অর্থনীতি কেমন চলছে-সমকালীন প্রসঙ্গ by মামুন রশীদ
কিছুদিন আগে একটি ইংরেজি দৈনিকের এক তরুণ সাংবাদিক আমাদের প্রতিষ্ঠান আয়োজিত এক অনুষ্ঠান কভার করতে আসেন। নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা আগেই তিনি এসে পেঁৗছান। বদৌলতে খানিকটা আলাপও হয়। সে সুবাদে জানলাম যে, তার সাংবাদিকতার বয়স প্রায় বছরচারেক হলেও রিপোর্টিংয়ে এসেছেন মাত্র মাসচারেক এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়া একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করেছেন।
নবীন রিপোর্টার বন্ধুটি বেশ আগ্রহ নিয়ে আমার কাছে জানতে চান, 'দেশের অর্থনীতি কী এখন খুব খারাপ চলছে?' তার প্রশ্নের কারণ হলো_ একদিকে অর্থমন্ত্রী বলছেন, কিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালোই আছে; অন্যদিকে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলেছেন, পরিস্থিতি খুবই সঙ্গিন।
সদ্য সাংবাদিকতায় আসা তরুণ বন্ধুটি আমি 'ইন্সট্যান্ট কফি'র মতো ঝটপট কোনো জবাব দিতে পারিনি, ঠিক যেমনটি সাধারণত 'এভারেডি ব্যাটারির' মতো তৈরি হয়ে থাকা আমাদের কতিপয় সব জান্তা অর্থনীতিবিদ হুট করেই দিয়ে থাকেন। তবে হ্যাঁ, আমি জানি যে অর্থনীতিতে বর্তমানে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে মূল্যস্টম্ফীতি বেড়ে গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, আমদানি ব্যয় ও সেবা খাতের ব্যয় বাড়ছে; অন্যদিকে রফতানি আয় ও অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ ধীরলয়ে হলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাজস্ব আদায়ও মোটামুটি ভালো। তবে বৈদেশিক সাহায্য অবমুক্তকরণের পরিমাণ ও জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কম হওয়ায় সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত আগস্ট পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য জুতসই অবস্থায় ছিল। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি তেল আমদানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লেনদেনের ভারসাম্যে বেশ প্রভাব পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে যারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ বলে দাবি করেন তাদের সঙ্গে আমি অবশ্য একমত নই। কারণ, এ ধরনের বক্তব্যে একটি ভুল সংকেত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বরং আমি বলব যে, ব্যবস্থাপনায় কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হলেও সমপর্যায়ের অপরাপর দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি সম্ভাবনার লক্ষণ দেখিয়ে এবং অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে। প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের বা বিকাশমান দেশগুলোতে চাল, আটা ও চিনির মতো নিত্যপণ্যগুলোর দাম বর্তমানে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। তবে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতে মূল্যস্টম্ফীতি উচ্চপর্যায়ে থাকলেও তাদের অর্থনীতিতে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রায় তিন বছর পরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্প্র্রতি এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৯৮৮ কোটি ডলারে। গত ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি বিল বাবদ ৩ হাজার ৮০০ ডলার পরিশোধ করেছে। তবে এ ব্যয়ের অধিকাংশই গেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল এবং রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি তেল আমদানির পেছনে। তাই এটাকে ভালো লক্ষণ বলতে হবে। তেল আমদানিতে প্রচুর অর্থ গেলেও কৃষি খাতে ভালো ফলনের সুবাদে খাদ্য আমদানি বাবদ ব্যয় হচ্ছে বেশ কম। সে জন্য কৃষিমন্ত্রী ও কৃষকদের ধন্যবাদ জানাই। তবে আমাদের এখন সম্ভবত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানেই এ ধরনের কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণটা যদি হয় স্বল্পমেয়াদি এবং বিদেশি ঋণ ও সহায়তা বাড়ার সুবাদে তা অর্থবছর শেষে যদি কমে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেমে আসে, তাহলে বিষয়টি নিয়ে আমি খুব বিচলিত হবো না। তবে সরকারি ব্যয়ে শৃঙ্খলা বজায় রেখে তদারকি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রফতানি আয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার (১৫ শতাংশ) চেয়ে ঠিক দেড়গুণ। অন্যদিকে আলোচ্য তিন মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে অবশ্য দেশে মূল্যস্টম্ফীতির চাপ বাড়তে পারে কিংবা বর্তমান মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে হলে উন্নয়ন সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে সরকারকে জোর দিতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের সন্তুষ্টি বিধানেও নিতে হবে প্রায়োগিক পদক্ষেপ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ার কারণে স্থানীয় টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাচ্ছে। গত ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় টাকার মূল্যমান ৭ শতাংশ কমেছে, সেখানে চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে তা দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০১০ সালের ৩০ জুন যেখানে প্রতি মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৬৯ টাকা ৫০ পয়সা সেখানে এই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে ৭৪ টাকা ২৪ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। তবে কার্ব মার্কেট বা অনানুষ্ঠানিক বাজারে সম্প্রতি প্রতি ডলার ৭৯ টাকা ২০ পয়সায় কেনাবেচা হচ্ছে। দেশের অনেক নাগরিকের বিদেশে সম্পদ ক্রয়, ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঘন ঘন সৌদি আরবের পবিত্র শহরগুলোতে যাওয়া ও অবাধে বিদেশ ভ্রমণ এবং ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য বিদেশ পাঠানোর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় কার্ব মার্কেট বা অনানুষ্ঠানিক বাজারে ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বিদেশ থেকে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধিতে কিছুটা মন্থরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি অর্থবছরে প্রবাসী-আয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে প্রবাসী-আয়ে ১৫ শতাংশ হয়েছে বটে, তবে সেপ্টেম্বরে এসে তা আবার কমেছে। ঈদের কারণে অবশ্য অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসায় এবং কুয়ালালামপুর-ঢাকার মধ্যে আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ায় অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক সহায়তা না পাওয়া পর্যন্ত এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি অর্জনের পথে পরিচালিত করা বেশ কষ্টসাধ্য হবে বৈকি!
সব দিক বিবেচনা করলে বর্তমান সময়টাকে বাংলাদেশের জন্য কঠিনই বলা যায়। তবে ব্যবস্থাপনায় ঠিকমতো দক্ষতা দেখাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে আমি মনে করি। এ জন্য অবশ্য বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো ও নীতি-সংস্কার অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তার ইস্যুতে জোর দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার চেয়ে 'সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা' অর্জনের ওপরই সরকারের বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে অর্থনীতি নিয়ে আমাদের পরীক্ষিত ও সজ্জন বন্ধুদের সঙ্গে প্রয়োজনে আবার আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। নিয়ন্ত্রকদেরও যখন-তখন এদিক-ওদিকের যেই-সেই কথায় কান না দিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের এখনকার সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম হয় দেশের, অর্থনীতির ও আগামী প্রজন্তের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে, নয়তো ধূলিসাৎ করে দেবে। সে জন্য আমাদের নিবিড় গবেষণা, সুচিন্তিত কর্মোদ্যোগ এবং জাতীয় রাজনীতিতে ঐক্যের ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। যাতে আবেগের বাইরে গিয়ে দেশকে উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে উন্নীত করা
সম্ভব হয়।
মামুন রশীদ :ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
mamun1960@gmail.com
সদ্য সাংবাদিকতায় আসা তরুণ বন্ধুটি আমি 'ইন্সট্যান্ট কফি'র মতো ঝটপট কোনো জবাব দিতে পারিনি, ঠিক যেমনটি সাধারণত 'এভারেডি ব্যাটারির' মতো তৈরি হয়ে থাকা আমাদের কতিপয় সব জান্তা অর্থনীতিবিদ হুট করেই দিয়ে থাকেন। তবে হ্যাঁ, আমি জানি যে অর্থনীতিতে বর্তমানে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে মূল্যস্টম্ফীতি বেড়ে গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, আমদানি ব্যয় ও সেবা খাতের ব্যয় বাড়ছে; অন্যদিকে রফতানি আয় ও অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ ধীরলয়ে হলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাজস্ব আদায়ও মোটামুটি ভালো। তবে বৈদেশিক সাহায্য অবমুক্তকরণের পরিমাণ ও জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কম হওয়ায় সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত আগস্ট পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য জুতসই অবস্থায় ছিল। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি তেল আমদানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লেনদেনের ভারসাম্যে বেশ প্রভাব পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে যারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ বলে দাবি করেন তাদের সঙ্গে আমি অবশ্য একমত নই। কারণ, এ ধরনের বক্তব্যে একটি ভুল সংকেত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বরং আমি বলব যে, ব্যবস্থাপনায় কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হলেও সমপর্যায়ের অপরাপর দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি সম্ভাবনার লক্ষণ দেখিয়ে এবং অগ্রগতি অর্জন করে চলেছে। প্রতিবেশী ও সমপর্যায়ের বা বিকাশমান দেশগুলোতে চাল, আটা ও চিনির মতো নিত্যপণ্যগুলোর দাম বর্তমানে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। তবে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতে মূল্যস্টম্ফীতি উচ্চপর্যায়ে থাকলেও তাদের অর্থনীতিতে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রায় তিন বছর পরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্প্র্রতি এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৯৮৮ কোটি ডলারে। গত ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ আমদানি বিল বাবদ ৩ হাজার ৮০০ ডলার পরিশোধ করেছে। তবে এ ব্যয়ের অধিকাংশই গেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল এবং রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জ্বালানি তেল আমদানির পেছনে। তাই এটাকে ভালো লক্ষণ বলতে হবে। তেল আমদানিতে প্রচুর অর্থ গেলেও কৃষি খাতে ভালো ফলনের সুবাদে খাদ্য আমদানি বাবদ ব্যয় হচ্ছে বেশ কম। সে জন্য কৃষিমন্ত্রী ও কৃষকদের ধন্যবাদ জানাই। তবে আমাদের এখন সম্ভবত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানেই এ ধরনের কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণটা যদি হয় স্বল্পমেয়াদি এবং বিদেশি ঋণ ও সহায়তা বাড়ার সুবাদে তা অর্থবছর শেষে যদি কমে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেমে আসে, তাহলে বিষয়টি নিয়ে আমি খুব বিচলিত হবো না। তবে সরকারি ব্যয়ে শৃঙ্খলা বজায় রেখে তদারকি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রফতানি আয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার (১৫ শতাংশ) চেয়ে ঠিক দেড়গুণ। অন্যদিকে আলোচ্য তিন মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে অবশ্য দেশে মূল্যস্টম্ফীতির চাপ বাড়তে পারে কিংবা বর্তমান মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে হলে উন্নয়ন সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে সরকারকে জোর দিতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের সন্তুষ্টি বিধানেও নিতে হবে প্রায়োগিক পদক্ষেপ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ার কারণে স্থানীয় টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাচ্ছে। গত ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় টাকার মূল্যমান ৭ শতাংশ কমেছে, সেখানে চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে তা দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০১০ সালের ৩০ জুন যেখানে প্রতি মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৬৯ টাকা ৫০ পয়সা সেখানে এই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর তা বেড়ে ৭৪ টাকা ২৪ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। তবে কার্ব মার্কেট বা অনানুষ্ঠানিক বাজারে সম্প্রতি প্রতি ডলার ৭৯ টাকা ২০ পয়সায় কেনাবেচা হচ্ছে। দেশের অনেক নাগরিকের বিদেশে সম্পদ ক্রয়, ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঘন ঘন সৌদি আরবের পবিত্র শহরগুলোতে যাওয়া ও অবাধে বিদেশ ভ্রমণ এবং ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য বিদেশ পাঠানোর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় কার্ব মার্কেট বা অনানুষ্ঠানিক বাজারে ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বিদেশ থেকে দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধিতে কিছুটা মন্থরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি অর্থবছরে প্রবাসী-আয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে প্রবাসী-আয়ে ১৫ শতাংশ হয়েছে বটে, তবে সেপ্টেম্বরে এসে তা আবার কমেছে। ঈদের কারণে অবশ্য অন্তর্মুখী রেমিট্যান্স বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসায় এবং কুয়ালালামপুর-ঢাকার মধ্যে আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ায় অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক সহায়তা না পাওয়া পর্যন্ত এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি অর্জনের পথে পরিচালিত করা বেশ কষ্টসাধ্য হবে বৈকি!
সব দিক বিবেচনা করলে বর্তমান সময়টাকে বাংলাদেশের জন্য কঠিনই বলা যায়। তবে ব্যবস্থাপনায় ঠিকমতো দক্ষতা দেখাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে আমি মনে করি। এ জন্য অবশ্য বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো ও নীতি-সংস্কার অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তার ইস্যুতে জোর দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার চেয়ে 'সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা' অর্জনের ওপরই সরকারের বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে অর্থনীতি নিয়ে আমাদের পরীক্ষিত ও সজ্জন বন্ধুদের সঙ্গে প্রয়োজনে আবার আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। নিয়ন্ত্রকদেরও যখন-তখন এদিক-ওদিকের যেই-সেই কথায় কান না দিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের এখনকার সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম হয় দেশের, অর্থনীতির ও আগামী প্রজন্তের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে, নয়তো ধূলিসাৎ করে দেবে। সে জন্য আমাদের নিবিড় গবেষণা, সুচিন্তিত কর্মোদ্যোগ এবং জাতীয় রাজনীতিতে ঐক্যের ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে। যাতে আবেগের বাইরে গিয়ে দেশকে উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে উন্নীত করা
সম্ভব হয়।
মামুন রশীদ :ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
mamun1960@gmail.com
No comments