আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪৯)-শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে প্রথম ধাক্কা by আলী যাকের
পিআইএর সদর দপ্তর থেকে একটি অটোরিকশায় চেপে সবুজ মামার বাড়িতে পেঁৗছানো গেল। সেখানে যথারীতি আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন মামা-মামি এবং গোটা পরিবার। এর আগে যখন ড্রিগ রোড দিয়ে পিআইএর বাসটি ছুটে চলছিল, তখন মনে হচ্ছিল, বাসটি যেন বাতাসে ভেসে চলেছে। এমন মসৃণ রাস্তা। দুই দিকে সুন্দর সুন্দর ভবন, নিয়নের আলো। যেদিকে দৃষ্টি যায়, ঝকঝকে-তকতকে পরিষ্কার।
তখনই বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। এই যে মসৃণ রাস্তা, চতুর্দিকে উন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান, চেহারায়, পোশাক-আশাকে প্রাচুর্যের প্রলেপ_এগুলো তো আমাদেরই পাটের পয়সা, চায়ের পয়সা এবং চামড়ার পয়সায় সম্ভব হয়েছে। আমাদের পাট, যাকে তখন বলা হতো সোনালি আঁশ, যার চাষ করা হতো বাংলাদেশের সর্বত্র, যার পেছনে ছিল আমাদের আধপেট খাওয়া কৃষিজীবী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, তাঁরা কিন্তু এই সোনালি আঁশ থেকে আয় করা সম্পদের ছিটেফোঁটাও কোনোকালে পেতেন না। এমনকি আমাদের শহরগুলোও ছিল তখন কত নিষ্প্রভ। এই বঞ্চনা শুরু হয় পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই; এবং এর মূল কারণ পাকিস্তানের যাঁরা স্রষ্টা, তাঁরা উত্তর ভারতের উর্দুভাষী এলিট সমাজের মানুষ। আমাদের কৃষিপ্রধান গ্রামীণ সমাজকে তাঁরা অবাঞ্ছিত মনে করতেন; এবং ভাবতেন, এ ধরনের বৈষম্যমূলক ব্যবহারই আমাদের প্রাপ্য। প্রসঙ্গত, ওই সময় আমার দেখা পশ্চিম পাকিস্তানের সমাজের বিভাজন সম্পর্কে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। পাকিস্তান সমাজ মূলত তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। ক্ষমতা ও প্রতাপের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিন্যাস করতে হলে প্রথমেই আসে প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনী। তারপর সামন্তপ্রভু এবং তাদের সন্তানরা। এ দুই শ্রেণীই অগাধ পয়সার মালিক। তবে একটি মজার ব্যাপার হলো, সিভিল প্রশাসনে কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা পদে প্রবেশ পায় এই সামন্ত শ্রেণী থেকে আসা যুবকরাই। কেননা সামন্ত শিশুরাই মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং পরবর্তীকালে দেশ-বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে এসব চাকরির জন্য নিজেদের যোগ্য করে তোলার সুযোগ পায়। এই হচ্ছে পাকিস্তানের কিছু সৌভাগ্যবান পরিবারের কাহিনী। এর বাইরে যারা, তারা আপামর জনসাধারণ। এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভূমিহীন কৃষক এবং প্রচণ্ড অভাবী জীবন যাপন করে। এরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষ, যাদের নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক ধ্যানধারণা নেই। ওপরতলার মানুষরা যা বলে, তা-ই তারা বেদবাক্য হিসেবে মেনে নেয়। পাকিস্তানের বিশাল সশস্ত্র বাহিনীতে সাধারণ সেনা বলতে এরাই। বিনা প্রশ্নে তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হুকুম তারা শোনে এবং সেইমতো কাজ করে। একজন এ ধরনের প্রান্তিক মানুষের একমাত্র লক্ষ্য থাকে সশস্ত্র বাহিনীতে নিম্নপদে এ ধরনের একটি চাকরি অথবা সিভিল প্রশাসনে চতুর্থ শ্রেণীতে কোনোমতে জায়গা করে নেওয়া। এই শ্রেণীবিন্যাস বহুদিন আগে সব অনুন্নত দেশেই ছিল। সব জায়গায়ই শিক্ষার আলো অল্পবিস্তর ছড়িয়ে পড়ায় অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরাও আমাদের এই বাংলাদেশে কিংবা উপমহাদেশের অন্যত্র অনেক উঁচুতে ওঠার স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের অবস্থা এখনো তথৈবচ। সেখানে এলিট শ্রেণী ক্ষমতায়; এবং ওই এলিট শ্রেণীর অন্য একটি অংশ বিরোধী দলে। এমনকি মানবাধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাও পাকিস্তানের সামন্ত শ্রেণী থেকে আসা মানুষ। সে জন্য সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তাঁরা যত বড় বড় কথাই বলুন না কেন, এর কোনো প্রভাব আমরা পাকিস্তানি সমাজে দেখতে পাই না। