জ্বালানির জ্বালা by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
কোরবানির ঈদের আনন্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আবারও মূল্যবৃদ্ধির কোপ পড়ল আমজনতার ঘাড়ে! ১০ নভেম্বর মাঝরাত থেকে এক ধাক্কায় ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম পাঁচ টাকা করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সরকার চলতি বছরই ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম তিনবার এবং ফার্নেস অয়েলের দাম চারবার বাড়িয়েছে।
এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানির মধ্যে সিএনজির দাম দুবার এবং বিদ্যুতের দাম দুবার করে বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ আর সিএনজির দাম আরো এক ধাপ বাড়ানো হতে পারে বলে এরই মধ্যে পত্রিকাগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে। জ্বালানির এই ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। কারণ জ্বালানি তেলের সঙ্গে যেহেতু ভোগ্যপণ্য ও পরিবহন খাতের খরচ সম্পর্কিত, তাই এর পুরো খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।
এমনিতেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। চাল, ডাল, তেল, লবন, মাছ, মাংস, শাকসবজিসমেত সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী বললে আজ কিছুই বলা হয় না। বলতে হয় আগুন! কোনো কিছুতে হাত ঠেকানো যায় না! এমন দাম যে তার হলকায় হাত-মুখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম! অগি্নমূল্যের এই বাজারের তাপ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে! আর সেই আগুনে পুড়ছে সাধারণ মানুষের ঘর-সংসার! ঘরপোড়া মানুষ এই অবাধ মূল্যবৃদ্ধির চক্রে আরো এক দফা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে। মূল্যবৃদ্ধির গতি কত দিনে, কিভাবে রোধ করা যাবে, তার কোনো ইতিবাচক আশ্বাস কোথাও নেই। নীতিনির্ধারকদের অর্থনীতির কপচানি শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধি আটকাতে মূল্যবৃদ্ধিই যেন সরকারের হাতিয়ার! তাদের মতটা হচ্ছে_বিশ্ববাজারে পেট্রপণ্যের দাম বাড়ছে, তা সামাল দিতে দেশে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়াও। ডলারের হিসাবে টাকার দাম পড়ে গেলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়াও। যেহেতু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, তাহলে রিজার্ভ ব্যাংক সুদ বাড়াও! রিজার্ভ ব্যাংক সুদ বাড়িয়েছে? তাহলে আর কী! হোম লোন, কার লোন, পার্সোনাল লোন_সব লোনে সুদের হারও বাড়াও! চিন্তা কী? এসব বাড়াওয়ের বোঝা তো দেশের সামর্থ্যবানদের বইতে হবে না। বওয়ার জন্য দেশের লক্ষ-কোটি সাধারণ মানুষ আছে! তাদের পকেট ঝেড়েপুঁছে সব নিয়ে নাও। এতে মানুষ যদি চটে, চটুক না। ভোট ছাড়া পাবলিককে কিসের প্রয়োজন? ভোট আসুক তখন দেখা যাবে। তখন কিছু একটা ভুজুং-ভাজুং দিয়ে ওদের ঠিকই দলে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে। এখন এসব ভাবনা ভেবে লাভ নেই। এখন মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে বাঁচতে তেল কম্পানি এবং সরকারের কাছের জনদের তুষ্ট রাখতে দাম বাড়াতেই হবে। অথচ জিনিসপত্রের দাম আয়ত্তে রাখতে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারই ভতুর্কি দিয়ে এসেছে।
কারো কারো ভাবগতিক দেখে মনে হয় যে তারা একাই দেশটা চালাচ্ছেন। তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে সরকারের উচিত ছিল আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করা। এ বৈঠক থেকে সরকার কী কী কারণে, কেন, কোন অজুহাতে এবং কোন খাতের কারণে তেলের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, তা জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের অবশ্যই কিছু নীতিমালা থাকতে হবে। কিন্তু সরকার এখন সমন্বয়হীনভাবে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক যেটি, এর প্রভাবে যে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে, তার জন্য সরকারের কোনো মাথাব্যথাই নেই।
বরং মূল্যবৃদ্ধির চাপ জনগণ কতটা সইতে পারে সে পরীক্ষায় যেন নেমেছে সরকার। তাদের ভাবখানাই এমন যে দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভাবার চেয়ে বরং তারা যেন পরীক্ষা করতে চাইছে মূল্যবৃদ্ধির চাপ দেশের সাধারণ মানুষ কতটা সইতে পারে! অর্থাৎ সরকারের এ বিষয়ে করার কিছু নেই; মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে সাধারণ জনতাকেই সেই শক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির পথ খুঁজে বের করতে হবে! জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগি্নমূল্য অথবা পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি_সব সামলে কিভাবে তোমাদের সংসার বাঁচাবে, সেটা তোমাদেরই ঠিক করতে হবে! কেউ তোমাদের পাশে নেই, ভোট ছাড়া কেউ খোঁজও করবে না তোমাদের। সুতরাং মনের দুশ্চিন্তা মনে রেখে দুমুঠো ভাত-কাপড়ের লড়াইটা তোমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। সরকারের মুখ চেয়ে থাকলে চলবে না!
