মৌলিক পরিবর্তনমুখী সম্ভাবনা-ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন by ডেভিড গ্রেবার
কেন মানুষজন দখল করছেন ওয়ালস্ট্রিট? সর্বশেষ পুলিশি ক্র্যাকডাউন সত্ত্বেও কেন এই দখল মাত্র কয়েক দিনে আমেরিকাজুড়ে বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে? শত শত মানুষকে কেন তা অনুপ্রাণিত করছে পিৎজা, টাকাপয়সা, যন্ত্রপাতি পাঠাতে? আর এখন, কেন তা মানুষজনকে অনুপ্রাণিত করছে শিকাগো দখল করো, ফ্লোরিডা দখল করো, ডেনভার দখল করো বা লস অ্যাঞ্জেলেস দখল করো নামে তাদের নিজেদের আন্দোলন শুরু করতে?
স্বতঃস্পষ্ট কারণ আছে এসবের। নতুন প্রজন্মের মার্কিনিদের অবাধ্য আত্মনির্ভরতার শুরুটা দেখছি আমরা। এটা এমন একটা প্রজন্ম যারা তাদের লেখাপড়া শেষ করতে চলেছে কোনো চাকরি, কোনো ভবিষ্যতের আশা ছাড়াই। উপরন্তু তারা জর্জরিত হয়ে আছেন বিপুল পরিমাণ ঋণে_ ক্ষমার অযোগ্য যে ঋণ। এদের বেশিরভাগই শ্রমজীবী শ্রেণী থেকে বা অন্যবিধ গরিবি হালের পারিবারিক পটভূমি থেকে আসা। যা যা তাদের করা উচিত বলে বলা হয়েছিল, ঠিক তাই তাই করেছিলেন এ তরুণরা। তারা লেখাপড়া করেছিলেন, কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, আর এখন সেসব করার জন্য তারা স্রেফ শাস্তি তো পাচ্ছেনই, আরও পাচ্ছেন অবজ্ঞা-অপমান। এমন এক জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে তারা, যে জীবনকে মনে করা হয় অলস, হতাশ, ঋণখেলাপির জীবন; হাস্যকর নীতিহীনের জীবন।
এটা কি তবে অবাক করার মতো ব্যাপার যে এবার তারা কথাবার্তা বলতে চাইবেন অর্থকড়ির সেসব রাঘববোয়াল সম্পর্কে, যারা চুরি করে নিয়ে গেছে তাদের ভবিষ্যৎ?
ঠিক ইউরোপের মতোই, প্রকাণ্ড সামাজিক ব্যর্থতার পরিণাম দেখছি আমরা। দখল-আন্দোলনকারীরা ঠিক সেই পদের মানুষ যারা ভাবনা-কল্পনায় ভরপুর। যে কোনো সুস্থ সমাজ তার প্রত্যেকটা মানুষের জীবন উন্নত করে তোলার ক্ষেত্রে এদের শক্তি-সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে চাইবে। অথচ এটাকে তারা ব্যবহার করছেন পুরো সিস্টেমটার পতন ঘটানোর উপায় উদ্ভাবনের কাজে।
কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থতাটা এখানে কল্পনাপ্রতিভার ব্যর্থতা। যা আমরা আজ নিজের চোখে দেখছি, তাকে একটা দাবি হিসেবেও দেখা যেতে পারে: শেষ পর্যন্ত একটা আলাপ-আলোচনায় বসার দাবি। এই আলাপ-আলোচনায় আমাদের সকলের বসার কথা ছিল সেই ২০০৮ সালে। পৃথিবীর অর্থকড়ি সংক্রান্ত স্থাপত্য-কাঠামো প্রায়-ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরের সেই মুহূর্তটা ছিল এমন একটা মুহূর্ত, যখন যে কোনো কিছুই সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল।
বিগত দশকজুড়ে যা যা আমাদের বলা হয়েছে তার সমস্তটাই মিথ্যাকথা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বাজার নিজে নিজেকে চালায়নি। অর্থকড়ি বিষয়ক পদ্ধতি-প্রণালিগুলোর স্রষ্টাগণ অভ্রান্ত মহাপণ্ডিত ছিলেন না এবং ঋণ আসলে পরিশোধ করা লাগেনি। প্রকৃতপক্ষে টাকাপয়সা নিজেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেখা গেছে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার এক রাতে অস্তিত্বমান হয়ে উঠতে পারে বা হাওয়া হয়ে যেতে পারে, যদি সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সে রকমটা চায়। এমনকি ইকোনমিস্ট পত্রিকাও এ রকম শিরোনাম দিচ্ছিল_ 'পুঁজিবাদ : এটা কি কোনো ভালো আইডিয়া?'
