বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে উঠবে কবে-চট্টগ্রাম by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

ট্টগ্রাম। নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা 'গ্রাম' শব্দটিই যেন এর নিয়তিকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। বাণিজ্যিক রাজধানী নামের জামা তার গায়ে পরিয়ে দিয়েছে সব সরকারই; কিন্তু শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম একটি নাগরিক কোলাহলময় গ্রামই থেকেছে, যেটি সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী অথবা দ্বিতীয় রাজধানী হয়ে উঠতে পারেনি আজ অবধি।গ্রামের মানুষ সবসময় সুবোধ আর সরল হয়। রাজনীতির হাজারো মারপ্যাঁচ গ্রামের মানুষের বোধগম্যের বাইরে।


চট্টগ্রামের মানুষের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা বলা চলে। খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা দু'জনেই সরকার গঠনের পূর্বে ও পরে প্রতিবারই চট্টগ্রামে এসে লালদীঘির মাঠে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীতে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন অনেকবার। পত্রপত্রিকায় অভিনন্দন, কিছুদিন হৈচৈয়ের পর প্রতিবারই চাটগাঁর মানুষ ফিরে গেছে তাদের দৈনন্দিন জীবনে : চাষি লাঙল নিয়ে মাঠে, জেলে নৌকা নিয়ে সমুদ্রে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়। তারপর সবাই সবকিছু ভুলে গেছেন। বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে ওঠার জন্য চট্টগ্রামের কী কী দরকার? তার কতটুকু হয়েছে? কতটুকু শেষ পর্যন্ত হবে? সেসব খবর তারা রাখেননি। কখনও কখনও চট্টগ্রামের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র আগ্রাবাদ দিয়ে যেতে যেতে, হয়তো দু'একটি উঁচু চকচকে ভবন দেখে চাটগাঁবাসীর চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। এই দুই বা তিনটি উঁচু বিল্ডিং, চকচকে ভবন দেখে তারা ভেবেছেন তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু কখনও ঘুণাক্ষরেও তারা বুঝতে পারেননি যে, ঘুম পাড়িয়ে নয় বরং জাগ্রত অবস্থায়, সরকার চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে তাদের। আজ অবধি প্রতিটি সরকারের উদ্যোগ আর আয়োজন কোনোটা দেখেই মনে করতে পারি না যে, হাজার বছরের পুরনো এবং বয়স্ক 'চট্টগ্রাম' সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে উঠতে পারবে। বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার জন্য একটি শহরের অনেক গুণের দরকার হয়। তার প্রায় সবই চাটগাঁর আছে। তার আছে বিরাট বন্দর, যেটি দিয়ে দেশের আমদানি আর রফতানির সিংহভাগই হয়, যেটি দেশের রাজস্বের অন্যতম জোগানদারও।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই রাজধানী হয়ে ওঠে তার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। সেটিও চট্টগ্রামের আছে। সারাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হয় খাতুনগঞ্জ আর আছদগঞ্জ থেকে।
বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার জন্য সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটিও জড়িত। চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে গেছে এশিয়ান হাইওয়ে, যার মাধ্যমে সারাদেশ ও এশিয়া যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের সঙ্গে। এছাড়াও চট্টগ্রামের রয়েছে শিল্পবান্ধব ইপিজেড ও অবকাঠামোগত অন্যান্য সুবিধা।
অপরদিকে বিদেশি বিনিয়োগ বা বিদেশি ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ করার জন্য বাণিজ্যিক রাজধানীকে হতে হয় মনোরম, সুশোভিত আর সুশৃঙ্খল। পাহাড় আর সমুদ্রে ঘেরা, মায়াবী চট্টগ্রাম শহরের চেয়ে কোন সুন্দর শহরটি আছে বাংলাদেশে? দ্বিতীয়টি সম্ভবত নেই। সবই আছে কিন্তু তারপরও বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে উঠতে পারেনি চট্টগ্রাম। কারণ বাণিজ্যিক রাজধানী করার জন্য আরও যা যা করা দরকার, তার কোনোটি কোনো সরকারই করেনি। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটি হচ্ছে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ। এই বিকেন্দ্রীকরণ তো আগাছা নয় যে, নিজে নিজেই জন্ম নিয়ে, অযত্ন-অবহেলায় বিকাশ লাভ করবে। এই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হয় সরকারকে, যেসব লোক সরকারি প্রশাসন যন্ত্রে আছেন, তাদেরকে।
প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হয় এ জন্য যে, ব্যবসা বা অর্থনৈতিক সব কর্মকাণ্ডে ঢাকামুখী হতে হবে না, চট্টগ্রামে থাকবে একটি স্বনির্ভর প্রশাসনিক কাঠামো; যাতে বাণিজ্যিক রাজধানীতে বসে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালানো যায়। কিন্তু প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে আজও ঘটেনি, যে জন্য আমরা আশার জাল বুনতে পারি।
হয়েছে বরং উল্টোটা। বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য, বড় বড় করপোরেট অফিসগুলোকে চট্টগ্রামমুখী করা হয়নি। রেকিট অ্যান্ড কোলম্যান এবং লিভার ব্রাদার্সের প্রধান অফিস ছিল চট্টগ্রামে। বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা বাণিজ্য সংক্রান্ত সরকারি দফতরগুলো চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত না হওয়ায় তারা নিজেরাই বরং তাদের প্রধান অফিসকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কোনো প্রধান অফিস আজ পর্যন্ত চট্টগ্রামে হয়নি। ব্যাংকগুলোর বড় কোনো সিদ্ধান্তের জন্য ব্যাংক ম্যানেজার আর ব্যবসায়ীদের নিত্য ঢাকামুখী দৌড়াদৌড়ি করতে হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বন্দর চট্টগ্রামে থাকলেও, সিদ্ধান্তের মালিক ঢাকায় অবস্থান করা বন্দর মন্ত্রণালয়ের কর্তারা। এই হচ্ছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অবস্থা।
লেখাটি লিখতে গিয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ দিয়েছেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার প্রত্যয়টি কোথাও নাকি কোনো সরকারি কাগজপত্রে লিখিত নেই। নেই এ বিষয়ে কোনো সরকারি দফতরও। বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগ যখনই যে থাকে সরকারে, লালদীঘির মাঠে বক্তৃতা করতে এলেই চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক রাজধানী করা নিয়ে সরকারি নানা কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দেওয়া হয়। লালদীঘির ময়দানে জনসভা শেষ করে ঢাকায় ফিরে গিয়েই তারা বিষয়টি ভুলে যান।
২০০৩ খ্রিস্টাব্দে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরেরবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন-পরবর্তী লালদীঘির ময়দানে এক জনসভায় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। বিএনপির সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন খোদ চট্টগ্রামের আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যিনি চট্টগ্রামে খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কিছুই করেননি তিনি। আর এভাবে আজ প্রায় এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পথে। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করা হবে, এ রকম মুলো ঝুলিয়ে প্রতিটি সরকারই চাটগাঁবাসীর ভোট নিয়েছে কিন্তু চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী কোনো সরকারই শেষ পর্যন্ত করেনি।
ঘুমিয়ে আর জাগিয়ে আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছে চাটগাঁবাসীকে; তাই আজ আমাদের দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছে প্রশ্ন, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী সত্যি কি করা হবে? আর হলেও, তা কবে?

শাহনেওয়াজ বিপ্লব :গবেষক
ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়,অস্ট্রিয়া
shahnewazbiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.