পূর্বাচলে নকশা পরিবর্তন করে প্লট বরাদ্দ, আকারও পরিবর্তন হচ্ছে- রাজউকের প্লট বরাদ্দে নয়ছয়

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্লট বরাদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একের পর এক তালিকা গেছে রাজউকে। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের প্লট দিতে অবৈধভাবে চারবার পরিবর্তন করা হয়েছে পূর্বাচল প্রকল্পের নকশা।


রাজউক সূত্র জানায়, নকশা (লে-আউট) পরিবর্তনের সুযোগে একশ্রেণীর দালালের মাধ্যমে তালিকার বাইরেও অনেকে প্লট পাচ্ছেন। দালাল ও রাজউকের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন। এ প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত অন্তত আড়াই হাজার প্লট দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনেকে বারবার তাঁদের প্লটের আকার বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এই প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় সমাজে পরিচিত মুখ পাওয়া যায়নি। তবে দলীয় বিবেচনায় এঁরা প্লট পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
নকশা পরিবর্তন করে প্লট বরাদ্দ ও প্লটের আকার পরিবর্তনে এ পর্যন্ত অন্তত ৪০০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের কথা সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজউক কার্যালয়ে একটি অস্থায়ী কার্যালয় (ক্যাম্প অফিস) বসিয়েও এসব দুর্নীতির হদিস পাচ্ছে না।
খাইরুল ইসলামের তালিকা: প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-১ থাকা অবস্থায় (বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে কর্মরত) মো. খাইরুল ইসলাম ১২ জনকে প্লট বরাদ্দের জন্য একটি তালিকা রাজউকে পাঠিয়েছিলেন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। সাদা কাগজে লেখা একটি চিঠির সঙ্গে আরেকটি সাদা কাগজে ছক করে ওই ১২ জনের তালিকা পাঠানো হয় ‘অতি জরুরি ও গোপনীয়’ বিষয় হিসেবে।
এই তালিকাভুক্ত দেশি-বিদেশি ১২ ব্যক্তির মধ্যে ছয়জনের নাম ছাড়া কোনো ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। ১২ জনেরই প্লটের জন্য জমা দেওয়া টাকার রসিদ (এমআর) নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনের এমআর নম্বর আছে দুটি করে। অর্থাৎ এই চারজনের প্রত্যেকে দুটি করে প্রকল্পে (পূর্বাচল ও উত্তরা) প্লটের জন্য আবেদন করেছেন।
এই তালিকার চারজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা আবেদন করার পর প্লট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য খাইরুল ইসলামের সহায়তা চেয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ওই চিঠি লেখেন।
কিন্তু খাইরুল ইসলাম চিঠিতে লিখেছেন, ‘...সংযুক্ত আবেদন/টাকা জমার রসিদের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত তালিকার আলোকে বিভিন্ন আয়তনের প্লট বরাদ্দের বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।’ রাজউকের সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির একাধিক সদস্য এবং আরও অনেকের সম্মতির কথা উল্লেখ করে এ ধরনের চিঠি পাঠিয়ে প্লট পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে খাইরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া এ ধরনের চিঠি পাঠানো সম্ভব নয়। তবে সাদা কাগজে চিঠি কেন? এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
৭১ জনের তালিকা: গত মাসের (আগস্ট) প্রথম সপ্তাহে রাজউকে আরেকটি তালিকা যায়। তাতে ৭১ জনকে সংরক্ষিত কোটা থেকে প্লট বরাদ্দের অনুরোধ জানানো হয়। এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজউক সূত্র জানায়, এই ৭১ জনের মধ্যে ১৮ জনের এমআর নম্বর উল্লেখ নেই। আরও নয়জনের ক্ষেত্রে প্রকল্পের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে, ওই ১৮ জন প্লটের জন্য আবেদনই করেননি। করলে তাঁদের এমআর নম্বর থাকত। আর অন্য নয়জন কোনো প্রকল্পে প্লটের জন্য আবেদন করেছেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। করলে অবশ্যই প্রকল্পের নাম উল্লেখ করা হতো।
এই তালিকার অধিকাংশ ব্যক্তির ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। এঁদের জন্য সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দের অনুরোধ করা হলেও কোন শ্রেণীতে তাঁদের সংরক্ষিত কোটায় প্লট দেওয়া হবে, তারও কোনো উল্লেখ নেই। এসব কারণে তালিকাটি সম্পূর্ণ বা আংশিক ভুয়া হতে পারে বলে রাজউক সূত্রের ধারণা। তবে এ রকম অনেক তালিকা এবং ১৩/এ ধারায় বরাদ্দ পাওয়া বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের কারণে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির বিস্তার সহজতর ও ব্যাপকতর হয়েছে। এসব তালিকাভুক্ত ব্যক্তিকে প্লট দেওয়ার জন্য রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীও বিশেষ উৎসাহী হয়ে ওঠেন। কারণ, এসব তালিকাভুক্ত ব্যক্তিকে প্লট বরাদ্দের পাশাপাশি সুযোগ সৃষ্টি হয় তালিকার বাইরেও তাঁদের পছন্দের বা অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে কিছু প্লট বরাদ্দের।