মনে হচ্ছিল যেন সময় এসেছে সবকিছু নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার_ বাজার, অর্থকড়ি, ঋণ সবকিছু নিয়ে। মনে হচ্ছিল সময় এসেছে এই প্রশ্ন তোলার যে, একটা 'অর্থনীতি' আসলে কিসের জন্য? এই অবস্থাটা টিকে ছিল সম্ভবত দুই সপ্তাহ। তারপর ইতিহাসের বৃহত্তম স্নায়ু-বিপর্যয়ের মধ্যে সমবেতভাবে আমরা আমাদের হাত দিয়ে ঠেসে ধরলাম আমাদের কান, আর চেষ্টা করলাম যেন আগে যা কিছু যেমন ছিল যতটা সম্ভব সে রকম জায়গায় সেগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
সম্ভবত এটা অবাক করার মতো কিছু নয়। ক্রমবর্ধমানভাবে এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, গত কয়েক দশক ধরে যারা দুনিয়া চালাচ্ছেন, পুঁজিবাদের একটা টেকসই রূপকাঠামো সৃজন করা তাদের আসল অগ্রাধিকার নয়। বরং তাদের অগ্রাধিকার হলো আমাদের এ কথা বোঝানো যে, পুঁজিবাদের চলতি আদলটাই একমাত্র বোধগম্য ব্যবস্থা; কাজেই এর কী সমস্যা আছে না আছে তা প্রাসঙ্গিক নয়। ফলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমরা সবাই ঘিরে বসে আছি, আর পুরো ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ছে।
এখন আমরা যা জেনেছি তা হলো সত্তর দশকের অর্থনৈতিক সংকট আসলে কখনোই চলে যায়নি। দেশের ভেতরে সস্তা ধারদেনা (ক্রেডিট) আর দেশের বাইরে ব্যাপক লুটতরাজ দিয়ে সংকটটাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। আর এই লুটতরাজ চালানো হয়েছিল 'তৃতীয় বিশ্বের ঋণ-সংকট'-এর নামে। কিন্তু বিশ্বের দক্ষিণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 'বিশ্বায়ন বদলাও আন্দোলন' শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে সফল হয়েছে। পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা থেকে আইএমএফ বিতাড়িত হয়েছে, ঠিক এখন যেমন তা বিতাড়িত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। পরিণামে ঋণ-সংকট এখন তার নিজের ঘরে, মানে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় ফিরে এসেছে। তা পরিপূর্ণ হয়ে আছে ঠিক সেই একই মনোভঙ্গিতে_ একটা অর্থকড়ি সংকট ঘোষণা করো; এটাকে সামলানোর জন্য আপাত-নিরপেক্ষ টেকনোক্র্যাটদের নিয়োগ করো; তারপর 'কৃচ্ছ্রতার' নামে মেতে ওঠো লুণ্ঠনের লাগামহীন আনন্দোৎসবে।
প্রতিরোধের যে আদল জেগে উঠেছে তার সঙ্গে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার আন্দোলনেরও উল্লেখযোগ্য রকমের মিল আছে। আমরা দেখছি পুরনো ধাঁচের পার্টি-রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। আমরা দেখছি, মৌলিক পরিবর্তনমুখী বৈচিত্র্যকে সেই একইভাবে আলিঙ্গন করা হচ্ছে। আমরা দেখছি, নিচ থেকে গড়ে ওঠা গণতন্ত্রের নতুন নতুন কাঠামো উদ্ভাবনের ওপর সেই একই রকম গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। যেটুকু আলাদা সেটা প্রধানত লক্ষ্যবস্তুতে। ২০০০ সালে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে গোটা গ্রহজুড়ে গড়ে ওঠা নজিরবিহীন আমলাতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে (ডবি্লউটিও, আইএমএফ, নাফটা)। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা ছিল না। স্রেফ ট্রান্সন্যাশনাল পুঁঁজির দাসত্ব করাই ছিল এগুলোর অস্তিত্বের কারণ। আর ঠিক সেই একই কারণে এবারের এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে গ্রিস, স্পেন এবং এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরো রাজনৈতিক শ্রেণীটারই বিরুদ্ধে। এই হলো সেই কারণ যে জন্য বিক্ষোভকারীরা এমনকি আনুষ্ঠানিক দাবি-দাওয়া পেশ করতে পর্যন্ত প্রায়ই ইতস্তত করছেন, পাছে তা রাজনীতিবিদদের বৈধতার স্বীকৃতি বলে গণ্য হয়_ যাদের বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
শেষ পর্যন্ত যখন ইতিহাস লিখিত হবে, তখন যদিও এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি যে, এই যাবতীয় হৈ-হট্টগোলকে (আরব বসন্ত থেকে শুরু করে) স্মরণ করা হবে মার্কিন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা-তরঙ্গমালার প্রথম পর্ব হিসেবে। তিরিশ বছর ধরে লাগাতারভাবে সারবস্তুর তুলনায় প্রচারকে গুরুত্ব দিয়ে চলাটা এবং ভিন্নমতের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে এমন যে কোনো কিছুকেই শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলাটা অবশ্য প্রতিবাদী তরুণদের ভবিষ্যৎ-প্রত্যাশাকে বিবর্ণ করে তুলতে পারে। আর এটা পরিষ্কার যে, তরুণ-যুবাদের পুরো একটা প্রজন্মকে দরকার হলে নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশের বেশিরভাগটা (যত বেশি সম্ভব) কেড়ে নিতে ধনীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু ইতিহাস তাদের পক্ষে নয়।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলোর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে বিবেচনা করে দেখলে আমাদের ভালো হবে। এই বিলুপ্তির ফলে ধনীদের পক্ষে বিস্কুট-চানাচুরের সমস্তটাই হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে তা নয়, কিন্তু সম্ভব হয়েছে আধুনিক কল্যাণ-রাষ্ট্র সৃষ্টি করাটা। এবারের পালা থেকে কী বেরিয়ে আসবে আমরা তা সুনির্দিষ্টভাবে জানি না। তবে মানবীয় কল্পনাপ্রতিভার ওপর শ্বাসরোধী যে ফাঁস গত ৩০ বছর ধরে চেপে বসে আছে, দখল-আন্দোলনকারীরা যদি শেষ পর্যন্ত তা ছিঁড়তে পারেন, যেমনটা তারা পেরেছিলেন ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর-পরবর্তী প্রথম সপ্তাহগুলোতে, সবকিছুই তাহলে আবার আলোচনার টেবিলে উঠে আসবে এবং সেটা হবে ওয়ালস্ট্রিটের এবং সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরের দখল-আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে আমাদের প্রতি দেখানো মহত্তম অনুগ্রহ_ এতটা অনুগ্রহ আমাদের আর কেউ করতে পারতেন না।
ডেভিড গ্রেবার : মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ;'ওয়ালস্ট্রিট দখল করো' আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত
গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর সেলিম রেজা
নিউটন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
এটা কি তবে অবাক করার মতো ব্যাপার যে এবার তারা কথাবার্তা বলতে চাইবেন অর্থকড়ির সেসব রাঘববোয়াল সম্পর্কে, যারা চুরি করে নিয়ে গেছে তাদের ভবিষ্যৎ?
