প্রবঞ্চনার উপাখ্যান by মিলু শামস
সুবোধ ঘোষ জানতেও পারলেন না গত শতকে মারা গিয়ে কি অসাধারণ গল্পের প্লট তিনি হারিয়েছেন। বেশি না টেনেটুনে নতুন শতকের অন্তত প্রথম দশক পর্যন্ত বাঁচতে পারলেও দেখতে পেতেন তাঁর ঠগিনী, অলীক, ঠগের ঘর বা কৌন্তেয়’র ঠগিদের হার মানিয়ে জন্ম নিয়েছে এক মেধাবী প্রজন্ম।
ঠগ বিদ্যাকে যারা শৈল্পিক সুষমায় পৌঁছে দিয়েছে উৎকর্ষের উচ্চ মার্গে। খুলে দিয়েছে এর নতুন সব দিগন্ত। দেখতেন, তাঁর গল্পের বঞ্চিত অবহেলিত সমাজের কাছে চড়-থাপ্পড় খাওয়া হতচ্ছাড়া ঠগি নয়, রাষ্ট্রের আনুকূল্য ও তার অর্থনৈতিক জলবায়ুতে পরিপুষ্ট ঠগিরা কেমন চারপাশ আলো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেমন এদের বুদ্ধির ধার তেমনই চৌকস উপস্থাপনা। সুবোধ ঘোষের সমগোত্রীয়ও বলা যায় এদের। তিনি গল্প লিখতেন, এরা বলে। গল্পের বুনটে ধাঁধা লাগায় শ্রোতার মনে। মুগ্ধ বিস্ময়ে আপ্লুত হন শ্রোতা। আফসোস করেন আরও আগে কেন দেখা হলো না এ গাল্পিক অথবা স্বাপ্নিকদের সঙ্গে। তাহলে কবেই তো বাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে ...।
নেশায় বুঁদ হয়ে শ্রোতা শোনেন সোনা-ডলারের গল্প। কখনও উচ্চ মুনাফা অথবা অলিক পণ্য বিপণনে অস্বাভাবিক মুনাফার উত্তপ্ত বর্ণনা। বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানি বা ইউনিপেটুইউ, ডেসটিনি-২০০০, ম্যাক্সিম গ্রুপ, এইম ওয়ে ইত্যাদি ঝাঁঝল সব নাম। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব স্টাইলে চটকদার গল্প। কার চেয়ে কে বেশি সাবলীল বলা মুশকিল হলেও অভিনবত্বের দিক থেকে ইউনিপেটুইউ বেশ এগিয়ে সে কথা বলাই যায়। যেমন তাদের নিজেদের নাম তেমনই আখ্যানের বহুমাত্রিকতা। যার কেন্দ্রে আছে বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানি নামে মালয়েশিয়ার এক স্বর্ণ উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান। গল্পটি এ রকম বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খনি থেকে চব্বিশ ক্যারেটের স্বর্ণ তুলে দু’ভাগ খাদ মেশায়। এভাবে চব্বিশ ক্যারেটের স্বর্ণ বাইশ ক্যারেটে নামিয়ে বাজারে বিক্রি করে। খাদ মেশানোর পর যে দু’ভাগ সোনা বেঁচে যায় তা টাকা লগ্নিকারীদের দেয়া হয়। এই সোনা উত্তোলন কোম্পানিতে বাংলাদেশ থেকেই বিনিয়োগ করা যায় এবং প্রতি সপ্তায় বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ করছে বিনিযোগকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিপেটুইউ। আর এর সদস্য হয়ে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারী দশ মাস থেকে বার মাসের মধ্যে বিনিয়োগের টাকা লাভ পাবে। কোম্পানি সপ্তায় দ্বিগুণ লাভ করে আর গ্রাহকদের লাভ হবে বছরে দ্বিগুণ। এ হচ্ছে গল্পের মুখবন্ধ। এরপর আসল প্রক্রিয়া।
ইউনিপেটুইউ নিজেদের পরিচয় দিত মালয়েশিয়াভিত্তিক বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানির এ দেশীয় এজেন্ট হিসেবে। বলত, বাংলাদেশে ছিল এর শাখা বা লিয়াজোঁ অফিস। কিন্তু বিদেশী যে কোন প্রতিষ্ঠানের শাখা হিসেবে কাজ করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ এর আঠারো ও পাঁচ ধারার আওতায় বাধ্যতামূলক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। ইউনিপেটুইউ সে অনুমতি নেয়নি। একই আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাধারণ বা বিশেষ অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে ব্যক্তির অনুকূলে কোন টাকা পাঠানো বা আমদানি-রফতানি করা যায় না। এ কোম্পানি তাই করেছে।
