মাটি খুঁড়েই ১৫ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান!- বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ, কাজ হয়নি এক ভাগও ॥ ঝুঁকিতে ফরিদপুর শহর রক্ষা বাঁধ by রাজন ভট্টাচার্য ও অভিজিৎ রায়
সড়ক উন্নয়ন কাজ শেষ হয়নি। অথচ চার-পাঁচ ভাগের এক ভাগ কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৫ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মাত্র দু’মাসে সড়কের সামান্য মাটির কাজ করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে এই পরিমাণ অর্থ। প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে কাজ। কিন্তু এ নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই।
ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে কবে নাগাদ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হবে তা অনিশ্চিত। এই অবস্থায় এলাকাবাসীর ক্ষোভের শেষ নেই। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও শহর রক্ষা বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। গোয়ালন্দ-ফরিদপুর-তারাইল সড়কের উন্নয়ন কাজ শুরু করে মাত্র দু’মাসের মাথায় রহস্যজনক কারণে বন্ধ করে দেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অল্প সময়ে সড়কের কিছু অংশে কেবল মাটির কাজ করে সাইটের অফিস ও তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে প্রায় এক বছর। সড়কটির দু’ধারে মাটির ট্রেন্স খুঁড়ে আরও বেহাল করে রেখে গেছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন। ফলে খানা-খন্দ আর বৃষ্টির পানিতে মূল সড়কটি এখন চলাচলের অযোগ্য। বিভিন্ন স্থানে কার্পেটিং উঠে গেছে। এতে যাত্রীসহ পরিবহন চলাচলে ভোগান্তির শেষ নেই। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। বিধ্বস্ত সড়কটি একই সঙ্গে ফরিদপুর শহর রক্ষার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ হওয়ায় আসন্ন বন্যায় তা টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই। স্থানীয় মোহাম্মদপুর বাজারের ব্যবসায়ী কামাল হোসেন ও নান্নু মিয়া অভিযোগ করে বলেন, দুর্নীতির কারণে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। মাঝখানে শহর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধটি এখন ঝুঁকির মধ্যে। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার দাবি জানান। চর আদমপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আজিজের বক্তব্য কিছুটা ভিন্ন। তিনি বলছেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকল্পের কাজ থামিয়ে দেয়া হয়েছে। ইসলামপুর গ্রামের বশির উদ্দিন বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির উন্নয়নের দাবি এলাকাবাসী দীর্ঘদিন থেকেই জানিয়ে আসছিল। রাস্তার কাজ শেষ হলে জেলার মানুষের যোগাযোগ ক্ষেত্রে অনেকটা পরিবর্তন আসত। কিন্তু প্রাথমিক কাজ শুরুর পর তা থেমে আছে। বাজারের ধীরাজ তালুকদার বলেন, আমাদের দাবি একটাই দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। নইলে প্রমাণিত হবে জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে এরই মধ্যে কাজের বরাদ্দ ১৫ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে কোন জবাবদিহিতা নেই। সওজের প্রকৌশলীরা বলছেন, ১৫ কোটি টাকা তুলে নেয়া হলেও কাজ হয়নি চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ অর্থের। অনেকেই বলছেন, সওজের আর্থিক বরাদ্দ না থাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় তারা কাজ বন্ধ রেখেছে। তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের না পাওয়ায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ফরিদপুর শহরতলির সিএ্যান্ডবি ঘাটের সঙ্গে গোয়ালন্দ ও কাওড়াকান্দি ফেরিঘাটের মধ্যে স্বল্পতম সময়ের যোগাযোগ স্থাপনকারী সড়ক এটি। ৬১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন শত শত যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাক, অটো টেম্পোসহ বিভিন্ন যানবাহন ও হাজার হাজার যাত্রী চলাচল করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোয়ালন্দ-দৌলতদিয়া ও কাওড়াকান্দিগামী মহাসড়কগুলোতে তীব্র যানজটের কারণে সময় ও দূরত্ব বাঁচাতে বিকল্প ও সংক্ষিপ্ততম পথ হিসেবে ফরিদপুর শহর রক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে এ সড়কটি নির্মাণের জন্য একনেকে অনুমোদিত হয় ২০১০ সালের ১৭ আগস্ট। এরপর ২০১১ সালের ১০ মে সড়কটির উন্নয়ন কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারের অবহেলায় ৬ মাস পরে ওই বছর ২৬ নবেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ মিয়া (জেভি) কার্যাদেশ পায়। দুই মাস তারা কাজ করে চলে যায়। ২০১২ সালের ১০ নবেম্বর কাজটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ বন্ধ রয়েছে প্রায় এক বছর যাবত।
এ অবস্থায় বিধ্বস্ত সড়কে চলাচল করতে গিয়ে গত ৪ এপ্রিল আদমপুর এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পার্শ্ববর্তী গভীর খাদে পড়ে একজন নিহত ও ৩০ যাত্রী আহত হয়। ৮ মে চৌধুরীডাঙ্গি এলাকায় ট্রাকের সঙ্গে টেম্পোর সংঘর্ষে ২ টেম্পোযাত্রী নিহত হয়। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন এ পথে শত শত যানবাহন ও হাজার হাজার মানুষ চলাচল করছে। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোটখাটো দুর্ঘটনা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কটির দুই ধারে ট্রেন্স খুঁড়ে রেখেছে, অপরদিকে পুরনো সড়কটির প্রায় সবটুকুতেই কার্পেটিং উঠে ভেঙ্গ-চুরে একাকার। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে দুর্ভোগ আরও চরমে পৌঁছেছে। দীর্ঘ এ সড়কের দু’পাশে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার বিস্তীর্ণ জনবসতি ও ফসলের মাঠ। সড়কটি একইসঙ্গে ফরিদপুর শহর রক্ষার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ হওয়ায় দু’পাশের জনপদগুলোতে আতঙ্ক আরও জেঁকে বসেছে। আসন্ন বন্যায় বিধ্বস্ত এই সড়ক-বাঁধটি ভেঙ্গে গেলে ব্যাপক ফসলহানি, এমনকি ফরিদপুর শহর তলিয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় সড়ক উন্নয়ন তো দূরের কথা, সড়ক-বাঁধটি টিকিয়ে রাখতেই জরুরী ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন দু’পাশের গ্রামবাসী।
ফরিদপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার রায় পরিস্থিতি স্বীকার করে জানিয়েছেন, বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ আবারও শুরু হবে।
No comments