লিবিয়ার শ্রমবাজারে পুনঃপ্রবেশের সুযোগ by হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ
পশ্চিমাদের সহায়তায় আট মাস ধরে লিবিয়ায় চলছিল রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। একদিকে ছিল মুয়াম্মার গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী, অন্যদিকে জাতীয় অন্তর্বর্তী পরিষদ (এনটিসি)। এই গৃহযুদ্ধের সূচনা হয় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। শেষমেশ 'লৌহমানব'খ্যাত মুয়াম্মার গাদ্দাফির নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধের আপাত সমাপ্তি ঘটেছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে গাদ্দাফির যে শাসন চলছিল, তারও আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি হয়েছে।
একটি রক্তাক্ত পথ ধরেই লিবিয়ায় এখন নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখছে সে দেশের মানুষ। বলা হচ্ছে, দ্রুতই এ দেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, গাদ্দাফি যুগের অবসানের মধ্য দিয়ে একনায়কতন্ত্র লিবিয়া থেকে উচ্ছেদ হলেও যেভাবে গণতন্ত্রের প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তা খুব সহজ নয়। কেননা সামনের দিনে অন্তর্বর্তী পরিষদকে নতুন সংবিধান রচনা এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এসব খুব সহজ কাজ নয়। আবার এর চেয়েও কঠিন যে কাজটি রয়েছে সেটা হলো, যে ব্যাপক অস্ত্র বিভিন্ন গ্রুপ অর্থাৎ দল-উপদলের হাতে রয়েছে, তা উদ্ধার করা। পশ্চিমারাও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তবে সব মিলিয়ে নতুন এক মুক্ত লিবিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছে বললে ভুল হবে না।
এদিকে গত আট মাসের গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছিল। তেলখনিগুলো আগের মতো সচল ছিল না। আগের তুলনায় উৎপাদনও কমে এসেছিল কয়েক গুণ। এক হিসাবে প্রতিদিন আগে গড়ে ১৬ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদিত হতো। কিন্তু সেই উৎপাদন কমে চার লাখ ৩০ হাজার ব্যারেলে নেমে এসেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলক্ষেত্রগুলোতে সেই স্বাভাবিক উৎপাদন ফিরিয়ে আনতে গেলে বিদেশি কম্পানিগুলোকে যেমন ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি লোকবলের সম্মিলনও ঘটাতে হবে। গত আট মাসের গৃহযুদ্ধে লিবিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি অবকাঠামোরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাট যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি বড় অনেক বহুতল ভবন নষ্ট অথবা ধ্বংস হয়েছে। বিভিন্ন খামার, কল-কারখানাও নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া বিশাল বিশাল তেল শোধনাগারেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে হলে সব কিছুই এখন নতুন করে গড়তে হবে লিবিয়াকে। আয়তনের দিক দিয়ে লিবিয়া আফ্রিকার চতুর্থ দেশ, আর পৃথিবীর মধ্যে সপ্তদশ। ১৯৫১ সালে এ দেশ পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। একসময় এ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকলেও অঢেল তেল দ্রুত তাদের ভাগ্য বদলে দেয়। আর এই ধারাবাহিকতায় তরতর করে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বে শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে ওঠে লিবিয়া। গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়া অনেক দিক দিয়েই অগ্রসর হয়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করে দেশটি। এখনো এ দেশের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তাদের তেল প্রাচুর্য, যদিও গত আট মাসের গৃহযুদ্ধে তাদের তেল সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
আশির দশকে লিবিয়ায় আমাদের শ্রমবাজার তৈরি হয়। সে সময় হাজার হাজার তরুণ কাজ নিয়ে লিবিয়ায় যায় এবং বেশির ভাগ শ্রমিকই সেখানে চাকরি করে তাদের ভাগ্য ফেরাতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক লিবিয়ায় কাজ করার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে সে দেশে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে এবং চারদিকে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা। প্রথম প্রথম বাংলাদেশের শ্রমিকরা শত ঝুঁকি নিয়েও সে দেশে থাকতে চাইলে চারদিক থেকে নানামুখী চাপ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়লে শ্রমিকরা আরো নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খল বিদ্রোহীদের হাতে বেশ কয়েকজন বাঙালি শ্রমিক হতাহত হয়। অনেক শ্রমিক বিভিন্ন জায়গায় নানাভাবে অপদস্থেরও শিকার হয়। একধরনের আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় শ্রমিকরা সব কিছু ত্যাগ করে যেকোনো মূল্যে দেশে ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার শ্রমিক সব কিছু হারিয়ে চোখের পানি সম্বল করে আইওএম ও সরকারি সহায়তায় মিসর ও তিউনিসিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্বদেশভূমিতে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি কোরিয়ান কম্পানি তাদের নিজস্ব খরচে শ্রমিকদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে প্রশংসিত হয়।