এত কিছু ঘটে যাচ্ছে ওদিকে শ্রোতারা তো কথাকারের কথায় আচ্ছন্ন। ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে দেখেন, কোথায় বাড়ি গাড়ি আর কোথায় কোটিপতি হওয়া হাত তো কাপর্দকশূন্য। ভিটেমাটি অন্যের দখলে। হন্নে হয়ে ছোটেন তারা এ দুয়ার থেকে সে দুয়ারে। প্রশাসন জেগে ওঠে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়। যেন তারাও এতকাল ঘুমিয়ে ছিল কোন অদৃশ্য শক্তির আদেশে। এ বেশ রহস্যেরই। প্রকাশ্যে এত সব কা-, দেশী-বিদেশী আইনের সংশ্লিষ্টতা জড়িয়ে আছে যার সঙ্গে, সে বিষয়ে কিছুই জানে না প্রশাসন ও আইনী কর্তৃপক্ষ। জানেন না মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতারা, যারা এসব কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের কর্মকা-ে যোগ দেন। তারা যখন টের পান ঘটনার তখন প্রায় যবনিকা। গ্রেফতার, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদিতে শেষ দৃশ্য সরগরম। দেশময় আলোড়ন ওঠে তারপর গল্পের নটে গাছটি মুড়োয়, কথাকারের কথাও ফুরোয়। কথায় আর দরকার কি কাজ তো সম্পন্ন। কোটিপতির স্বপ্ন দেখে আমজনতা নিঃস্ব। তাতে কি? স্বপ্ন দেখিয়েরা তো নিজেদের স্বপ্ন কানায় কানায় পূরণ করেছে। স্মৃতির অতলে আপাতত হারিয়ে যায় তারা। মঞ্চে আসে অন্য গাল্পিকেরা। এখন যেমন আছে ডেসটিনি নামের তুখোড় কথাবাজরা। বেশ সময় নিয়ে থেমে থেমে মঞ্চে আসছে তারা। ব্যাংক হিসাব জব্দ, গ্রেফতার, জামিন ইত্যাদি পর্ব চলছে। অভিযোগ উঠেছে উনিশ লাখ ডলার পাচারের। অবশ্য ডেসটিনিকে ল্যাং মেরে এরই মধ্যে হাজির হলমার্ক গ্রুপ। যদিও এটি এমএলএম কোম্পানি নয়, তবু এর দারুণ সব ‘কাকতালীয়’ ঘটনা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে সতেরো কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন, আরও বত্রিশ কর্মকর্তা দ্রুত বরখাস্ত হওয়ার পথে। অভিযোগের তালিকা ক্রমশ বাড়ছে। এসব দেখে আমজনতার জানতে ইচ্ছে করে অভিযোগগুলো কখন ওঠে? একেকটি কোম্পানি পাঁচ-দশ-বারো বছর বা আরও বেশি বছর নির্বিঘেœ কাজ করে অন্তঃসারশূন্য করছে নিরীহ মানুষ ও দেশের অর্থনীতিকে কোন টু শব্দ নেই। হঠাৎ কেন গ্রাহকবান্ধব হয়ে বিপুল বেগে জেগে ওঠা? আইনী তৎপরতা, দুর্নীতি, শুদ্ধির অভিযান সেকি নেপথ্যে ভাগ বাঁটোয়ারার দ্বন্দ্ব? এ লুটপাটের লুকোচুরি আর কতকাল চলবে স্বাধীন দেশে? দেশের প্রতি সামান্য মমতা থাকলেও চৌর্যবৃত্তির এমন মহোৎসব হতে পারে না।
ইউনিপেটুইউর সোনার খনি গল্পের স্রষ্টা এক মধ্যবিত্ত তরুণ। উনিশ শ’ ছিয়াশি সালের মাঝামাঝিতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় আসেন তিনি। উচ্চশিক্ষা নেয়ার সময় যুক্ত হন কোন এক এমএলএম কোম্পানির সঙ্গে। স্বপ্ন দেখেন এ রকম এক কোম্পানির মালিক হওয়ার। শুরু হয় এ বিষয়ে যাবতীয় বিদ্যা আহরণ। বিভিন্ন দেশের এ সংক্রান্ত নীতিমালা ও কর্মকৌশল আয়ত্ত করা। তারপর যাত্রা ইউনিপেটুইউর এবং কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া।
