বিশ্ব অর্থনীতি চলে যাচ্ছে চীনের নিয়ন্ত্রণে
গত এক দশকে বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে। বিশ্ববাজারে যেমন একদিকে চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্যদিকে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও টপকে গেছে ইউরোপ আমেরিকার মতো সমৃদ্ধ দেশগুলোকে। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
এক সময় অতিরিক্ত জনসংখ্যার ভারে ন্যূব্জ হয়ে পড়া এ দেশটি তার ‘দিন আনে দিন খায়’ অবস্থা কাটিয়ে কিভাবে আজ এ অবস্থায় পৌঁছুল সেটা এখন বিশেষজ্ঞদের গবেষণার বিষয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও চীনের সাফল্য ঈর্ষণীয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং বাণিজ্যের প্রধান শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর তালিকায় এর অবস্থান দ্বিতীয়। এটি বর্তমানে সর্ববৃহৎ পণ্য রফতানিকারক, সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী এবং একইসঙ্গে সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়কারী দেশ।
চীনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। আশির দশকের আগেও বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির প্রভাব ছিল খুবই নগণ্য। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও যেমন খুবই কম ছিল, তেমনি দারিদ্র্যের হারও ছিল অনেক বেশি। বিশাল আকারের জনসংখ্যার ভার সামলানো দেশটির জন্য ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ১৯৭৮ সালে গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কার নীতির পর থেকেই অবস্থা পাল্টে যেতে শুরু করে। নীতিটি সম্পর্কে তখন সমালোচনাও ছিল প্রচুর। বিশেষ করে চীনের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের হঠাৎ করে পুঁজিবাদী নীতির দিকে ঝুঁকে পড়াকে দেশটির অর্থনীতিবিদেরা ভাল চোখে দেখেননি। ঐ নীতির মাধ্যমে চীনের সরকার মুক্তবাজার অর্থনীতি অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বৈদেশিক বাণিজ্যেও বরাদ্দ রেখেছিল প্রচুর। এছাড়া কৃষকদের জন্য জমির মালিকানা এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। যার মাধ্যমে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ সরাসরি বাজারে বিক্রি করার সুযোগ পায়। এর উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল বুঝিয়ে দেয়া। দেশটির উপকূলবর্তী ৪টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা হয়েছে অর্থনৈতিক জোন। এর উদ্দেশ্য বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, রফতানি বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সংস্কারের অংশ হিসেবে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো চালানো এবং তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকারের কাছে। স্থানীয় সরকার মুক্তবাজার নীতি এবং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার নির্দেশনা অনুযায়ী সেগুলো পরিচালনা করে আসছে। সাধারণ নাগরিকদেরকে তাদের নিজ নিজ ব্যবসা পরিচালনার জন্য দেয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের প্রণোদনা। ফলাফল হিসেবে চীনের অর্থনীতিই যে শুধু লাফে লাফে এগিয়েছে তা কিন্তু নয়, দারিদ্রের হারও কমেছে অভাবিতহারে, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। ১৯৭৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত শত শত মিলিয়ন লোক মুক্তি পেয়েছে দারিদ্র্যের করালগ্রাস থেকে। সরকারী হিসাব মতে, ১৯৮১ সালে যে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৩% সেটা ২০০৫ সালে এসে কমে দাঁড়ায় ২.৫%। অন্যদিকে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির কারণে উন্নত হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা। দেশটিতে ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শিশুমৃত্যু হার কমেছে ৩৯% এবং মাতৃমৃত্যু হার কমেছে ৪১.১%। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে ২০০৯ সালের পর থেকে। এ সময়ে চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতার ময়দানে দাঁড় করিয়ে দেয়। ইউরোপকে ছাড়িয়ে গেলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রই এখন চীনের প্রধান পরাশক্তি। ইতোমধ্যে চীন তার এই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। বিশ্বের প্রধান রফতানিকারক ছাড়াও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশের তালিকায় চীনের অবস্থান এখন শীর্ষে। জিডিপি বৃদ্ধিতেও দেশটি দখল করে রেখেছে সর্বোচ্চ স্থান। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চীনের জিডিপি বৃদ্ধির হার ১০%। এই অভাবিত উন্নতি আর আগামীর সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ আশাবাদ ব্যক্ত করছেন যে, চীন আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর শীর্ষ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। বিশেষজ্ঞরা চীনের এই দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির কারণ হিসেবে মূলত দুটি বিষয়কে চিহ্নিত করছেন। প্রথমত উৎপাদনক্ষেত্রে বৃহৎ অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ যেটা সম্ভব হয়েছে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সাহায্যে; এবং দ্বিতীয়ত দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি। এই দুটো উপাদানের মিলিত প্রয়াসই চীনকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তবে ১৯৭৯ সালে গৃহীত সংস্কারনীতি দেশটির অর্থনীতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। দেশটি তার জিডিপির প্রায় ৪৮ শতাংশ ব্যয় করে কারখানা নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ক্রয়, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদির পেছনে। চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির আরও কিছু কারণ হলোÑ ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল, খনিজ সম্পদ, বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার এবং দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অবকাঠামো নির্মাণে অধিক বিনিয়োগের কারণে চীনের নগরগুলো ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ইতোমধ্যেই শিল্পায়ন ও নগরায়নের সুবিধা ভোগ করতে শুরু করেছে। এটিও অর্থনৈতিক উন্নতির একটি বড় অংশ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি ২০১২ সালে চীনের জিডিপি’র পরিমাণ দাঁড়াবে ১২ হাজার বিলিয়ন ডলারের ওপর। এই হিসাবে ২০১৫ সাল নাগাদ চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হচ্ছে নানামুখী দুর্বলতার কারণে। বিপরীতে চীনের অর্থনীতি গড়ে দুই অঙ্কে বিকশিত হচ্ছে গত এক দশক ধরে। ২০০৭ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে চরম খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। চলতি বছরে চীনের এ প্রবৃদ্ধির হিসাব ধরা হয়েছে ১০ শতাংশ। গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি যেখানে ১.৫% এবং জাপানের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় শূন্য, সে সময়ে চীনের এ বিকাশ ছিল ৯.১%। চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো সস্তায় পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা ও বিক্রি। বিশেষ করে কম মূল্যে ইলেকট্রনিক্স পণ্য সরবরাহ করে বিশ্ববাজারে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। দেশটির সর্বত্র মজুরি বাড়ছে খুব দ্রুতগতিতে। নেতারা একে ব্যাখ্যা করছেন জীবনমানের উন্নয়ন হিসেবে। ২০১০ সালে চীনের মোট জিডিপি অর্জিত হয়েছে ৫.৮৭ ট্রিলিয়ন ডলার। অপরদিকে অন্য বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জাপানের জিডিপি ৫.৪৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে জাপানকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের মর্যাদা দখল করে। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের পুনর্গঠনের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আইএমএফ’র ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী চীন ২০১৬ সালের মধ্যেই বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি শঙ্কিত এই কারণে যে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো দেশটিতে বৈষম্য বৃদ্ধি করতে পারে যেটা অর্থনৈতিক উন্নতি এবং গোটা ব্যবস্থায় একটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া শুরু থেকেই বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে দেশটিকে। অনেকে বলছেন, চীন যে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে সেটা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে না পারলে উন্নতির বদলে বরং বিরাট সঙ্কট এসে ভর করবে। এছাড়া চীন যে অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করছে তা একইসাথে সমৃদ্ধি আনার পাশাপাশি নেতিবাচক কিছু ফলাফলও বয়ে নিয়ে আসছে যা প্রভাব ফেলছে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে। পরিবেশ দূষণ, অনুন্নত সামাজিক নিরাপত্তা এবং ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য সৃষ্ট সমস্যাগুলোকে আরও গভীরে ঠেলে দিচ্ছে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ শক্ত হাতে মোকাবিলার জন্য চীন সরকার বরাবরই প্রস্তুত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চীনের অর্থনৈতিক নীতির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। ২০১১ সালের মার্চে দেশটির জাতীয় কংগ্রেসে ১২তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়েছে। নতুন এ পরিকল্পনাটি ২০১৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। চীন এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তাতে এটিই তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নই চীনকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দেবে। এছাড়া এর মাধ্যমেই দেশটি বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতে পাবে। চীনের এ পরিকল্পনায় মূলত তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে; অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, ব্যাপক সামাজিক সমতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য চীন এবারও শিল্পকেই প্রধান অবলম্বন হিসেবে নিয়েছে। এই পাঁচ বছরে দেশটি সাতটি অনগ্রসরমাণ বিশেষ শিল্পকে সম্প্রসারণ করবে বিশ্ববাজারে যার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন এ খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- জীবপ্রযুক্তি, জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশ রক্ষা, উৎপাদনের উপকরণ এবং তথ্য প্রযুক্তিকে পরবর্তী প্রজন্মে উন্নীতকরণ। এসব খাতে সরকার ২.১ ট্রিলিয়নেরও বেশি ডলার বিনিয়োগ করবে। চীনের ১২তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ৭% গড় জিডিপি অর্জন এবং জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করা; কম আয়ের মানুষের জন্য ৩৬ মিলিয়ন এপার্টমেন্ট তৈরি করা, বছরে গড় মজুরি ১৩% এর উপরে উন্নীত করা এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে দ্রুতগতির রেলওয়ে ও হাইওয়ে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা। এক কথায়, ব্যবসা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিই শুধু নয়, চীন এখন নজর দিচ্ছে অন্যান্য সেবাখাতের দিকেও। এতে চীনের অর্থনৈতিক নীতির যে দিকগুলো সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল তা খুব দ্রুতই কেটে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। চীনের গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কার নীতি এবং সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য মডেল হতে পারে।
খায়রুল বাসার নির্ঝর
No comments