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় এই শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে আমি প্রথম ধাক্কাটি খেলাম। আমার মনে পড়ল আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথা, যিনি বামপন্থী দীক্ষায় দীক্ষিত এবং পরবর্তীকালে সুপিরিয়র সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে পাকিস্তানে উচ্চতর আমলা হয়েছেন। তাঁর কাছে শুনেছিলাম, তাঁদের প্রশিক্ষণের শুরুতেই পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ এলাকায় একটি হতদরিদ্র গ্রাম দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যখন তাঁরা মেঠো রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন, তখন অজস্র প্রজা শ্রেণীর মানুষ রাস্তায় মাথা ঠেকিয়ে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছিল। এ ধরনের একটি দৃশ্য আমাদের বাংলাদেশের সমাজে কল্পনাই করা যায় না।
যা হোক, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই করাচিতে এসেছিলাম। ইচ্ছা ছিল আমার সব শোক-জরা এবং সদ্যঃসমাপ্ত লেখাপড়ার চাপ থেকে পালানো। এটা করাচিতে এসে সম্ভব হয়েছিল কিয়দংশে। কিছুদিনের মধ্যেই শহরটি মনে ধরে গেল। করাচির একটি আকর্ষণ ছিল, যা একজন তরুণের মনোরঞ্জনে সহায়তা করে। সেই বয়সে সর্বদাই নারীর প্রতি আকর্ষণ তীব্র হয়। এটাই স্বাভাবিক। করাচির রাস্তাঘাটে কিংবা বিপণিবিতানগুলোতে যেসব মেয়েকে দেখতাম, তারা অতি সুন্দরী। মনে হতো, এরা রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ নয়। ভালো যে লাগত, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ওটা তো সব কিছুই ভালো লাগার বয়স। ক্যাপ্টেন নাসির হায়দারের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর গেলাম আমার আরেক মামা আলিম আহমেদ চৌধুরীর বাড়িতে থাকতে। তিনি প্রভূত অর্থ উপার্জন করে করাচির উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর বেশ কিছু শিল্প-কারখানাও ছিল। তা ছাড়া পাকিস্তানের অগ্রণী দু-একটি ব্যাংকের তিনি পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়িটিও ছিল প্রাসাদোপম। এই বাড়িতে থাকার সময় আমি করাচির কিছু অবস্থাপন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই। এর আগে এমন প্রাচুর্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। এসব উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যে কেউ কেউ বাঙালিও ছিলেন। তাঁরা অবশ্য সচরাচর উর্দু অথবা ইংরেজিতেই কথা বলতেন। ভাবতাম, যষ্মিন দেশে যদাচার। এখানেও বেশিদিন থাকা হলো না। আমি আমার পুরনো স্যুটকেস আর সামান্য কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে উঠলাম জাহাঙ্গীর রোড নামের একটি জায়গায়, সরকারি কোয়ার্টারে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
যা হোক, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই করাচিতে এসেছিলাম। ইচ্ছা ছিল আমার সব শোক-জরা এবং সদ্যঃসমাপ্ত লেখাপড়ার চাপ থেকে পালানো। এটা করাচিতে এসে সম্ভব হয়েছিল কিয়দংশে। কিছুদিনের মধ্যেই শহরটি মনে ধরে গেল। করাচির একটি আকর্ষণ ছিল, যা একজন তরুণের মনোরঞ্জনে সহায়তা করে। সেই বয়সে সর্বদাই নারীর প্রতি আকর্ষণ তীব্র হয়। এটাই স্বাভাবিক। করাচির রাস্তাঘাটে কিংবা বিপণিবিতানগুলোতে যেসব মেয়েকে দেখতাম, তারা অতি সুন্দরী। মনে হতো, এরা রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ নয়। ভালো যে লাগত, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ওটা তো সব কিছুই ভালো লাগার বয়স। ক্যাপ্টেন নাসির হায়দারের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর গেলাম আমার আরেক মামা আলিম আহমেদ চৌধুরীর বাড়িতে থাকতে। তিনি প্রভূত অর্থ উপার্জন করে করাচির উচ্চ শ্রেণীভুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর বেশ কিছু শিল্প-কারখানাও ছিল। তা ছাড়া পাকিস্তানের অগ্রণী দু-একটি ব্যাংকের তিনি পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়িটিও ছিল প্রাসাদোপম। এই বাড়িতে থাকার সময় আমি করাচির কিছু অবস্থাপন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই। এর আগে এমন প্রাচুর্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। এসব উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যে কেউ কেউ বাঙালিও ছিলেন। তাঁরা অবশ্য সচরাচর উর্দু অথবা ইংরেজিতেই কথা বলতেন। ভাবতাম, যষ্মিন দেশে যদাচার। এখানেও বেশিদিন থাকা হলো না। আমি আমার পুরনো স্যুটকেস আর সামান্য কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে উঠলাম জাহাঙ্গীর রোড নামের একটি জায়গায়, সরকারি কোয়ার্টারে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments