মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তারা সকলেই কেবল পশ্চিমা বিশ্বের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে রয়েছে সমৃদ্ধ সব মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট পাওয়ার আশায়।' হঠাৎ করেই ওই সফরে আমার সেই অতি আরামদায়ক কক্ষে বসে বানলু এবং সোবহানদের জন্য আর সুরিন অথবা রতনপুর থেকে আসা আপামর মানুষের জন্য চোখ ভিজে আসে। চোখ ভেসে যায়। আমি আমার দেশটিকে চিনি এবং নিশ্চিতভাবে জানি যে, আমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ 'ওদের'ই মতো। কেবল হাতেগোনা কয়েকজন আমরা আছি, যারা 'আমাদের' মতো। হঠাৎ করেই আমার মধ্যে বড় গ্গ্নানিবোধ হয়। আমি ভাবি, আমরা একটি পণ্য অথবা সেবার বিজ্ঞাপনটি নিয়ে আসলেই কোথায় যেতে চাই? সমাজ সংস্কার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদির ওপর যখন আমরা বিজ্ঞাপন নির্মাণ করি, তখন তো ভারি ভারি কথা বলি যে, এসব বিজ্ঞাপনের কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষের আচরণ এবং মাঝে মধ্যে তাদের বিশ্বাসের ধারাকে বদলে দেওয়ার জন্য। এসব মানুষের জন্ম অনগ্রসর সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে। এটাই আসল সত্য। এসব মানুষের কাছে আমরা কী করে পেঁৗছে দেব সেসব বাণী, যাতে করে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন হবে? কিংবা অতি তুচ্ছ যে সাবান বা শ্যাম্পু সেই সম্বন্ধেই-বা কোন ভাষায় আমরা তাদের অবহিত করব?
আজকাল 'বাক্সের বাইরে' কথাটি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে খুবই চালু হয়ে গেছে। অনেক তরুণজনেরা বিজ্ঞাপনের সৃজনশীল শাখায় এসেই 'আউট অব দ্য বক্স' বাক্যটি বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তাদের কথা শুনে আমার হাসি পায়। এই বাক্সটি দেখতে কীরকম? আর এর বাইরের স্থানটিই-বা কোথায়? যে কোনো তথ্যের সাফল্যের পেছনে তো রয়েছে এই যে আমি যাদের জন্য তথ্যটি পরিবেশন করছি বা আমার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যাদের দৃষ্টি আমি আকর্ষণ করতে চাই, তাদের আমার আদ্যোপান্ত জানতে হবে? তাদের অবস্থান তো বাক্সের মধ্যেই। তাদের বাক্সের বাইরে নেব কীভাবে? আমি কোন ভাষায় বলব যে, বেশিরভাগ টিউবওয়েলের পানিতে এখন আর্সেনিকের আধিক্য রয়েছে? আমি যদি এসব তথ্য প্রদানকারী বিজ্ঞাপনকে প্রতীচ্যিয় মোড়কে মুড়ে পরিবেশন করি, খুবই সুদৃশ্য সে মোড়ক, তাহলে কি কাজ হবে? অথবা ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনেও যদি এমন ভাষা আমি ব্যবহার করি, কিংবা এমন দৃশ্য, যাকে অপরিচিত মনে হবে আমার নির্ধারিত ভোক্তাবৃন্দের কাছে, তাহলে কি গোটা বিষয়টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে না? আমরা আজকাল বাজারকে পাশাপাশি বিস্তৃতির কথা বলছি। অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর প্রান্তিক সীমায় যাদের বাস তাদের মধ্যেও আগ্রহের সৃষ্টি করতে হবে ভোগ্যপণ্যের প্রতি যেন স্বল্প দামের ভোগ্যপণ্যগুলো তারা ক্রয় করে। কোন ভাষায় বললে এ বিষয়ে আমরা সফল হবো? তথাকথিত বিশ্বায়নে একটি বিষয় আমরা শিখেছি উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে যে, বিশ্বের সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলে। অথবা যেমন তারা বলে থাকেন, বিশ্বকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে নিয়ে প্রতিটি অঞ্চলে একই ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। তারা ভুলে যান যে, একই অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন দেশ এবং সমাজের জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে অথবা ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। ওই বিজ্ঞাপন উৎসব থেকে আমি দেশে ফিরে আসি বড় দুঃখ নিয়ে। দুঃখ হয় বানলু কিংবা সোবহানদের জন্য। ওরা যখন আমাদের চাকচিক্যময় বিজ্ঞাপন দেখে তখন ভাষাহীন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওরা বুঝুক আর না বুঝুক, তাতে আমাদের কী এসে যায়? আমি ভাবি, নিশ্চিতভাবেই আমার বয়স বাড়ছে। আমারই দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে হয়তো-বা।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
যা হোক, ফিরে আসি আমার পাতায়ার অভিজ্ঞতায়। আমি গিয়েছিলাম বিজ্ঞাপন বিষয়ে একটি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উৎসবে। এখানে এসেই বানলু ইয়ামজিদের সাক্ষাৎ পেলাম এই অতি ঝকঝকে তকতকে রিসোর্ট শহরে আমার পাঁচতারা হোটেলের নিভৃত কক্ষের ভেতরে বসে। ভাবলাম তাহলে এদেরও আছে বানলু, ঠিক যেমন আমাদের আছে সোবহান! এখানে আমার মনে হয় কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার আছে, আমার ওপরে কেন এই পুরনো স্মৃতি হঠাৎ করেই সওয়ার হলো। আমার মনে হয়, এশিয়া-প্যাসিফিক শব্দযুগল, অথবা এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হিসেবে যে অঞ্চলগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয় সেগুলো হলো দূরপ্রাচ্য আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আশ্চর্য হলেও সত্যি, আফ্রিকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোকে। এই অঞ্চলের কোথাও দক্ষিণ এশিয়ার কোনো স্থান নেই। যা হোক, এই বিভাজনে আমার কিছু যায় আসে না। এই উৎসবে প্রদর্শিত প্রায় সব বিজ্ঞাপনে, তাদের চমক এবং আকর্ষণে, কোথাও এশীয় মহাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা মিয়ানমারের কোনো প্রতিচ্ছবি কোনোভাবেই দেখা যায় না। অথচ এসব দেশ অথবা এর বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত ভিয়েতনাম, লাওস কিংবা কম্বোডিয়া_ এসব অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই বিজ্ঞাপনের চিত্র, দৃশ্য অথবা ভাষার সঙ্গে পরিচিত নয়। এখানে প্রদর্শিত সব বিজ্ঞাপনই ছিল অতি চমকপ্রদ, যা সবদিক থেকেই ভীষণ আকর্ষণীয়। তবে এর সবগুলোই সাধারণ মানুষের মাথার ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যায় কোন সুদূরে, তা বোঝারও সাধ্য নেই। যে বিজ্ঞাপন কোনো একটি দরিদ্র দেশের, বানলু কিংবা সোবহানের মতোই, সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয় না, তা দিয়ে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। এটাই প্রতীয়মান হয়েছিল আমার কাছে ওই উৎসবে গিয়ে। অথচ অবাক লাগে, আমাদের ভোক্তা-বিশ্বকে বাড়ানোর জন্য ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারী সব প্রতিষ্ঠান এই অতি সাধারণ মানুষের ভেতরেই বাজার পাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ওই উৎসবে গিয়েই আমার মনে হলো যে, 'সাধারণ মানুষরা বোধহয় বাস করে না এসব প্রান্তিক দেশে। এখানে কোনো গ্রাম নেই, এখানে শিক্ষিত মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তারা সকলেই কেবল পশ্চিমা বিশ্বের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে রয়েছে সমৃদ্ধ সব মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট পাওয়ার আশায়।' হঠাৎ করেই ওই সফরে আমার সেই অতি আরামদায়ক কক্ষে বসে বানলু এবং সোবহানদের জন্য আর সুরিন অথবা রতনপুর থেকে আসা আপামর মানুষের জন্য চোখ ভিজে আসে। চোখ ভেসে যায়। আমি আমার দেশটিকে চিনি এবং নিশ্চিতভাবে জানি যে, আমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ 'ওদের'ই মতো। কেবল হাতেগোনা কয়েকজন আমরা আছি, যারা 'আমাদের' মতো। হঠাৎ করেই আমার মধ্যে বড় গ্গ্নানিবোধ হয়। আমি ভাবি, আমরা একটি পণ্য অথবা সেবার বিজ্ঞাপনটি নিয়ে আসলেই কোথায় যেতে চাই? সমাজ সংস্কার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদির ওপর যখন আমরা বিজ্ঞাপন নির্মাণ করি, তখন তো ভারি ভারি কথা বলি যে, এসব বিজ্ঞাপনের কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষের আচরণ এবং মাঝে মধ্যে তাদের বিশ্বাসের ধারাকে বদলে দেওয়ার জন্য। এসব মানুষের জন্ম অনগ্রসর সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে। এটাই আসল সত্য। এসব মানুষের কাছে আমরা কী করে পেঁৗছে দেব সেসব বাণী, যাতে করে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন হবে? কিংবা অতি তুচ্ছ যে সাবান বা শ্যাম্পু সেই সম্বন্ধেই-বা কোন ভাষায় আমরা তাদের অবহিত করব?
আজকাল 'বাক্সের বাইরে' কথাটি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে খুবই চালু হয়ে গেছে। অনেক তরুণজনেরা বিজ্ঞাপনের সৃজনশীল শাখায় এসেই 'আউট অব দ্য বক্স' বাক্যটি বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তাদের কথা শুনে আমার হাসি পায়। এই বাক্সটি দেখতে কীরকম? আর এর বাইরের স্থানটিই-বা কোথায়? যে কোনো তথ্যের সাফল্যের পেছনে তো রয়েছে এই যে আমি যাদের জন্য তথ্যটি পরিবেশন করছি বা আমার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যাদের দৃষ্টি আমি আকর্ষণ করতে চাই, তাদের আমার আদ্যোপান্ত জানতে হবে? তাদের অবস্থান তো বাক্সের মধ্যেই। তাদের বাক্সের বাইরে নেব কীভাবে? আমি কোন ভাষায় বলব যে, বেশিরভাগ টিউবওয়েলের পানিতে এখন আর্সেনিকের আধিক্য রয়েছে? আমি যদি এসব তথ্য প্রদানকারী বিজ্ঞাপনকে প্রতীচ্যিয় মোড়কে মুড়ে পরিবেশন করি, খুবই সুদৃশ্য সে মোড়ক, তাহলে কি কাজ হবে? অথবা ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনেও যদি এমন ভাষা আমি ব্যবহার করি, কিংবা এমন দৃশ্য, যাকে অপরিচিত মনে হবে আমার নির্ধারিত ভোক্তাবৃন্দের কাছে, তাহলে কি গোটা বিষয়টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে না? আমরা আজকাল বাজারকে পাশাপাশি বিস্তৃতির কথা বলছি। অর্থাৎ জনগোষ্ঠীর প্রান্তিক সীমায় যাদের বাস তাদের মধ্যেও আগ্রহের সৃষ্টি করতে হবে ভোগ্যপণ্যের প্রতি যেন স্বল্প দামের ভোগ্যপণ্যগুলো তারা ক্রয় করে। কোন ভাষায় বললে এ বিষয়ে আমরা সফল হবো? তথাকথিত বিশ্বায়নে একটি বিষয় আমরা শিখেছি উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে যে, বিশ্বের সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলে। অথবা যেমন তারা বলে থাকেন, বিশ্বকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে নিয়ে প্রতিটি অঞ্চলে একই ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। তারা ভুলে যান যে, একই অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন দেশ এবং সমাজের জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে অথবা ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। ওই বিজ্ঞাপন উৎসব থেকে আমি দেশে ফিরে আসি বড় দুঃখ নিয়ে। দুঃখ হয় বানলু কিংবা সোবহানদের জন্য। ওরা যখন আমাদের চাকচিক্যময় বিজ্ঞাপন দেখে তখন ভাষাহীন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওরা বুঝুক আর না বুঝুক, তাতে আমাদের কী এসে যায়? আমি ভাবি, নিশ্চিতভাবেই আমার বয়স বাড়ছে। আমারই দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে হয়তো-বা।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments