বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৯৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামান, বীর প্রতীক আজমপুর রেলস্টেশনে শহীদ হন তিনি কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। রাতে যুদ্ধবিরতির সময় পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ আধা ঘুমে, কেউ জেগে।


এমন সময় হঠাৎ তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। নিমেষে শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। চারদিকে বারুদের উৎকট গন্ধ, গোলাগুলিতে প্রকম্পিত।
এ রকম যুদ্ধে রক্তপাত, একাধিক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। ইবনে ফজল বদিউজ্জামান এতে বিচলিত হননি। সাহসিকতার সঙ্গে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলা করেন। সমান তালে যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। মুহুর্মুহু শেল ও রকেট এসে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আহতের সংখ্যা ক্রমে বাড়ে। তাঁদের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে সহযোদ্ধাদের মধ্যে।
আক্রমণের প্রচণ্ডতায় মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। কেউ কেউ পিছু হটে যান। এই পরিস্থিতিতে অধিনায়কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইবনে ফজল বদিউজ্জামান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেন। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে নিজের জীবন বাজি রেখে সহযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন।
তাঁর প্রচেষ্টায় সহযোদ্ধারা পুনঃসংগঠিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁদের বীরত্বে থেমে যায় বেপরোয়া পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। যুদ্ধ চলতে থাকে। সারা দিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্ত হয় আজমপুর রেলস্টেশনসহ বিরাট এক এলাকা। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে।
যুদ্ধের একপর্যায়ে ইবনে ফজল বদিউজ্জামান অগ্রভাগে থেকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। হতোদ্যম পাকিস্তানি সেনারা তখন পিছু হটছে। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একঝাঁক গুলি এসে লাগে তাঁর শরীরে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সহযোদ্ধারা উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।
এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে আখাউড়া রেলজংশনের কাছে আজমপুর রেলস্টেশনের অবস্থান। আখাউড়ার অদূরে ভারতের সীমান্ত শহর ও ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। আখাউড়া-আজমপুর ১৯৭১ সালে সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এলাকায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সেদিন যুদ্ধ চলাকালেই সহযোদ্ধারা শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামানকে সমাহিত করেন আজমপুর রেলস্টেশনের পাশেই। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত। স্বাধীনতার পর তাঁর নামে ঢাকা সেনানিবাসের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়। কয়েক বছর আগে সেই সড়কের পুনরায় নামকরণ করে ‘স্বাধীনতা সরণি’ কবা হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নবীন সেনা কর্মকর্তা (লেফটেন্যান্ট) ইবনে ফজল বদিউজ্জামান ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ২৯ ক্যাভেলরি (লঞ্চার) ইউনিটে। এর অবস্থান ছিল রংপুর সেনানিবাসে। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে কর্মরত বাঙালি দুজন সেনা কর্মকর্তা ছাড়া তাঁকেসহ অন্যান্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাকে বন্দী এবং বেশির ভাগকে পরে হত্যা করে। তবে তাঁকে হত্যা করেনি। ২ আগস্ট তিনি সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের অধীন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি ব্রাভো (বি) কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত আজমপুরের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামানকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২০।
শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামানের পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার কলেজ রামদিয়া গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বাবার নাম ফজলুর রহমান, মা হাজেরা রহমান।
সূত্র: লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইবনে ফজল সায়েখউজ্জামান (শহীদ ইবনে ফজল বদিউজ্জামান বীর প্রতীকের ছোট ভাই), মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.