লিবিয়া পুনর্গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়ায় নতুন করে সে দেশে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, অচিরেই এক বিরাট শ্রমবাজার তৈরি হবে সে দেশে। কারণ লিবিয়াকে পুনর্গঠন করতে, উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে সে দেশে এখন লাখ লাখ দক্ষ-আধা দক্ষ বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে। লিবিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে তাই নতুন করে সরকারসহ সবার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সবাই সতর্ক দৃষ্টিও রাখছে। এখানে বলা প্রয়োজন, লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নিমিত্তে আগে বেশ কয়েকবার দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছিল। কিন্তু এবার লিবিয়া পুনর্গঠনে বাংলাদেশের শ্রমিকদের পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার কী ভূমিকা পালন করতে পারবে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। আমরা মনে করি, এখনই সরকারের পক্ষ থেকে লিবিয়ার সঙ্গে আরো বেশি যোগাযোগে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কেননা লিবিয়ায় শ্রমশক্তি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হলে সরকারকে কিছু বিষয় সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন যেসব শ্রমিক দেশে ফিরে আসে তাদের আগের কর্মস্থলে পুনরায় পাঠাতে লিবিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসকে সংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বভাবতই কিছুটা অভিজ্ঞ এসব শ্রমিক স্থিতিশীল লিবিয়ায় আবার নিজ কম্পানিতে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে। উল্লেখ্য, যেসব কম্পানি স্ব-উদ্যোগে লিবিয়া থেকে আমাদের কর্মীদের দেশের মাটিতে ফেরত আনে তাদের কৃতজ্ঞতাপত্র দিয়ে আবার তাদের আগের কর্মস্থলে ফেরত নিতে অনুরোধপত্র দেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে আগামী ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসে আড়ম্বর অনুষ্ঠানে ওই সব কম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মান দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনকৃত ওই অনুষ্ঠানে জব ফেয়ার আয়োজনের মাধ্যমে লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশের চাকরিদাতা কম্পানিগুলোকে অংশগ্রহণের অনুরোধ করা যেতে পারে। জানা গেছে, ইতিমধ্যে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও সচিব ড. জাফর আহমেদ খান আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস উপলক্ষে নানামুখী আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। তবে একই সঙ্গে লিবিয়ার শ্রমবাজারে পুনরায় প্রবেশের প্রাক্কালে সরকারকে অভিবাসন খরচের দিকে কঠিন নজরদারি রাখতে হবে।
আমরা বরাবরই দেখেছি, যখনই বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের নতুন কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখনই কথিত একটি গোষ্ঠী অভিবাসী হতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের কাছ থেকে নানা কৌশলে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকে। ফলে একজন শ্রমিক ভিটাবাড়ি বা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ করে বিদেশে যায়, সেই মূল টাকা তোলাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্যই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে বিষয়টি শক্ত হাতে দমন করতে তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে রিসিভিং কান্ট্রির এজেন্টরা যাতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে না পারে সে ব্যাপারেও আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের প্রতি অনুরোধ করতে হবে। এদিকে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করার পরও আমাদের দূতাবাসগুলো এখনো শক্তিশালী করা হয়নি। বিশেষ করে যেসব দেশে বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করে সেসব দেশের শ্রমিকরা কিন্তু এই অভিযোগটি বরাবরই অব্যাহত রেখেছে। লিবিয়া আমাদের জন্য মোটেও নতুন কোনো কর্মক্ষেত্র নয়। আগেই বলেছি, সেই সত্তরের দশকে আমাদের শ্রমিকরা লিবিয়ায় কাজ শুরু করে। ফলে আমাদের কাছে