ঠিক ইউরোপের মতোই, প্রকাণ্ড সামাজিক ব্যর্থতার পরিণাম দেখছি আমরা। দখল-আন্দোলনকারীরা ঠিক সেই পদের মানুষ যারা ভাবনা-কল্পনায় ভরপুর। যে কোনো সুস্থ সমাজ তার প্রত্যেকটা মানুষের জীবন উন্নত করে তোলার ক্ষেত্রে এদের শক্তি-সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে চাইবে। অথচ এটাকে তারা ব্যবহার করছেন পুরো সিস্টেমটার পতন ঘটানোর উপায় উদ্ভাবনের কাজে।
কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থতাটা এখানে কল্পনাপ্রতিভার ব্যর্থতা। যা আমরা আজ নিজের চোখে দেখছি, তাকে একটা দাবি হিসেবেও দেখা যেতে পারে: শেষ পর্যন্ত একটা আলাপ-আলোচনায় বসার দাবি। এই আলাপ-আলোচনায় আমাদের সকলের বসার কথা ছিল সেই ২০০৮ সালে। পৃথিবীর অর্থকড়ি সংক্রান্ত স্থাপত্য-কাঠামো প্রায়-ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরের সেই মুহূর্তটা ছিল এমন একটা মুহূর্ত, যখন যে কোনো কিছুই সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল।
বিগত দশকজুড়ে যা যা আমাদের বলা হয়েছে তার সমস্তটাই মিথ্যাকথা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বাজার নিজে নিজেকে চালায়নি। অর্থকড়ি বিষয়ক পদ্ধতি-প্রণালিগুলোর স্রষ্টাগণ অভ্রান্ত মহাপণ্ডিত ছিলেন না এবং ঋণ আসলে পরিশোধ করা লাগেনি। প্রকৃতপক্ষে টাকাপয়সা নিজেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেখা গেছে, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার এক রাতে অস্তিত্বমান হয়ে উঠতে পারে বা হাওয়া হয়ে যেতে পারে, যদি সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সে রকমটা চায়। এমনকি ইকোনমিস্ট পত্রিকাও এ রকম শিরোনাম দিচ্ছিল_ 'পুঁজিবাদ : এটা কি কোনো ভালো আইডিয়া?'
মনে হচ্ছিল যেন সময় এসেছে সবকিছু নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার_ বাজার, অর্থকড়ি, ঋণ সবকিছু নিয়ে। মনে হচ্ছিল সময় এসেছে এই প্রশ্ন তোলার যে, একটা 'অর্থনীতি' আসলে কিসের জন্য? এই অবস্থাটা টিকে ছিল সম্ভবত দুই সপ্তাহ। তারপর ইতিহাসের বৃহত্তম স্নায়ু-বিপর্যয়ের মধ্যে সমবেতভাবে আমরা আমাদের হাত দিয়ে ঠেসে ধরলাম আমাদের কান, আর চেষ্টা করলাম যেন আগে যা কিছু যেমন ছিল যতটা সম্ভব সে রকম জায়গায় সেগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
সম্ভবত এটা অবাক করার মতো কিছু নয়। ক্রমবর্ধমানভাবে এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, গত কয়েক দশক ধরে যারা দুনিয়া চালাচ্ছেন, পুঁজিবাদের একটা টেকসই রূপকাঠামো সৃজন করা তাদের আসল অগ্রাধিকার নয়। বরং তাদের অগ্রাধিকার হলো আমাদের এ কথা বোঝানো যে, পুঁজিবাদের চলতি আদলটাই একমাত্র বোধগম্য ব্যবস্থা; কাজেই এর কী সমস্যা আছে না আছে তা প্রাসঙ্গিক নয়। ফলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমরা সবাই ঘিরে বসে আছি, আর পুরো ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ছে।
এখন আমরা যা জেনেছি তা হলো সত্তর দশকের অর্থনৈতিক সংকট আসলে কখনোই চলে যায়নি। দেশের ভেতরে সস্তা ধারদেনা (ক্রেডিট) আর দেশের বাইরে ব্যাপক লুটতরাজ দিয়ে সংকটটাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। আর এই লুটতরাজ চালানো হয়েছিল 'তৃতীয় বিশ্বের ঋণ-সংকট'-এর নামে। কিন্তু বিশ্বের দক্ষিণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 'বিশ্বায়ন বদলাও আন্দোলন' শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে সফল হয়েছে। পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা থেকে আইএমএফ বিতাড়িত হয়েছে, ঠিক এখন যেমন তা বিতাড়িত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। পরিণামে ঋণ-সংকট এখন তার নিজের ঘরে, মানে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় ফিরে এসেছে। তা পরিপূর্ণ হয়ে আছে ঠিক সেই একই মনোভঙ্গিতে_ একটা অর্থকড়ি সংকট ঘোষণা করো; এটাকে সামলানোর জন্য আপাত-নিরপেক্ষ টেকনোক্র্যাটদের নিয়োগ করো; তারপর 'কৃচ্ছ্রতার' নামে মেতে ওঠো লুণ্ঠনের লাগামহীন আনন্দোৎসবে।