এই মধ্যবিত্ত তরুণের মতো হাজার হাজার তরুণ এখন শর্টকাটে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। যে কোন মূল্যে টাকা উপার্জন করতে হবে এই হচ্ছে জীবনের মোটো। এ রকম এক তরুণ একদিন বলছিল তার স্বপ্নের কথা ‘চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত দুই হাতে টাকা কামাবো’ তারপর? ‘তারপর হজে যাব।’ স্তম্ভিত হই তার কথা শুনে। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে জন্মানো টগবগে তরুণের জীবন নিয়ে এমন পরিকল্পনায় এক ঝটকায় ইতিহাস অর্থনীতি সামনে এসে দাঁড়ায়। আশির দশকে ঢাকা শহরের কোটিপতিদের নিয়ে এক গবেষণা হয়েছিল। বিষয় ছিল তাদের আয় বা বিত্তের উৎস। যেসব উৎস বেরিয়ে এসেছিল তা ছিল এ রকম এক. সরকারী ক্ষমতা ব্যবহার করে পরিত্যক্ত বা সাধারণ সম্পত্তি দখল, সরকারী সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। দুই. চোরাচালানি, মাদক ব্যবসা, কালোবাজারি, মুদ্রা ব্যবসা, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং, হুন্ডি ইত্যাদি। তিন. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থ সংস্থানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়া এবং ফেরত না দেয়া। চার. আমদানি কমিশন পাঁচ. সরকারী নিয়ন্ত্রণ, বিধিনিষেধ, কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি, পারমিট কেনাবেচা ইত্যাদি।
অর্থনীতিতে এই দুর্বৃত্তায়ন বা কালো টাকার উল্লেখযোগ্য বিস্তার আশির দশকেই হয়েছিল। নব্বইয়ে তা আরও বিস্তৃত হয়। নতুন শতকে এসে সবকিছু টালমাটাল হয়ে অন্য এক অর্থনৈতিক সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে; যেখানে আর্থিক ও পারলৌকিক জীবনের পাশাপাশি অবস্থান। ওই আশির দশকে যারা জন্মেছে তারা কি স্বভাবতই অন্য রকম? এমএলএমের মতো লোক ঠকানো ব্যবসা করতে রুচিতে বাধে না। টাকা চাই টাকা, সেখানে রুচি-অরুচি নৈতিকতার বালাই নেই। বাজার অর্থনীতির সর্বশেষ নর্মস অনুযায়ী তার দরকারও নেই। যার কেনার ক্ষমতা আছে তাকেই স্যার ম্যাম বলে দাঁত কেলিয়ে স্যালুট করা তার লক্ষ্য। তিনি রাম-শ্যাম কি যদু-মধু তা দেখে নষ্ট করার মতো সময় বাজারের নেই। স্যার-ম্যামরা টাকার জৌলুসে দামী বাড়িতে থেকে, দামী গাড়ি চড়ে সুপার মার্কেট, শপিং মলে গিয়ে দিনযাপনের নিশ্চিত সুখ কিনতে পারলে পরলোকের বিষয়টাই বা অনিশ্চিত রাখবেন কেন। সুতরাং গো টু সৌদি আরব, হজ-হিজাব এ্যান্ড লৌকিক পারলৌকিক স্বার্থের কম্পার্টমেন্টালিজম। ফটকাবাজি টাকার সাংস্কৃতিক বহির্প্রকাশ এমনই তো হবে।
নেশায় বুঁদ হয়ে শ্রোতা শোনেন সোনা-ডলারের গল্প। কখনও উচ্চ মুনাফা অথবা অলিক পণ্য বিপণনে অস্বাভাবিক মুনাফার উত্তপ্ত বর্ণনা। বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানি বা ইউনিপেটুইউ, ডেসটিনি-২০০০, ম্যাক্সিম গ্রুপ, এইম ওয়ে ইত্যাদি ঝাঁঝল সব নাম। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব স্টাইলে চটকদার গল্প। কার চেয়ে কে বেশি সাবলীল বলা মুশকিল হলেও অভিনবত্বের দিক থেকে ইউনিপেটুইউ বেশ এগিয়ে সে কথা বলাই যায়। যেমন তাদের নিজেদের নাম তেমনই আখ্যানের বহুমাত্রিকতা। যার কেন্দ্রে আছে বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানি নামে মালয়েশিয়ার এক স্বর্ণ উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান। গল্পটি এ রকম বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খনি থেকে চব্বিশ ক্যারেটের স্বর্ণ তুলে দু’ভাগ খাদ মেশায়। এভাবে চব্বিশ ক্যারেটের স্বর্ণ বাইশ ক্যারেটে নামিয়ে বাজারে বিক্রি করে। খাদ মেশানোর পর যে দু’ভাগ সোনা বেঁচে যায় তা টাকা