হারিয়ে যাচ্ছে ডাহুক দেখা মেলা ভার ঝোপঝাড়েও by শাহীন রহমান

দ্রুত অবলুপ্তির পথে হাঁটছে ডাহুক। এক সময় গৃহস্থের বাড়ির পাশে ছোটবড় জলাশয়ে হামেশাই দেখা যেত এই ডাহুকদের। কিন্তু গ্রামীণ জনপদ, ডোবায়-ঝোপঝাড়ে আগের মতো এখন আর ডাহুক পাখির দেখা মেলে না। অসল দুপুর আর রাতের নীরবতা ভেঙ্গে ডেকে ওঠে না।


পক্ষীবিশারদদের দাবি ডাহুক দ্রুত অবলুপ্তির পথে হাঁটছে। পাখির অন্যতম আবাসস্থল দিনকে দিন সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। তাদের টিকে থাকা একেবারেই কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ডাহুক দর্শন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জলাশয়ের বিপন্নতায় গুগলি, পোকা, ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকা এই পাখিরা এখন বিলুপ্তির পথে।
পক্ষীবিশারদদের মতে, ডাহুকদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ দ্রুত নগরায়ন। অতিমাত্রায় নগরায়নের কারণে দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে জলাভূমি। ফলে ডাহুকের বসবাসের অভয়ারণ্য ও খাদ্যভা-ার শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ডাহুকের মাংস খাওয়ার প্রবণতাও হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করছে। পানিতে বা ফসলী জমিতে রাসায়নিক ব্যবহারের প্রবণতাও ডাহুকের বংশবিস্তারের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডাহুক একটি অতি পরিচিত পাখি। অত্যন্ত ভীরু ও লাজুক স্বভাবের। লেজ ছোট, পা লম্বা। ডাহুক পাখি চেনে না এমন মানুষ মেলা ভার। ডাহুক তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নিজের পরিচয় জানান দিয়ে থাকে। বর্ষকালে রাতের বেলা যখন কোয়াক কোয়াক শব্দে একনাগাড়ে ডেকে চলে তখন সবাই বুঝতে পারে ডাহুকের চেনা স্বর। জলাভূমির আশপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা এই পাখিটি দেখতে মাঝারি সাইজের। মানুষের সাড়া পেলেই লুকিয়ে পড়ে। পিঠের রং ধূসর (ফ্যাকাশে কালো) থেকে খয়েরি কালো। মাথা ও বুকের অংশ সাদা। লেজের নিচের অংশে লালচে আভা। ঠোঁটের রং হলুদ। তবে ঠোঁটের ওপরে লাল রঙে একটি ছোট্ট দাগ রয়েছে। ডাহুক খুব সুন্দর একটি পাখি। প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে থাকে ডাহুক। এদের প্রধান আশ্রয়স্থল পুকুর, খাল, জলাভূমি, বিল, নদীর লুকানো জায়গা। বেশি সময় ধরে উড়তে না পারার কারণে প্রায়ই শিকারির হাতে ধরা পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও যে গুটিকয়েক ডাহুক বেঁচে আছে তাও শিকারিদের পাতানো জালে আটকা পড়ে নিঃশেষ হতে বসেছে। গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই শিকারিরা ডাহুক ধরে বাজারে বিক্রি করছে। আইনে পাখি শিকার নিষিদ্ধ হলেও একশ্রেণীর লোক আইনের তোয়াক্কা না করে ঝোপ-ঝাড়ে ফাঁদ পেতে ডাহুক ধরে বিক্রি করছে। প্রকাশ্যে এভাবে ডাহুক বিক্রি হলেও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে গ্রামাঞ্চল থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে পরিবেশবান্ধব ডাহুক পাখি। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও পরিবেশের বন্ধু ডাহুক পাখি রক্ষার কোন বিকল্প নেই। প্রয়োজন শুধু ডাহুকের নিরাপদ বাসস্থান ও খাদ্য মজুদ এলাকাগুলো রক্ষা করা। পাশাপাশি শিকারিদের অপতৎপরতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিকারিরা ডাহুক শিকারে অনেক সময় অভিনব কৌশল অবলম্বন করে। ডাহুক যেহেতু অনেক সময় পোষও মেনে থাকে। শিকারিরা বুনো ডাহুক ধরতে পোষা ডাহুককে ব্যবহার করে থাকে। তাকে জালে বন্দী করে বর্ষায় ধান ক্ষেতে বা কখন জঙ্গলে রেখে আসে। তখন অনুগত পোষা ডাহুকের ডাকে সাড়া দিতে এসে বুনো ডাহুকটিও শিকারির জালে আটকা পড়ে। অনেক সময় ডাহুক গৃহস্থের বাড়ির পাশের জঙ্গল বা জলাশয়ে রাতের বেলা একনাগাড়ে কোয়াক কোয়াক ডেকে চলে। তার ডাক শুনে যে কেউ-ই বুঝতে পারে বা চিনে নিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরুষ ডাহুক রাতে এভাবে ডেকে থাকে। বর্ষকালে এই ডাক বেশি শোনা যায়। একটানা অনেকক্ষণ ডেকে শ্বাস নেয়। ডাহুকের স্ত্রী প্রতিশব্দ ডাহুকি। বর্তমানে ডাহুক বাংলাদেশের একটি বিপন্ন পাখি। আগের মতো এখন আর ডাহুকের কোয়াক কোয়াক ডাক শুনতে পাওয়া যায় না। প্রকৃতিতে এখন আর দেখাও মেলে না।
ডাহুক পাখি নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই। কথিত আছে ডাহুকের ডাক বিরহের সৃষ্টি করে প্রেমিকের মনে। বাংলা সাহিত্যে ডাহুক নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের অনেক মূল্যবান রচনা স্থান পেয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি জীবনানন্দ দাশ, পল্লিকবি জসীম উদ্দীনের কবিতায় বহুবার উঠে এসেছে ডাহুকের কথা। কবি ফররুখ আহমদের ডাহুক কবিতা আধ্যাত্মিক চেতনায় ডাহুকের স্থান করে দিয়েছে অনেক উর্ধে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে পাখিটি। গ্রামবাংলার খাল-বিলের জলাশয়গুলোতে ডাহুকের ডাক আর শোনা যায় না। ডাহুকের ডাক অনেকটাই বিরল হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলুপ্তির হাত থেকে ডাহুকে রক্ষা করা না গেলে প্রকৃতি অনেকটাই সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়বে।

No comments

Powered by Blogger.