মত ও মন্তব্য-সার্ক শীর্ষ সম্মেলন : আরেকটি বড় সুযোগ by হারুন হাবীব
পঁচিশ বছরের সার্ক এযাবৎ ১৬টি শীর্ষ সম্মেলন করেছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা, অর্থাৎ সার্কের সপ্তদশ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে চলতি মাসের ১০ ও আজ ১১ তারিখ মালদ্বীপের পর্যটননগরী আদ্দু সিটিতে। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় 'বিল্ডিং ব্রিজেস', অর্থাৎ আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা। ২৫ বছর আগে বাংলাদেশের মাটিতে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাটির জন্ম হয়েছিল প্রথম শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে।
সেই শুভক্ষণে সাংবাদিক হিসেবে প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতির কথা শুনেছিলাম আমরা সব দেশের শীর্ষ নেতার মুখ থেকে। আমাদের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দীর্ঘ লালিত সংকটের দিকে তাকিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভেবেছিলাম, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা যৌথ জীবনের মঙ্গল কামনায় অতীতের সব কষ্টকালিমা বিনাশ করতে পারব। কিন্তু তা আজও দুরাশায় পড়ে আছে। আমরা খুব একটা এগোতে পারিনি। আজ যখন সপ্তদশ শীর্ষ সম্মেলন বসছে, তখন আবারও আশায় বুক বাঁধতে হচ্ছে। আশা করি, আমরা একত্রে এগোনোর নতুন প্রত্যয় অর্জন করতে পারব।
১৯৮৫ সালে ঢাকায় যখন সার্কের জন্ম হয়, তখন এর সদস্যসংখ্যা ছিল সাত_বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ। সম্প্রতি আফগানিস্তান এসে যোগ দেওয়ায় সদস্যসংখ্যা আটে দাঁড়িয়েছে। আটটি দেশের সম্মিলিত সংস্থা, বলতে গেলে গোটা দক্ষিণ এশিয়াই এর মধ্যে, অর্থাৎ সার্ক গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ সংস্থা। আরো একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এবার চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ কয়েকটি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা পর্যবেক্ষক হিসেবে সম্মেলনে যোগ দেবে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, মালদ্বীপে এবারের শীর্ষ সম্মেলনটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হবে। জেনেছি, অতীত ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আট জাতির শীর্ষ নেতারা এবার আঞ্চলিক সংস্থাটিকে একটি কার্যকর সংস্থায় পরিণত করার ওপর গুরুত্ব দেবেন। সতি সত্যি যদি তা হয়, তাহলে মানুষ উপকৃত হবে, আমাদের অঞ্চল উপকৃত হবে।
এবারের শীর্ষ সম্মেলনের বেশ কয়েকটি গুরুত্ব বা তাৎপর্য আছে। প্রথমত, প্রথমবারের মতো এবারই সার্কভুক্ত সব দেশে গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। অনেককাল এ রকম গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল না। সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। এমনকি পাকিস্তানেও গণতান্ত্রিক সরকার অধিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কারণে সার্ককে কার্যকর আঞ্চলিক সংস্থায় রূপ দিতে সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে_এ আশা করাই যায়। দ্বিতীয়ত, এবারের সার্ক সম্মেলনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, সার্ক বীজ ব্যাংক গঠন এবং পণ্যের মান সস্তা ও নিশ্চিতকরণে আঞ্চলিক সহযোগিতাবিষয়ক তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে বলে জানা গেছে। এসবের বাইরে যা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত, তা হচ্ছে 'কানেকটিভিটি' বা আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো। বরাবরের মতোই বিষয়টি এবারের সম্মেলনে অন্তর্ভুক্ত। আশা করব, কেবল প্রথাগতই নয়, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে কার্যকরভাবে 'সেতুবন্ধ' রচনার বিষয়টি সত্যিকারভাবেই গুরুত্ব লাভ করবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে ভূখণ্ডগতভাবে যুক্ত; এরা প্রায় একই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। এ অঞ্চলের মানুষ একদিকে যেমন ইতিহাসের অনেক অত্যাচার ও পাপ বহন করেছে, ইতিহাসের অনেক গৌরবময়, শ্রদ্ধেয় অধ্যায়ের অংশীদারও এরা। কাজেই পুরনো পঙ্কিলতা ও সন্দেহ-অবিশ্বাসের দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের অবসান জরুরি; জরুরি সৌহার্দ্যের নব অধ্যায়ের সূচনা করা। এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা যেন পরস্পরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে না রাখি, এতে কারো কল্যাণ নেই।
অনেককাল আমরা মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম; এ অঞ্চলের মানুষের কয়েকটি প্রজন্ম পরস্পরের শত্রু হয়ে জন্মেছে, শত্রু হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আমাদের সৌভাগ্য, নতুন প্রজন্মের একটি তাৎপর্যময় অংশ নতুন উপলব্ধিতে ভাস্বর হয়েছে; এরা ইতিহাসের পাপের বোঝা বহন করার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। শীর্ষ রাজনীতিবিদদের উচিত নতুন প্রজন্মের এই নতুন উপলব্ধি আরো বেশি শাণিত করা, তাদের চেতনাকে যতটা বেশি সম্ভব মানবতাবাদী করা।
জানতে পেরেছি, সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার লক্ষ্যে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি জনগণের মধ্যে আরো নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার ব্যাপারে সার্ক নেতাদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা আসবে। আশা করব, এই দিকনির্দেশনা কার্যকরভাবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে শান্তি ও সৌহার্দ্যের সুবাতাস বইবার সুযোগ সৃষ্টি করবে। জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাস দমন, মুক্ত বাণিজ্য, ভিসামুক্ত চলাচল এবং মানবপাচার প্রতিরোধ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা এ অঞ্চলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সম্মেলনে যোগ দেবে উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। জানা গেছে, শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও দুই প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে আলোচনা করবেন। গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় অমীমাংসিত থাকা বিষয়গুলো নিয়েও মালদ্বীপে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হতে পারে_এমন আভাস পাওয়া গেছে।
পাকিস্তান অতিসম্প্রতি ভারতকে তার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে 'মোস্ট ফেভার্ট নেশন'-এর মর্যাদা দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। শুধু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নন, এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। সম্পর্ক উন্নয়নের এ ধরনের পারস্পরিক সদিচ্ছা দুই দেশের ঐতিহ্যগত সন্দেহ-অবিশ্বাসের কালিমা অনেকটাই নিরসন করতে পারে বলে আমার ধারণা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়াকে কেন্দ্র করে দুই দেশেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিংয়ের ওই সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহনও হতাশা প্রকাশ করে চুক্তি না হওয়াটা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। এই ব্যর্থতা দুই দেশের সম্ভাবনার সম্পর্ককে যথেষ্টই বাধাগ্রস্ত করেছে। যাঁরা ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের গভীরতা চান না, নানা কারণে তাঁরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন। কাজেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সচেতন হওয়ার কারণ আছে।
গত সেপ্টেম্বরের পর বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত থাকলেও দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে মতবিনিময়ের নতুন কোনো সুযোগ ঘটেনি। তিস্তা নিয়ে তেমন কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মত পরিবর্তন করেছেন বলেও শোনা যায়নি। তবে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। অতিসম্প্রতি জানা গেছে, তাঁর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস শাসক জোট ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স বা ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার চিন্তা করছে। এসব নিতান্তই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়, যাতে বাইরের কারো কিছু করার নেই। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট দুই দেশের বহুলপ্রত্যাশিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
আশা করব, ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘকাল পর নতুন যে সম্পর্ক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে, আধুনিকতা ও মানবিকতার স্বার্থে, প্রগতি ও সৌহাদ্র্যের স্বার্থে সে সম্পর্ককে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে হবে। হোঁচট, বাধা বা প্রতিবন্ধকতা আসবেই, কিন্তু সব বাধা, হোঁচট বা প্রতিবন্ধকতা টপকে সামনে এগোনোর সাহস দেখাতে হবে শীর্ষ রাজনীতিবিদদেরই। কারণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে রাজনীতিবিদরাই মুখ্য, মুখ্য তাঁদের বিবেচনাশক্তি ও প্রাজ্ঞ বিবেচনা। ইত্যাদি কারণেই মালদ্বীপের শীর্ষ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ও মহমোহন সিং যখন একসঙ্গে হবেন, তখন প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার জরুরি। খোলা মনে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার নতুন প্রত্যয় জরুরি। আশা করি, তাঁরা ব্যর্থ হবেন না।
সর্বান্তঃকরণে আশা করব, মালদ্বীপের মাটিতে সপ্তদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন সফল হবে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্যের নতুন বাতাবরণ তৈরিতে অতীতের বাধা এবং সন্দেহ-অবিশ্বাসের প্রাচীর সরাতে হবে, যৌথ জীবন যাপনের সভ্য সংস্কৃতি অর্জন করতে হবে। মনে রাখা উচিত, যে ইউরোপ যুগের পর যুগ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সেই ইউরোপ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো 'আসিয়ান' স্থাপনের মাধ্যমে কার্যকর সহযোগিতা স্থাপন করেছে, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলো আঞ্চলিক সংস্থা গঠনের মাধ্যমে পরস্পরের অনেক কাছে এসেছে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যেন আর বিভাজিত না হই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক
hh1971@gmail.com
১৯৮৫ সালে ঢাকায় যখন সার্কের জন্ম হয়, তখন এর সদস্যসংখ্যা ছিল সাত_বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ। সম্প্রতি আফগানিস্তান এসে যোগ দেওয়ায় সদস্যসংখ্যা আটে দাঁড়িয়েছে। আটটি দেশের সম্মিলিত সংস্থা, বলতে গেলে গোটা দক্ষিণ এশিয়াই এর মধ্যে, অর্থাৎ সার্ক গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ সংস্থা। আরো একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এবার চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ কয়েকটি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা পর্যবেক্ষক হিসেবে সম্মেলনে যোগ দেবে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, মালদ্বীপে এবারের শীর্ষ সম্মেলনটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হবে। জেনেছি, অতীত ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আট জাতির শীর্ষ নেতারা এবার আঞ্চলিক সংস্থাটিকে একটি কার্যকর সংস্থায় পরিণত করার ওপর গুরুত্ব দেবেন। সতি সত্যি যদি তা হয়, তাহলে মানুষ উপকৃত হবে, আমাদের অঞ্চল উপকৃত হবে।
এবারের শীর্ষ সম্মেলনের বেশ কয়েকটি গুরুত্ব বা তাৎপর্য আছে। প্রথমত, প্রথমবারের মতো এবারই সার্কভুক্ত সব দেশে গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। অনেককাল এ রকম গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল না। সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। এমনকি পাকিস্তানেও গণতান্ত্রিক সরকার অধিষ্ঠিত হয়েছে। এসব কারণে সার্ককে কার্যকর আঞ্চলিক সংস্থায় রূপ দিতে সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে_এ আশা করাই যায়। দ্বিতীয়ত, এবারের সার্ক সম্মেলনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, সার্ক বীজ ব্যাংক গঠন এবং পণ্যের মান সস্তা ও নিশ্চিতকরণে আঞ্চলিক সহযোগিতাবিষয়ক তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে বলে জানা গেছে। এসবের বাইরে যা আলোচনার অন্তর্ভুক্ত, তা হচ্ছে 'কানেকটিভিটি' বা আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো। বরাবরের মতোই বিষয়টি এবারের সম্মেলনে অন্তর্ভুক্ত। আশা করব, কেবল প্রথাগতই নয়, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে কার্যকরভাবে 'সেতুবন্ধ' রচনার বিষয়টি সত্যিকারভাবেই গুরুত্ব লাভ করবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে ভূখণ্ডগতভাবে যুক্ত; এরা প্রায় একই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। এ অঞ্চলের মানুষ একদিকে যেমন ইতিহাসের অনেক অত্যাচার ও পাপ বহন করেছে, ইতিহাসের অনেক গৌরবময়, শ্রদ্ধেয় অধ্যায়ের অংশীদারও এরা। কাজেই পুরনো পঙ্কিলতা ও সন্দেহ-অবিশ্বাসের দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের অবসান জরুরি; জরুরি সৌহার্দ্যের নব অধ্যায়ের সূচনা করা। এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা যেন পরস্পরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে না রাখি, এতে কারো কল্যাণ নেই।
অনেককাল আমরা মুখ ঘুরিয়ে ছিলাম; এ অঞ্চলের মানুষের কয়েকটি প্রজন্ম পরস্পরের শত্রু হয়ে জন্মেছে, শত্রু হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আমাদের সৌভাগ্য, নতুন প্রজন্মের একটি তাৎপর্যময় অংশ নতুন উপলব্ধিতে ভাস্বর হয়েছে; এরা ইতিহাসের পাপের বোঝা বহন করার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। শীর্ষ রাজনীতিবিদদের উচিত নতুন প্রজন্মের এই নতুন উপলব্ধি আরো বেশি শাণিত করা, তাদের চেতনাকে যতটা বেশি সম্ভব মানবতাবাদী করা।
জানতে পেরেছি, সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার লক্ষ্যে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি জনগণের মধ্যে আরো নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার ব্যাপারে সার্ক নেতাদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা আসবে। আশা করব, এই দিকনির্দেশনা কার্যকরভাবে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে শান্তি ও সৌহার্দ্যের সুবাতাস বইবার সুযোগ সৃষ্টি করবে। জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাস দমন, মুক্ত বাণিজ্য, ভিসামুক্ত চলাচল এবং মানবপাচার প্রতিরোধ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা এ অঞ্চলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সম্মেলনে যোগ দেবে উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। জানা গেছে, শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও দুই প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে আলোচনা করবেন। গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় অমীমাংসিত থাকা বিষয়গুলো নিয়েও মালদ্বীপে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হতে পারে_এমন আভাস পাওয়া গেছে।
পাকিস্তান অতিসম্প্রতি ভারতকে তার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে 'মোস্ট ফেভার্ট নেশন'-এর মর্যাদা দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। শুধু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নন, এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। সম্পর্ক উন্নয়নের এ ধরনের পারস্পরিক সদিচ্ছা দুই দেশের ঐতিহ্যগত সন্দেহ-অবিশ্বাসের কালিমা অনেকটাই নিরসন করতে পারে বলে আমার ধারণা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়াকে কেন্দ্র করে দুই দেশেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিংয়ের ওই সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহনও হতাশা প্রকাশ করে চুক্তি না হওয়াটা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। এই ব্যর্থতা দুই দেশের সম্ভাবনার সম্পর্ককে যথেষ্টই বাধাগ্রস্ত করেছে। যাঁরা ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের গভীরতা চান না, নানা কারণে তাঁরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন। কাজেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সচেতন হওয়ার কারণ আছে।
গত সেপ্টেম্বরের পর বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত থাকলেও দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে মতবিনিময়ের নতুন কোনো সুযোগ ঘটেনি। তিস্তা নিয়ে তেমন কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মত পরিবর্তন করেছেন বলেও শোনা যায়নি। তবে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। অতিসম্প্রতি জানা গেছে, তাঁর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস শাসক জোট ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স বা ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার চিন্তা করছে। এসব নিতান্তই দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়, যাতে বাইরের কারো কিছু করার নেই। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট দুই দেশের বহুলপ্রত্যাশিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
আশা করব, ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘকাল পর নতুন যে সম্পর্ক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে, আধুনিকতা ও মানবিকতার স্বার্থে, প্রগতি ও সৌহাদ্র্যের স্বার্থে সে সম্পর্ককে যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে হবে। হোঁচট, বাধা বা প্রতিবন্ধকতা আসবেই, কিন্তু সব বাধা, হোঁচট বা প্রতিবন্ধকতা টপকে সামনে এগোনোর সাহস দেখাতে হবে শীর্ষ রাজনীতিবিদদেরই। কারণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে রাজনীতিবিদরাই মুখ্য, মুখ্য তাঁদের বিবেচনাশক্তি ও প্রাজ্ঞ বিবেচনা। ইত্যাদি কারণেই মালদ্বীপের শীর্ষ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ও মহমোহন সিং যখন একসঙ্গে হবেন, তখন প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার জরুরি। খোলা মনে সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার নতুন প্রত্যয় জরুরি। আশা করি, তাঁরা ব্যর্থ হবেন না।
সর্বান্তঃকরণে আশা করব, মালদ্বীপের মাটিতে সপ্তদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন সফল হবে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্যের নতুন বাতাবরণ তৈরিতে অতীতের বাধা এবং সন্দেহ-অবিশ্বাসের প্রাচীর সরাতে হবে, যৌথ জীবন যাপনের সভ্য সংস্কৃতি অর্জন করতে হবে। মনে রাখা উচিত, যে ইউরোপ যুগের পর যুগ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সেই ইউরোপ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো 'আসিয়ান' স্থাপনের মাধ্যমে কার্যকর সহযোগিতা স্থাপন করেছে, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলো আঞ্চলিক সংস্থা গঠনের মাধ্যমে পরস্পরের অনেক কাছে এসেছে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যেন আর বিভাজিত না হই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক
hh1971@gmail.com
No comments