লগ্নিকারীদের দেয়া হয়। এই সোনা উত্তোলন কোম্পানিতে বাংলাদেশ থেকেই বিনিয়োগ করা যায় এবং প্রতি সপ্তায় বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভ করছে বিনিযোগকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিপেটুইউ। আর এর সদস্য হয়ে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারী দশ মাস থেকে বার মাসের মধ্যে বিনিয়োগের টাকা লাভ পাবে। কোম্পানি সপ্তায় দ্বিগুণ লাভ করে আর গ্রাহকদের লাভ হবে বছরে দ্বিগুণ। এ হচ্ছে গল্পের মুখবন্ধ। এরপর আসল প্রক্রিয়া।
ইউনিপেটুইউ নিজেদের পরিচয় দিত মালয়েশিয়াভিত্তিক বেস্ট জিনিয়াস কোম্পানির এ দেশীয় এজেন্ট হিসেবে। বলত, বাংলাদেশে ছিল এর শাখা বা লিয়াজোঁ অফিস। কিন্তু বিদেশী যে কোন প্রতিষ্ঠানের শাখা হিসেবে কাজ করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ এর আঠারো ও পাঁচ ধারার আওতায় বাধ্যতামূলক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। ইউনিপেটুইউ সে অনুমতি নেয়নি। একই আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাধারণ বা বিশেষ অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে ব্যক্তির অনুকূলে কোন টাকা পাঠানো বা আমদানি-রফতানি করা যায় না। এ কোম্পানি তাই করেছে।
এত কিছু ঘটে যাচ্ছে ওদিকে শ্রোতারা তো কথাকারের কথায় আচ্ছন্ন। ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে দেখেন, কোথায় বাড়ি গাড়ি আর কোথায় কোটিপতি হওয়া হাত তো কাপর্দকশূন্য। ভিটেমাটি অন্যের দখলে। হন্নে হয়ে ছোটেন তারা এ দুয়ার থেকে সে দুয়ারে। প্রশাসন জেগে ওঠে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়। যেন তারাও এতকাল ঘুমিয়ে ছিল কোন অদৃশ্য শক্তির আদেশে। এ বেশ রহস্যেরই। প্রকাশ্যে এত সব কা-, দেশী-বিদেশী আইনের সংশ্লিষ্টতা জড়িয়ে আছে যার সঙ্গে, সে বিষয়ে কিছুই জানে না প্রশাসন ও আইনী কর্তৃপক্ষ। জানেন না মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতারা, যারা এসব কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের কর্মকা-ে যোগ দেন। তারা যখন টের পান ঘটনার তখন প্রায় যবনিকা। গ্রেফতার, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদিতে শেষ দৃশ্য সরগরম। দেশময় আলোড়ন ওঠে তারপর গল্পের নটে গাছটি মুড়োয়, কথাকারের কথাও ফুরোয়। কথায় আর দরকার কি কাজ তো সম্পন্ন। কোটিপতির স্বপ্ন দেখে আমজনতা নিঃস্ব। তাতে কি? স্বপ্ন দেখিয়েরা তো নিজেদের স্বপ্ন কানায় কানায় পূরণ করেছে। স্মৃতির অতলে আপাতত হারিয়ে যায় তারা। মঞ্চে আসে অন্য গাল্পিকেরা। এখন যেমন আছে ডেসটিনি নামের তুখোড় কথাবাজরা। বেশ সময় নিয়ে থেমে থেমে মঞ্চে আসছে তারা। ব্যাংক হিসাব জব্দ, গ্রেফতার, জামিন ইত্যাদি পর্ব চলছে। অভিযোগ উঠেছে উনিশ লাখ ডলার পাচারের। অবশ্য ডেসটিনিকে ল্যাং মেরে এরই মধ্যে হাজির হলমার্ক গ্রুপ। যদিও এটি এমএলএম কোম্পানি নয়, তবু এর দারুণ সব ‘কাকতালীয়’ ঘটনা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে সতেরো কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন, আরও বত্রিশ কর্মকর্তা দ্রুত বরখাস্ত হওয়ার পথে। অভিযোগের তালিকা ক্রমশ বাড়ছে। এসব দেখে আমজনতার জানতে ইচ্ছে করে অভিযোগগুলো কখন ওঠে? একেকটি কোম্পানি পাঁচ-দশ-বারো বছর বা আরও বেশি বছর নির্বিঘেœ কাজ করে অন্তঃসারশূন্য করছে নিরীহ মানুষ ও দেশের অর্থনীতিকে কোন টু শব্দ নেই। হঠাৎ কেন গ্রাহকবান্ধব হয়ে বিপুল বেগে জেগে ওঠা? আইনী তৎপরতা, দুর্নীতি, শুদ্ধির অভিযান সেকি নেপথ্যে ভাগ বাঁটোয়ারার দ্বন্দ্ব? এ লুটপাটের লুকোচুরি আর কতকাল চলবে স্বাধীন দেশে? দেশের প্রতি সামান্য মমতা থাকলেও চৌর্যবৃত্তির এমন মহোৎসব হতে পারে না।