প্রতিরোধের যে আদল জেগে উঠেছে তার সঙ্গে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার আন্দোলনেরও উল্লেখযোগ্য রকমের মিল আছে। আমরা দেখছি পুরনো ধাঁচের পার্টি-রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। আমরা দেখছি, মৌলিক পরিবর্তনমুখী বৈচিত্র্যকে সেই একইভাবে আলিঙ্গন করা হচ্ছে। আমরা দেখছি, নিচ থেকে গড়ে ওঠা গণতন্ত্রের নতুন নতুন কাঠামো উদ্ভাবনের ওপর সেই একই রকম গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। যেটুকু আলাদা সেটা প্রধানত লক্ষ্যবস্তুতে। ২০০০ সালে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে গোটা গ্রহজুড়ে গড়ে ওঠা নজিরবিহীন আমলাতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে (ডবি্লউটিও, আইএমএফ, নাফটা)। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা ছিল না। স্রেফ ট্রান্সন্যাশনাল পুঁঁজির দাসত্ব করাই ছিল এগুলোর অস্তিত্বের কারণ। আর ঠিক সেই একই কারণে এবারের এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে গ্রিস, স্পেন এবং এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরো রাজনৈতিক শ্রেণীটারই বিরুদ্ধে। এই হলো সেই কারণ যে জন্য বিক্ষোভকারীরা এমনকি আনুষ্ঠানিক দাবি-দাওয়া পেশ করতে পর্যন্ত প্রায়ই ইতস্তত করছেন, পাছে তা রাজনীতিবিদদের বৈধতার স্বীকৃতি বলে গণ্য হয়_ যাদের বিরুদ্ধে তারা প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
শেষ পর্যন্ত যখন ইতিহাস লিখিত হবে, তখন যদিও এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি যে, এই যাবতীয় হৈ-হট্টগোলকে (আরব বসন্ত থেকে শুরু করে) স্মরণ করা হবে মার্কিন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা-তরঙ্গমালার প্রথম পর্ব হিসেবে। তিরিশ বছর ধরে লাগাতারভাবে সারবস্তুর তুলনায় প্রচারকে গুরুত্ব দিয়ে চলাটা এবং ভিন্নমতের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে এমন যে কোনো কিছুকেই শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলাটা অবশ্য প্রতিবাদী তরুণদের ভবিষ্যৎ-প্রত্যাশাকে বিবর্ণ করে তুলতে পারে। আর এটা পরিষ্কার যে, তরুণ-যুবাদের পুরো একটা প্রজন্মকে দরকার হলে নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশের বেশিরভাগটা (যত বেশি সম্ভব) কেড়ে নিতে ধনীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু ইতিহাস তাদের পক্ষে নয়।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলোর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে বিবেচনা করে দেখলে আমাদের ভালো হবে। এই বিলুপ্তির ফলে ধনীদের পক্ষে বিস্কুট-চানাচুরের সমস্তটাই হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে তা নয়, কিন্তু সম্ভব হয়েছে আধুনিক কল্যাণ-রাষ্ট্র সৃষ্টি করাটা। এবারের পালা থেকে কী বেরিয়ে আসবে আমরা তা সুনির্দিষ্টভাবে জানি না। তবে মানবীয় কল্পনাপ্রতিভার ওপর শ্বাসরোধী যে ফাঁস গত ৩০ বছর ধরে চেপে বসে আছে, দখল-আন্দোলনকারীরা যদি শেষ পর্যন্ত তা ছিঁড়তে পারেন, যেমনটা তারা পেরেছিলেন ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর-পরবর্তী প্রথম সপ্তাহগুলোতে, সবকিছুই তাহলে আবার আলোচনার টেবিলে উঠে আসবে এবং সেটা হবে ওয়ালস্ট্রিটের এবং সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরের দখল-আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে আমাদের প্রতি দেখানো মহত্তম অনুগ্রহ_ এতটা অনুগ্রহ আমাদের আর কেউ করতে পারতেন না।
ডেভিড গ্রেবার : মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ;'ওয়ালস্ট্রিট দখল করো' আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত
গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর সেলিম রেজা
নিউটন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
No comments