জানতে চাইলে রাজউকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (এস্টেট) আখতার হোসেন বলেন, ৭১ জনের তালিকা অনুযায়ী কিছু প্লটের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রে প্লটের আয়তন উল্লেখ না থাকায় পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞাতসারে তালিকা হয়েছে কি না বা বেনামে কেউ প্লট পাচ্ছেন কি না, এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নকশা বদলে ২৫০০ প্লট: রাজউকের যেকোনো আবাসিক প্রকল্পের চূড়ান্ত নকশা, প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় প্রভৃতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করে। একনেক অনুমোদিত পূর্বাচল প্রকল্পে ছয় হাজার ১৫০ একর জমিতে ৩০টি সেক্টরজুড়ে ২৬ হাজার আবাসিক প্লট বরাদ্দের কথা। এর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন তালিকাভুক্ত ব্যক্তিকে যুক্ত করতে গত ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চারবার অননুমোদিতভাবে পূর্বাচল প্রকল্পের নকশা বদলানো হয়েছে। এ কারণে প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এর মধ্যেও যেসব এলাকার ভূমি উন্নয়ন অপেক্ষাকৃত বেশি হয়েছে, সেখানকার প্লটগুলো প্রভাবশালী, বিশেষ তালিকা, ১৩/এ ধারা প্রভৃতি প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এই সুযোগে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমেও বেশ কিছু প্লট দেওয়া হয়েছে।
এভাবে প্লট দেওয়ার জন্য নকশা পরিবর্তন করায় মূল নকশায় মাঠ, বন, হ্রদ, ফাঁকা জায়গা প্রভৃতি যেভাবে যতটুকু রাখা হয়েছিল তা কমে আসছে।
আকার পরিবর্তনে বাণিজ্য: প্লটের আকার পরিবর্তন এক বিরাট বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। আকার পরিবর্তনের জন্য প্রতি কাঠায় দালালেরা নিচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে আট থেকে ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন কাঠার প্লট পাঁচ কাঠা করে দিলে ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে হয়। পাঁচ কাঠার প্লট ১০ কাঠা করতে হলে দিতে হয় ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু এ বাবদ রাজউকের তহবিলে জমা হয় কাঠাপ্রতি দেড় লাখ টাকা।
রাজউক সূত্র থেকে পাওয়া এক হিসাব অনুযায়ী, পূর্বাচল প্রকল্পে এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার প্লটের আকার পরিবর্তন করায় মোট পাঁচ হাজার কাঠার (প্রায় ৮৪ একর) বাড়তি জমি লেগেছে। এর মধ্যে তিন কাঠার ৫০০টি প্লট পাঁচ কাঠায় উন্নীত করায় বাড়তি জমি লেগেছে এক হাজার কাঠা। পাঁচ কাঠার প্রায় এক হাজার প্লট সাড়ে সাত কাঠায় উন্নীত করায় বাড়তি জমি লেগেছে আড়াই হাজার কাঠা। সাড়ে সাত কাঠার প্রায় ৬০০ প্লট ১০ কাঠায় উন্নীত করায় বাড়তি জমি লেগেছে প্রায় দেড় হাজার কাঠা।
এই পাঁচ হাজার কাঠা জমির জন্য রাজউক পেয়েছে ৭৫ কোটি টাকা (প্রতি কাঠা দেড় লাখ টাকা হিসাবে)। আর এই কাজের দালাল এবং তাঁদের সহযোগী রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে লুটে নিয়েছেন প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা (প্রতি কাঠা সাত লাখ টাকা হিসাবে)। অথচ এই অবৈধ বাণিজ্য না হলে পাঁচ হাজার কাঠা জমিতে আরও অন্তত এক হাজার বাড়তি প্লট করে নতুন এক হাজার লোককে বরাদ্দ দেওয়া যেত।
দুদক তথ্য পায় না: রাজউক ভবনে দুদক একটি অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করেছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে সেখানকার দুদকের কর্মকর্তারা রাজউকের কোনো কোনো কর্মকর্তার কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন যে তাঁদের কোনো ফাইল দেওয়া হয় না। ফাইল চাইলেই বলা হয়, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা: দুর্নীতির পাশাপাশি রাজউকে দেখা দিয়েছে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলাও। কয়েক দিন ধরে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী খন্দকার সালাহ্ উদ্দিনকে পাওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, তিনি ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্র গেছেন। কিন্তু কাউকে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দিয়ে যাননি। এর আগে তিনি বিদেশে দেড় মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করে গত রমজান মাসের আগে দেশে আসেন।
রাজউক সূত্র জানায়, রাজউকে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা এভাবেই চলেন। প্রধান প্রকৌশলী যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা, রাজউকে প্রেষণে আছেন। এ ছাড়া রাজউকের টাকায় এমন সব ব্যক্তি বিভিন্ন সফরে যাচ্ছেন, রাজউকের কাজের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই।

No comments

Powered by Blogger.