আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন
পূর্ব প্রকাশের পর) ৯. আলবদরদের পলায়ন নিরস্ত্রদের ওপর যত বীরত্বই দেখাক না কেন, ১৬ ডিসেম্বর আলবদররা পালাতে লাগল মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সীমান্ত অতিক্রম। আলবদরদের কিছু টেকনাফ হয়ে বার্মায়। কিছু পশ্চিমবঙ্গ আর কিছু নেপালে পালাল। সেখান থেকে পাকিস্তানে।
যারা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেনি তারা নিজেদের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেল। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের ভিড়ে ঢুকে গেল। আলবদরদের আত্মীয়স্বজনরাও তাদের সাহায্য করেছে, সমব্যথীরাও। আমার লেখা রাজাকারের মনে আলবদর খালেক মজুমদার ও শান্তি কমিটির আয়েনউদ্দিন কীভাবে কোথায় পালিয়েছিল তার বর্ণনা আছে। কিছু আলবদরকে হত্যা করা হয়, কিন্তু সে সংখ্যা অনেক কম।
মনসুর লিখেছেন, অনেক আলবদরের ওপর অত্যাচার হয়েছে, কিন্তু তারা তা সহ্য করেছে।
আলবদররা কীভাবে পালিয়েছিল মনসুর তার বর্ণনা দিয়েছেন তাদের সাক্ষাতকার থেকে। এখানে তিনজন কুখ্যাত আলবদরের পলায়নের কাহিনী উদ্ধৃত করছি মনসুরের ভাষ্য থেকে।
প্রথম কাহিনীটি হলো শেরপুরের কুখ্যাত আলবদর কামরানের। কামরান তখনও জানত না যে, আত্মসমর্পণ করা হয়েছে। তবে, হঠাৎ গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার ধারণা হচ্ছিল কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে এবং তাদের ধারণা হলো : ‘ভারতীয় সৈন্যরা এক-এক করে দেশপ্রেমিক পাকিস্তানীদের খতম করছে।’ তারপর কামরানের ভাষায়Ñ আমরা সারাদিন লুকিয়ে রইলাম। সন্ধ্যায় এ ধারণায় বাইরে বের হলাম যে, পরিস্থিতির হয়তো হাবভাব বুঝতে পারব। কিন্তু ঘর থেকে বের হতেই হিন্দুস্তানী সৈন্যরা আমাদের চারজনকে গ্রেফতার করে ফেলল। আমরা বললাম যে, আমরা গ্রাম থেকে এসেছি। এমনিতে এদিকে বের হয়েছি। প্রথমে তো আমাদের কথার ওপর কেউ কর্ণপাত করল না। কিন্তু ৫-৬ ঘণ্টা পরে ছেড়ে দিল। এটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় ছিল যে, ওখানে মুক্তিবাহিনীর কোন লোক উপস্থিত ছিল না। শহর থেকে প্রায় চার মাইল দূরে আমাদের এক সম্মানিত শিক্ষকের বাড়ি ছিল। হিন্দুস্তানী সৈন্যদের পাকড়াও থেকে রেহাই পেয়ে সেখানে চলে গেলাম। উস্তাদ মহোদয় আনন্দের সঙ্গে আমাদের আশ্রয় দিলেন। যখন কিছুটা স্বস্তি এল সঙ্গীদের খোঁজার জন্য বের হলাম। জানা গেল যে, মকবুল আহমদ, ফরিদ উদ্দিন ও আরও ৫৮ জন আলবদরকে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। এটাও জানতে পারলাম যে, তাদের খুব হিংস্র অবস্থায় শহীদ করা হয়েছে।