অথচ শেয়ারবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া কালো টাকার কারবারিদের স্পর্শ করলেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ভর্তুকিটা জোগাড় হয়ে যায়, এ সহজ সত্যিটুকু বুঝতে সরকার একটু বেশি সময় নিচ্ছে কি?
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ,
ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া।
ব-সধরষ :shshnewazbiplob@hotmail.com
এমনিতেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। চাল, ডাল, তেল, লবন, মাছ, মাংস, শাকসবজিসমেত সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী বললে আজ কিছুই বলা হয় না। বলতে হয় আগুন! কোনো কিছুতে হাত ঠেকানো যায় না! এমন দাম যে তার হলকায় হাত-মুখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম! অগি্নমূল্যের এই বাজারের তাপ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে! আর সেই আগুনে পুড়ছে সাধারণ মানুষের ঘর-সংসার! ঘরপোড়া মানুষ এই অবাধ মূল্যবৃদ্ধির চক্রে আরো এক দফা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে। মূল্যবৃদ্ধির গতি কত দিনে, কিভাবে রোধ করা যাবে, তার কোনো ইতিবাচক আশ্বাস কোথাও নেই। নীতিনির্ধারকদের অর্থনীতির কপচানি শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধি আটকাতে মূল্যবৃদ্ধিই যেন সরকারের হাতিয়ার! তাদের মতটা হচ্ছে_বিশ্ববাজারে পেট্রপণ্যের দাম বাড়ছে, তা সামাল দিতে দেশে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়াও। ডলারের হিসাবে টাকার দাম পড়ে গেলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়াও। যেহেতু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, তাহলে রিজার্ভ ব্যাংক সুদ বাড়াও! রিজার্ভ ব্যাংক সুদ বাড়িয়েছে? তাহলে আর কী! হোম লোন, কার লোন, পার্সোনাল লোন_সব লোনে সুদের হারও বাড়াও! চিন্তা কী? এসব বাড়াওয়ের বোঝা তো দেশের সামর্থ্যবানদের বইতে হবে না। বওয়ার জন্য দেশের লক্ষ-কোটি সাধারণ মানুষ আছে! তাদের পকেট ঝেড়েপুঁছে সব নিয়ে নাও। এতে মানুষ যদি চটে, চটুক না। ভোট ছাড়া পাবলিককে কিসের প্রয়োজন? ভোট আসুক তখন দেখা যাবে। তখন কিছু একটা ভুজুং-ভাজুং দিয়ে ওদের ঠিকই দলে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে। এখন এসব ভাবনা ভেবে লাভ নেই। এখন মূল্যবৃদ্ধির হাত থেকে বাঁচতে তেল কম্পানি এবং সরকারের কাছের জনদের তুষ্ট রাখতে দাম বাড়াতেই হবে। অথচ জিনিসপত্রের দাম আয়ত্তে রাখতে স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারই ভতুর্কি দিয়ে এসেছে।
কারো কারো ভাবগতিক দেখে মনে হয় যে তারা একাই দেশটা চালাচ্ছেন। তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে সরকারের উচিত ছিল আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করা। এ বৈঠক থেকে সরকার কী কী কারণে, কেন, কোন অজুহাতে এবং কোন খাতের কারণে তেলের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে, তা জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের অবশ্যই কিছু নীতিমালা থাকতে হবে। কিন্তু সরকার এখন সমন্বয়হীনভাবে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক যেটি, এর প্রভাবে যে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে, তার জন্য সরকারের কোনো মাথাব্যথাই নেই।
বরং মূল্যবৃদ্ধির চাপ জনগণ কতটা সইতে পারে সে পরীক্ষায় যেন নেমেছে সরকার। তাদের ভাবখানাই এমন যে দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভাবার চেয়ে বরং তারা যেন পরীক্ষা করতে চাইছে মূল্যবৃদ্ধির চাপ দেশের সাধারণ মানুষ কতটা সইতে পারে! অর্থাৎ সরকারের এ বিষয়ে করার কিছু নেই; মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে সাধারণ জনতাকেই সেই শক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির পথ খুঁজে বের করতে হবে! জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অগি্নমূল্য অথবা পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি_সব সামলে কিভাবে তোমাদের সংসার বাঁচাবে, সেটা তোমাদেরই ঠিক করতে হবে! কেউ তোমাদের পাশে নেই, ভোট ছাড়া কেউ খোঁজও করবে না তোমাদের। সুতরাং মনের দুশ্চিন্তা মনে রেখে দুমুঠো ভাত-কাপড়ের লড়াইটা তোমাদের চালিয়ে যেতেই হবে। সরকারের মুখ চেয়ে থাকলে চলবে না!
অথচ শেয়ারবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া কালো টাকার কারবারিদের স্পর্শ করলেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ভর্তুকিটা জোগাড় হয়ে যায়, এ সহজ সত্যিটুকু বুঝতে সরকার একটু বেশি সময় নিচ্ছে কি?
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ,
ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া।
ব-সধরষ :shshnewazbiplob@hotmail.com
No comments