বিজ্ঞান চর্চা-অজ্ঞতার দেয়াল ভাঙার আহ্বান by শফিক উজ জামান
আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন সমার্থক। শুধু দারিদ্র্য বিমোচনই নয়, দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ড. আবদুস সালামের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য।
তিনি ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন, অর্থের সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে জিডিপির অন্তত এক শতাংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ব্যয় করা প্রয়োজন
যে কোনো দেশের অগ্রগতির সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীতে এমন একটি দেশও পাওয়া যাবে না, যে দেশটি উন্নত অথচ বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তিতে পশ্চাৎপদ। অন্যদিকে একটি দেশ যত দরিদ্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও ততই অনগ্রসর। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বিজ্ঞানের কয়েকটি মৌলিক আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার হাজার বছরের পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে মাত্র কয়েক দশকেই সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নত জীবন সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে মানুষ হয়ে উঠেছে যুক্তিবাদী ও আত্মসচেতন। উন্নত সমাজ সৃষ্টির পরও এসব দেশে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রয়াস থেমে নেই। প্রকৃতিকে জয় করে জীবনযাত্রা আরও সচ্ছল এবং সহজতর করার প্রেরণা থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অনুন্নত বিশ্বের যেসব দেশ এখনও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হতে পারেনি তার অন্যতম কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনগ্রসরতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতেও স্বাধীনতার ৪১ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। অতীতের বন্যা, খরা আর দুর্ভিক্ষপীড়িত পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের গ্গ্নানি থেকে অনেকাংশে মুক্ত। কিন্তু আজও দেশের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য। অনেকের ধারণা, দারিদ্র্যপীড়িত দেশে বিজ্ঞান চর্চায় বিনিয়োগ অর্থহীন বিলাসিতা। দারিদ্র্য বিমোচনই সমগ্র উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে গত ৪১ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে হাজার হাজার কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান এলেও আজও ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, ৫০ শতাংশ নিরক্ষর, ৫২ শতাংশ বিদ্যুতের সংযোগবিহীন আর ৭০ শতাংশ নূ্যনতম আধুনিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও সার্বিক দিক দিয়ে এ পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যর্থতা। যারা বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন ব্যয়বহুল এবং ফলাফল প্রাপ্তি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার; তাই দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতা অর্জনের পরই কেবল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে দৃষ্টি দেওয়া উচিত, তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ভ্রান্তই নয়, চরম সুবিধাবাদী এবং দেশকে চরম পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে রাখার অপচেষ্টা।
আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন সমার্থক। শুধু দারিদ্র্য বিমোচনই নয়, দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ড. আবদুস সালামের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন, 'অর্থের সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে জিডিপির অন্তত এক শতাংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ব্যয় করা প্রয়োজন।' দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করেই তৃতীয় বিশ্বের কাতারে থেকেও আশির দশকেই চীন বিজ্ঞান গবেষণায় মনোনিবেশ করেছে। বছরে চীনের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা বাড়ছে ১৮ শতাংশ হারে। বিজ্ঞান গবেষণা খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দুই দশমিক চার শতাংশ। বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণা খাতে প্রকৃত ব্যয় মাত্র ০.০৩। শুধু চীন নয়, ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম অনেক আগেই জিডিপির এক শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করে বিজ্ঞান গবেষণা এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