শিক্ষক মহোদয়ের ঘরে আমরা তিন দিন থাকলাম। ভবিষ্যত প্রোগ্রামের ব্যাপারে যখন চিন্তা করা হলো, তিন সাথীই বলল যে, আমরা এখান থেকে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যাব। কথামতো তারা চলে গেল আর আমি ঢাকায় চলে গেলাম। ওখানে আমাকে অনেক লোক জানত। তাই আশঙ্কা ছিল কেউ যেন চিনে না ফেলে। আল্লাহর রহমত সাথী ছিল। আমি সেখানে ২০ দিন একটি ঘরে লুকিয়ে রইলাম। এরপর ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম রওনা হলাম। এই বিবরণ সামনে বাড়ানোর আগে মনে হয় আমার পরিবার সম্পর্কে দু’একটি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। আমরা দুই ভাই ছিলাম। বড় ভাই চাকরি করতেন। একটা ছোট বোন ছিল, আব্বাজান ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর রোকন। পতনের পর তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় মা বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হন। শেষ পর্যন্ত তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময় শুধু ছোট বোনটাই তার কাছে ছিল। আমাকে খুবই ভালবাসতেন। কিন্তু আমি এতখানি দূরে ছিলাম যে, অসুস্থতার সময় তার চোখে শীতলতা দিতে পারিনি। তার স্বামী ও জীবনসঙ্গী জেলের মধ্যে ছিলেন। বড় ছেলে একেবারে অর্থনৈতিক অবস্থায় পর্যুদস্ত। বুঝতে পারলাম যে, তড়পড় করে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। ইন্তেকালের আগে মা গোপন সূত্রে খবর পাঠান যে, বাছাধন! মুক্তিবাহিনীর রক্তপিপাসু হিংস্র জানোয়ারগুলো তোমার খোঁজে ঘরের চারপাশে জাল পেতে বসে আছে। তুমি এখানে এসো না। চট্টগ্রামে আত্মগোপন অবস্থায় আট মাস কেটে যায়। সেই নেহায়েত পেরেশানির অবস্থায়ও জমিয়তের বিক্ষিপ্ত সাথীদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে থাকি।
ইচ্ছা ছিল এই দেশ থেকে অবস্থা অনুকূল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকব। কিন্তু যখন এদিক থেকে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে গেলাম, তখন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেলাম। সেখানে ১ মাস অতিবাহিত করার পর কয়েকজন সঙ্গীসহ নেপালের বর্ডার অতিক্রম করলাম। ৬ মাস কাঠমন্ডুতে থাকলাম। ওখান থেকে পুনরায় ভারতের পথে পাকিস্তানে প্রবেশ করলাম।
যখন থরপার এলাকা দিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখলাম, তখন এখানকার ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও মনে হলো নিজের ধাত্রীর কোলে এসে গেছি।
মুহম্মদ মনসুর ছিল চট্টগ্রামের (মহেশখালীর) কুখ্যাত আলবদর। পাকিস্তানীরা যখন অস্ত্রসমর্পণ করছে তখন তাদের কাছে সে এর ব্যাখ্যা চেয়েছিল, কিন্তু তারা কোন ব্যাখ্যা দিতে পারল না। তখন মনসুর তার সাথীদের (ঈদগাহ ইউনিট) একত্রিত করে জিজ্ঞেস করল তারা কী করতে চায়। তারা বলল, সেখানে থাকবে। মনসুর বলল, ‘তাহলে তো শহীদ হয়ে যাবেন।’ তারা জানাল, ‘শহীদ হওয়া উত্তম।’
মনসুর তো শহীদ হতে চায় না। তার আরও কিছু সাথী নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে এলো, সাথীদের পরিচিত একটি মেসে রেখে সে একা পালানোর মতলব করল। পতেঙ্গায় এসে তার পরিচিত মহেশখালীর এক সাম্পানওয়ালা পেলো। তাকে অনুরোধ করল মহেশখালী পৌঁছে দিতে। সাম্পানওয়ালা বললেন, দাড়ি কেটে ফেলেন। দাড়িওয়ালা লোক নিয়ে আমি যেতে পারব না। এ কথা শুনে মনসুরের খুব খারাপ লাগল। অন্য সময় হলে হয়তো সাম্পানওয়ালাকে গুলি করে ফেলা যেত। চুপ করে মেসে চলে এলো। তারপর তার ভাষায় “১৭ ডিসেম্বর সকালে এয়ারপোর্টে গেলাম। সেখানে কেউ ছিল না। পুরো চট্টগ্রাম ঘুরলাম। কিন্তু কোন সিপাহী বা আলবদরের ক্যাডেটের সাক্ষাত মিলল না। শেষ পর্যন্ত একটি নারিকেল গাছের নিচে আমার অস্ত্র ফেলে দিলাম। তারপর বোর্ডিংয়ে এসে আমার বন্ধু কর্মীদের জানালাম। নামাজ পড়লাম, নাস্তা করলাম। এফতেখারের কাছ থেকে একটি লুঙ্গি ও কোর্তা নিলাম। উর্দি খুলে ফেলে দিলাম। আনিসুল ইসলাম বললেন : ‘আপনাকে লোকেরা চিনে। কাজেই আপনি এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে যান।’ তার সঙ্গে একমত হয়ে আমি চট্টগ্রাম থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। সঙ্গীদের বললাম, ‘আমি থাকলে তোমরাও বিপদের মধ্যে পড়ে যাবে। আমাকে তো এই লোকেরা হয়তো আজকেই শহীদ করে দিবে। তোমরা বেঁচে থাকÑ যাতে আরও কিছুদিন আল্লাহর ইবাদত করতে পার।’
আমার কাছে ১২০ টাকা ছিল। তাদের ৪০ টাকা করে দিলাম, চল্লিশ টাকা নিজে রাখলাম। আমরা অশ্রুসজল নয়নে ধরা গলায় পরস্পর থেকে বিদায় নিলাম। আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল যে, আজকেই আমি শহীদ হয়ে যাব।
সকাল ৯টায় সময় আমি পুনরায় ঘাটে গেলাম। ঘটনাক্রমে ওই নৌকাওয়ালাকেই পাওয়া গেল। আমি বললাম যে, দাঁড়ি তো কাটব না। সে বলল যে, যদি কেউ ধরে তাহলে আমি কিছু বলব না। এ কথা বলে আমাকে নৌকায় বসার অনুমতি দিল। দিনের ১টার সময় নৌকা ঘাট থেকে আলাদা হয়ে গেল। একজন আওয়ামী লীগারও সাথে ছিল।
মহেশখালীর দিকে আমাদের নৌকা হয়তো এক মাইল এগিয়েছে, এ সময় মুক্তিবাহিনী দুটি ফায়ার করল এবং আওয়াজ দিল যে, এদিকে এসো। মাঝি কোন উচ্চবাচ্য না করে নৌকার দিক সেদিকে এগিয়ে দিল। আমরা তীরে গেলাম। তারা জিজ্ঞেস করল, ‘কোন আলবদর বা মুজাহিদ আছে?’ নৌকাওয়ালা বর্ণনা করল, না কেউ নাই। তারপর তারা জয় বাংলা সেøাগান দিল, সবাই দিল, কিন্তু আমি চুপ করে রইলাম। এটা আল্লাহর বিশেষ রহমত বলতে হবে যে, তারা আমার দিকে লক্ষ করেনি। ওখান থেকে তিন মাইল এগিয়ে গেলে মাজেলঘাটের নিকটে আরেকটি গ্রুপ পাওয়া গেল। তারাও একই প্রশ্ন করল, কোন আলবদর, রাজাকার আছে?
মাঝি তো চুপ রইলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগারটি বলল, এ হচ্ছে আলবদর। একথা শুনতেই তারা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা আমার হাত ধরে নৌকা থেকে বাইরে টানতে লাগল। আমি হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললাম, ‘জবরদস্তি করার প্রয়োজন নেই, আমি তোমাদের সঙ্গে যাবার জন্য তৈরি আছি।’ তারা আমাকে নৌকা থেকে নামিয়ে ফেলল। দেখলাম যে, নদীর কূলে বহু মুজাহিদকে পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়েছে, আর তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। তারা আমাকেও ওদিকে নিয়ে গেল। আমি আমার শেষ পরিণতি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেখানে আমাদের গ্রামের একজন মুক্তিবাহিনী ছিল। সে আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এদিকে কোথায়? আমি বললাম, ‘আমি বাড়িতে যাচ্ছিলাম, এরা আমাকে আলবদর নাম দিয়ে নৌকা থেকে নামিয়ে এনেছে।’ এ ঘটনার পর আমার এলাকার লোকটি অন্যদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হলো। বলল, আমি এক বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। তোমরা যদি তাকে মারতে চাও তাহলে প্রথমে আমাকে মার।’ বেশ ঝগড়া করে তিনি আমাকে ছাড়িয়ে দিলেন। আর রাত ২টার দিকে আমি বাড়িতে পৌঁছলাম। আব্বা বললেন যে, ‘মুক্তিবাহিনী তোমার খোঁজে কয়েক দফা এখানে চক্কর দিয়ে গেছে। তোমার এখানে থাকা ঠিক হবে না। তুমি ডাক্তার নজরুলের কাছে চলে যাও।’ এই ডাক্তার ছিলেন দ্বীপের আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। আব্বা তাকে আর্মি এ্যাকশনের সময় ১ সপ্তাহ আমাদের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
আব্বার নির্দেশ মোতাবেক আমি তার বাড়িতে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম। এটা ছিল ভোর ৪টার ঘটনা। তিনি হাতে পিস্তল নিয়ে বের হলেন। আমি নিজের পরিচয় দিলাম এবং আশ্রয় চাইলাম। সেই অকৃতজ্ঞ জবাব দিল যে, ‘এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যাও। আরেকবার যদি দেখি, তবে মেরে ফেলব।’ এটাই তো এহসানের বদলা। তারপর পাহাড়ী এলাকার দিকে চলে গেলাম। এক সপ্তাহ গাছের পাতা খেয়ে খাটিয়েছি। আল্লাহ জানেন এভাবে কতদিন গাছের পাতা খেয়ে কাটাতে হতো। সৌভাগ্যবশত আমার এক বৌদ্ধ কর্মচারীর সাথে দেখা হলো। সে কিছু খানা, কোর্তা ও সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে গেল। আমরা কিছু সাথী পাক আর্মির কাছ থেকে সিগারেট পানের অভ্যাস শিখেছিলাম। ২১ দিন পুনরায় পাতাপত্র খেয়ে কাটালাম। ২১ দিন পর সেই কর্মচারী ও আমার ছোট ভাই সঙ্গে খানা, কম্বল ও লুঙ্গি নিয়ে এলো। কম্বলটা ছিল খুব সস্তা ধরনের। আমার মনে খটকা লাগল যে, না জানি আমাদের বাড়িতে লুটপাট হয়েছে। তাই হয়তো এত সস্তা ধরনের মামুলি কম্বল পাঠানো হয়েছে। ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জবাব দিল না। তাঁর চুপ করে থাকা থেকে প্রকাশ পাচ্ছিল যে, আসল ঘটনা এড়াবার জন্য চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য যে, আমার আব্বা কক্সবাজার ও মহেশখালীর মধ্যে নৌকা চালানোর কাজকারবার করতেন। তাতে ভাল আয় রোজগার হতো। ভাই এক শ’ টাকা দিল এবং বলল যে, ‘আগামী রাতে একটি লঞ্চ লামার বটতলী ঘাটে ভিড়বে। ওখানে আপনি উঠবেন। আমি বললাম, ঠিক আছে।’ যদিও লঞ্চ কোথায় নিয়ে যাবে তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু আব্বাজানের আদেশ পালন ছাড়া উপায় ছিল না।
এই লঞ্চ ছিল অপছন্দনীয় লোকদের। আব্বা এটি ভাড়ায় নিয়েছিলেন। নির্ধারিত সময়ে সেটি এলো। মহেশখালীর দু’জন দেশপ্রেমিক আগের থেকে যাত্রী হয়েছিল। আমিও তাদের সঙ্গে বসে গেলাম এবং অজ্ঞাতস্থানের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মাঝি নিজের মন যেভাবে চায় সেভাবে নৌকা বেয়ে নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, শুকনো পাতার মতো পানির ওপর দিয়ে ভেসে চলেছিল। এভাবে ভাসতে ভাসতে আমরা জিঞ্জিরা [সেন্টমার্টিন] নামক দ্বীপে পৌঁছে গেলাম। সেখানকার নারিকেল খুব প্রসিদ্ধ। এই দ্বীপের বাসিন্দারা ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা বদলে গেছে বলে মনে হলো। আমরা কিছুক্ষণ থেমে রওনা হয়ে গেলাম। এটি ছিল জানুয়ারির ৮ তারিখ। ওই এলাকায় পরিস্থিতি কার্যত শান্ত ছিল। এ কারণে, আমরা ধারণা করেছিলাম যে, কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু দ্বীপের তীরের কিছুদূর যেতে না যেতেই মুক্তিবাহিনীর একটি নৌকা আমাদের ধাওয়া শুরু করল। সূর্য ডোবা পর্যন্ত বরাবর আমাদের পেছনে লেগে রইল। আমাদের মাঝি রাতের আঁধারের সুযোগ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে তো প্রাণ বাঁচাল কিন্তু ভুলে গভীর সমুদ্রের দিকে এসে গেল। কেউ দিক ঠিক করতে পারছিল না। অনুমানের ওপর নৌকা উত্তরের দিকে ঘুরিয়ে দিল। ১০-১২ ঘণ্টা কোন কিছু চিন্তা বা বুঝা ছাড়াই সফর করতে থাকল। যখন সূর্যের আলো ভাল করে ছড়াল তখন বোঝা গেল যে, বার্মার মাঝিদের এক পল্লীর কাছাকাছি চলে এসেছি। ওখান থেকে রওনা হয়ে রাতে একটি গ্রামে নামলাম। সেখানকার সকল বাসিন্দা ছিল মুসলমান। সৌভাগ্যজনকভাবে দু’একটি পড়ালেখা জানা লোকও পাওয়া গেল।
তারা খোশ আমদেদ জানালেন। খানা খাওয়ালেন। থাকার জায়গা করে দিলেন। আমরা খুশি ছিলাম যে, আল্লাহতায়ালা গায়েবি সাহায্য করছেন। কিন্তু এই খুশি সাময়িক বলে মনে হলো। সকাল বেলা বোঝা গেল যে, বার্মায় দু’টি সমান্তরাল সরকার আছে একটি বার্মার, আরেকটি কমিউনিস্টদের। এখন যেই আমাদের দেখবে সেই এরেস্ট করবে। যাই হোক দিনের বেলাটা সেখানেই কাটালাম। পাহাড়ের কাছে একটি মসজিদের ইমাম সাহেব পরামর্শ দিলেন যে, আপনাদের দূতাবাসকে পত্র লিখুন। কাজেই আমি আলবদর কমান্ডার হিসাবে পত্র লিখলাম। উত্তরে দূতাবাস জানাল যে, ‘শীঘ্রই অফিসে চলে আসেন নতুবা এরেস্ট হয়ে যাবেন।’ পরদিন আমরা নৌকাযোগে আকিয়াব চলে গেলাম। দিনের বেলা ২টার সময় সেখানে পৌঁছলাম। কোন মাধ্যমে আকিয়াব শহরের জামে মসজিদের ইমাম সাহেব আমাদের আগমনের কথা জানতে পেরেছিলেন। তিনিও তশরিফ আনলেন। তিনি আমাদের পাকিস্তানী অফিসে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ১০ মিনিট যেতে না যেতেই বার্মার ইমিগ্রেশন আমাদের গ্রেফতার করল এবং সঙ্গে করে নিয়ে গেল।
দূতাবাস ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার করাতে পাকিস্তানী কাউন্সিলের পক্ষ হতে এর প্রতিবাদ জানাল। শেষ পর্যন্ত আমরা তাদের মাধ্যমে মুক্ত হলাম। মুক্তির পর আমাদের পাকিস্তানী ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলেন। ওখানে এ সময় ১০৪ সিপাহী অবস্থান করতেন। সবাই মনের অজান্তে গলায় জড়িয়ে ধরলেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। তিন দিন পর ঢাকা থেকে একজন কর্নেল পালিয়ে ওখানে পৌঁছলেন। তিনি আমাদের তিনজনকে ডেকে সান্ত¡না দিলেন। তিনি বললেন, যদি পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক কোটি মুসলমানও এসে যায় আমরা তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। (চলবে)
No comments