দেশটি চেনা ও পরিচিত। এ দেশের আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন ও সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের শ্রমিকদের কমবেশি পরিচয় রয়েছে। এ ছাড়া লিবিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কও খারাপ নয়। তাই লিবিয়ার শ্রমবাজারে অবশ্যই আমাদের প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। চারদিকে প্রতিনিয়ত বেকারত্বের যে জট, তা আরো জটিল হবে যদি না লিবিয়া, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে আবার আমাদের শ্রমিক রপ্তানির চিত্র উজ্জ্বল করতে না পারি। তাই এখনই সময় জনশক্তি রপ্তানির সার্বিক বিষয় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
লেখক : জনশক্তি বিশ্লেষক এবং চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com
এদিকে গত আট মাসের গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছিল। তেলখনিগুলো আগের মতো সচল ছিল না। আগের তুলনায় উৎপাদনও কমে এসেছিল কয়েক গুণ। এক হিসাবে প্রতিদিন আগে গড়ে ১৬ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদিত হতো। কিন্তু সেই উৎপাদন কমে চার লাখ ৩০ হাজার ব্যারেলে নেমে এসেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলক্ষেত্রগুলোতে সেই স্বাভাবিক উৎপাদন ফিরিয়ে আনতে গেলে বিদেশি কম্পানিগুলোকে যেমন ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি লোকবলের সম্মিলনও ঘটাতে হবে। গত আট মাসের গৃহযুদ্ধে লিবিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি অবকাঠামোরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাট যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি বড় অনেক বহুতল ভবন নষ্ট অথবা ধ্বংস হয়েছে। বিভিন্ন খামার, কল-কারখানাও নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া বিশাল বিশাল তেল শোধনাগারেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে হলে সব কিছুই এখন নতুন করে গড়তে হবে লিবিয়াকে। আয়তনের দিক দিয়ে লিবিয়া আফ্রিকার চতুর্থ দেশ, আর পৃথিবীর মধ্যে সপ্তদশ। ১৯৫১ সালে এ দেশ পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। একসময় এ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকলেও অঢেল তেল দ্রুত তাদের ভাগ্য বদলে দেয়। আর এই ধারাবাহিকতায় তরতর করে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বে শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে ওঠে লিবিয়া। গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়া অনেক দিক দিয়েই অগ্রসর হয়। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করে দেশটি। এখনো এ দেশের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তাদের তেল প্রাচুর্য, যদিও গত আট মাসের গৃহযুদ্ধে তাদের তেল সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
আশির দশকে লিবিয়ায় আমাদের শ্রমবাজার তৈরি হয়। সে সময় হাজার হাজার তরুণ কাজ নিয়ে লিবিয়ায় যায় এবং বেশির ভাগ শ্রমিকই সেখানে চাকরি করে তাদের ভাগ্য ফেরাতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক লিবিয়ায় কাজ করার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে সে দেশে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে এবং চারদিকে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা। প্রথম প্রথম বাংলাদেশের শ্রমিকরা শত ঝুঁকি নিয়েও সে দেশে থাকতে চাইলে চারদিক থেকে নানামুখী চাপ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়লে শ্রমিকরা আরো নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খল বিদ্রোহীদের হাতে বেশ কয়েকজন বাঙালি শ্রমিক হতাহত হয়। অনেক শ্রমিক বিভিন্ন জায়গায় নানাভাবে অপদস্থেরও শিকার হয়। একধরনের আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় শ্রমিকরা সব কিছু ত্যাগ করে যেকোনো মূল্যে দেশে ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার শ্রমিক সব কিছু হারিয়ে চোখের পানি সম্বল করে আইওএম ও সরকারি সহায়তায় মিসর ও তিউনিসিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্বদেশভূমিতে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি কোরিয়ান কম্পানি তাদের নিজস্ব খরচে শ্রমিকদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে প্রশংসিত হয়।