ইউনিপেটুইউর সোনার খনি গল্পের স্রষ্টা এক মধ্যবিত্ত তরুণ। উনিশ শ’ ছিয়াশি সালের মাঝামাঝিতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় আসেন তিনি। উচ্চশিক্ষা নেয়ার সময় যুক্ত হন কোন এক এমএলএম কোম্পানির সঙ্গে। স্বপ্ন দেখেন এ রকম এক কোম্পানির মালিক হওয়ার। শুরু হয় এ বিষয়ে যাবতীয় বিদ্যা আহরণ। বিভিন্ন দেশের এ সংক্রান্ত নীতিমালা ও কর্মকৌশল আয়ত্ত করা। তারপর যাত্রা ইউনিপেটুইউর এবং কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া।
এই মধ্যবিত্ত তরুণের মতো হাজার হাজার তরুণ এখন শর্টকাটে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। যে কোন মূল্যে টাকা উপার্জন করতে হবে এই হচ্ছে জীবনের মোটো। এ রকম এক তরুণ একদিন বলছিল তার স্বপ্নের কথা ‘চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত দুই হাতে টাকা কামাবো’ তারপর? ‘তারপর হজে যাব।’ স্তম্ভিত হই তার কথা শুনে। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে জন্মানো টগবগে তরুণের জীবন নিয়ে এমন পরিকল্পনায় এক ঝটকায় ইতিহাস অর্থনীতি সামনে এসে দাঁড়ায়। আশির দশকে ঢাকা শহরের কোটিপতিদের নিয়ে এক গবেষণা হয়েছিল। বিষয় ছিল তাদের আয় বা বিত্তের উৎস। যেসব উৎস বেরিয়ে এসেছিল তা ছিল এ রকম এক. সরকারী ক্ষমতা ব্যবহার করে পরিত্যক্ত বা সাধারণ সম্পত্তি দখল, সরকারী সম্পদ হাতিয়ে নেয়া। দুই. চোরাচালানি, মাদক ব্যবসা, কালোবাজারি, মুদ্রা ব্যবসা, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং, হুন্ডি ইত্যাদি। তিন. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থ সংস্থানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়া এবং ফেরত না দেয়া। চার. আমদানি কমিশন পাঁচ. সরকারী নিয়ন্ত্রণ, বিধিনিষেধ, কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি, পারমিট কেনাবেচা ইত্যাদি।
অর্থনীতিতে এই দুর্বৃত্তায়ন বা কালো টাকার উল্লেখযোগ্য বিস্তার আশির দশকেই হয়েছিল। নব্বইয়ে তা আরও বিস্তৃত হয়। নতুন শতকে এসে সবকিছু টালমাটাল হয়ে অন্য এক অর্থনৈতিক সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে; যেখানে আর্থিক ও পারলৌকিক জীবনের পাশাপাশি অবস্থান। ওই আশির দশকে যারা জন্মেছে তারা কি স্বভাবতই অন্য রকম? এমএলএমের মতো লোক ঠকানো ব্যবসা করতে রুচিতে বাধে না। টাকা চাই টাকা, সেখানে রুচি-অরুচি নৈতিকতার বালাই নেই। বাজার অর্থনীতির সর্বশেষ নর্মস অনুযায়ী তার দরকারও নেই। যার কেনার ক্ষমতা আছে তাকেই স্যার ম্যাম বলে দাঁত কেলিয়ে স্যালুট করা তার লক্ষ্য। তিনি রাম-শ্যাম কি যদু-মধু তা দেখে নষ্ট করার মতো সময় বাজারের নেই। স্যার-ম্যামরা টাকার জৌলুসে দামী বাড়িতে থেকে, দামী গাড়ি চড়ে সুপার মার্কেট, শপিং মলে গিয়ে দিনযাপনের নিশ্চিত সুখ কিনতে পারলে পরলোকের বিষয়টাই বা অনিশ্চিত রাখবেন কেন। সুতরাং গো টু সৌদি আরব, হজ-হিজাব এ্যান্ড লৌকিক পারলৌকিক স্বার্থের কম্পার্টমেন্টালিজম। ফটকাবাজি টাকার সাংস্কৃতিক বহির্প্রকাশ এমনই তো হবে।
No comments