লিবিয়া পুনর্গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়ায় নতুন করে সে দেশে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, অচিরেই এক বিরাট শ্রমবাজার তৈরি হবে সে দেশে। কারণ লিবিয়াকে পুনর্গঠন করতে, উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে সে দেশে এখন লাখ লাখ দক্ষ-আধা দক্ষ বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে। লিবিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে তাই নতুন করে সরকারসহ সবার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সবাই সতর্ক দৃষ্টিও রাখছে। এখানে বলা প্রয়োজন, লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নিমিত্তে আগে বেশ কয়েকবার দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও হয়েছিল। কিন্তু এবার লিবিয়া পুনর্গঠনে বাংলাদেশের শ্রমিকদের পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার কী ভূমিকা পালন করতে পারবে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। আমরা মনে করি, এখনই সরকারের পক্ষ থেকে লিবিয়ার সঙ্গে আরো বেশি যোগাযোগে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কেননা লিবিয়ায় শ্রমশক্তি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হলে সরকারকে কিছু বিষয় সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন যেসব শ্রমিক দেশে ফিরে আসে তাদের আগের কর্মস্থলে পুনরায় পাঠাতে লিবিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসকে সংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বভাবতই কিছুটা অভিজ্ঞ এসব শ্রমিক স্থিতিশীল লিবিয়ায় আবার নিজ কম্পানিতে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে। উল্লেখ্য, যেসব কম্পানি স্ব-উদ্যোগে লিবিয়া থেকে আমাদের কর্মীদের দেশের মাটিতে ফেরত আনে তাদের কৃতজ্ঞতাপত্র দিয়ে আবার তাদের আগের কর্মস্থলে ফেরত নিতে অনুরোধপত্র দেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে আগামী ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসে আড়ম্বর অনুষ্ঠানে ওই সব কম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মান দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনকৃত ওই অনুষ্ঠানে জব ফেয়ার আয়োজনের মাধ্যমে লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশের চাকরিদাতা কম্পানিগুলোকে অংশগ্রহণের অনুরোধ করা যেতে পারে। জানা গেছে, ইতিমধ্যে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও সচিব ড. জাফর আহমেদ খান আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস উপলক্ষে নানামুখী আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। তবে একই সঙ্গে লিবিয়ার শ্রমবাজারে পুনরায় প্রবেশের প্রাক্কালে সরকারকে অভিবাসন খরচের দিকে কঠিন নজরদারি রাখতে হবে।
আমরা বরাবরই দেখেছি, যখনই বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের নতুন কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখনই কথিত একটি গোষ্ঠী অভিবাসী হতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের কাছ থেকে নানা কৌশলে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকে। ফলে একজন শ্রমিক ভিটাবাড়ি বা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ করে বিদেশে যায়, সেই মূল টাকা তোলাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্যই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে বিষয়টি শক্ত হাতে দমন করতে তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে রিসিভিং কান্ট্রির এজেন্টরা যাতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে না পারে সে ব্যাপারেও আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের প্রতি অনুরোধ করতে হবে। এদিকে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করার পরও আমাদের দূতাবাসগুলো এখনো শক্তিশালী করা হয়নি। বিশেষ করে যেসব দেশে বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করে সেসব দেশের শ্রমিকরা কিন্তু এই অভিযোগটি বরাবরই অব্যাহত রেখেছে। লিবিয়া আমাদের জন্য মোটেও নতুন কোনো কর্মক্ষেত্র নয়। আগেই বলেছি, সেই সত্তরের দশকে আমাদের শ্রমিকরা লিবিয়ায় কাজ শুরু করে। ফলে আমাদের কাছে দেশটি চেনা ও পরিচিত। এ দেশের আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন ও সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের শ্রমিকদের কমবেশি পরিচয় রয়েছে। এ ছাড়া লিবিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কও খারাপ নয়। তাই লিবিয়ার শ্রমবাজারে অবশ্যই আমাদের প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। চারদিকে প্রতিনিয়ত বেকারত্বের যে জট, তা আরো জটিল হবে যদি না লিবিয়া, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে আবার আমাদের শ্রমিক রপ্তানির চিত্র উজ্জ্বল করতে না পারি। তাই এখনই সময় জনশক্তি রপ্তানির সার্বিক বিষয় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
লেখক : জনশক্তি বিশ্লেষক এবং চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com
No comments