খ্যাতনামা বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন বিজ্ঞান গবেষণাকে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতির কথা তার লেখনীর মাধ্যমে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার আবেদনে রাষ্ট্র সাড়া দিয়েছে তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আশার কথা, আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনের মতোই বিজ্ঞান চর্চাকে জনপ্রিয় ও প্রসারিত করার জন্য ড. আলি আসগর, ড. জাফর ইকবাল, ডা. কায়কোবাদ ও ড. জামাল নজরুল ইসলামের মতো বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রচেষ্টার সঙ্গে আরও যোগ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রবাসী বিজ্ঞানী। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি অত্যাবশ্যক তা প্রবাসী বিজ্ঞানীরা বিদেশে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় কাজ করে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। তাই তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে গবেষণার পাশাপাশি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। ড. গোলাম আবু জাকারিয়া তাদেরই একজন। ড. জাকারিয়ার লেখা 'বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চা : প্রবাসী বিজ্ঞানীর ভাবনা' নামে বইটি তার বিভিন্ন সময়ের লেখা সংকলিত করে প্রকাশিত করা হয়েছে। বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধ প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর আগে লেখা, কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তার প্রাসঙ্গিকতা অম্লান। বইটিতে মোট ১৫টি প্রবন্ধ সংকলন করা হয়েছে। প্রবন্ধগুলোতে বিশ্বের খ্যাতনামা কয়েকজন বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট ও মানবকল্যাণে তাদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এতে খ্যাতিমান ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণাও স্থান পেয়েছে।
গ্রন্থকারের প্রথম প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে বইয়ের শিরোনাম অর্থাৎ 'বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চা' দিয়ে। শুধু প্রকৃতিবিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ রেখে বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা বাংলাদেশে বিদ্যমান। বাংলাদেশে বিজ্ঞান বলতে শুধুই প্রকৃতিবিজ্ঞান অর্থাৎ রসায়ন, জীববিদ্যা, অঙ্ক শাস্ত্র ইত্যাদিকে বোঝানো হয়। সাহিত্য, সমাজবিদ্যা এগুলো বিজ্ঞান নয়। লেখকের ভাষায়, 'অর্থনীতিও যে বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যাও বিজ্ঞান, শুধু প্রকৃতিবিজ্ঞানই বিজ্ঞান নয়, এই অজ্ঞতার দেয়াল ভাঙতে হবে।' সমাজবিজ্ঞানের সঠিক ধারণার অভাবে অনেক বিজ্ঞানী সমাজ বিকাশের ধারাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখতে না পেরে সংকীর্ণ গলিতে চলাফেরা করেন। আবার প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্পর্কে নূ্যনতম জ্ঞান না থাকায় একই অবস্থার ফাঁদে পড়েন সমাজবিজ্ঞানীরা। এ সীমাবদ্ধতাই প্রথম প্রবন্ধে ড. জাকারিয়া স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় প্রবন্ধে লেখক নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি এর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব দিয়েছেন তা পড়ে যে কোনো পাঠকই শিউরে উঠবে।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞান হলো জ্ঞান আর প্রযুক্তি হলো প্রয়োগ বা ব্যবহার। জ্ঞান নিরপেক্ষ হলেও প্রযুক্তি নিরপেক্ষ নয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার মানুষের কল্যাণে না এসে উল্টো ধ্বংসাত্মক হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিহার করে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন পণ্য আবিষ্কার করেছেন, যা মানুষের কল্যাণ তথা সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। এমনই কয়েকজন কীর্তিমান বিজ্ঞানী_ রোন্টগেন, আইনস্টাইন, ফ্রিডরিখ হুড, ফ্রাউনহোফার, আবদুস সালাম প্রমুখ যেমন ছিলেন বৈজ্ঞানিক, তেমনি ছিলেন মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ। বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তোলা, সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এসব নিবেদিতপ্রাণ গবেষকের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এসব বিজ্ঞানী জীবনের সব ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে নির্মোহ জীবনযাপন করেছেন। কখনও কখনও আবার উদ্দেশ্য সাধনে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেও এসব বিজ্ঞানী পিছপা হননি। এমনই কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবন ও গবেষণার বিষয়বস্তু অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে, যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়নের এ অপরিণামদর্শী পরিণামের কথা স্মরণ করেই ড. জাকারিয়া পরিবেশ ও উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষার উপায় তুলে ধরেছেন 'পরিবেশ ও প্রতিবেশ' নামক প্রবন্ধে। 'জীবের উৎপত্তি, বিবর্তনবাদ ও ডারউইন' নামে প্রবন্ধটিতে বিবর্তনবাদের সূত্র আলোচনা করতে গিয়ে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে বিরোধের ব্যাপারটি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে 'নাৎসি বুটের তলার জার্মান বিজ্ঞান' নামে প্রবন্ধটি বইয়ে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সংযোজন। হিটলারের বর্বর অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার্থে বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানী দেশত্যাগ করলেও বেশ কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও কীভাবে লুকিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন তার অজানা চিত্তাকর্ষক বর্ণনা এসেছে এ প্রবন্ধে।
ইউরোপের বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি 'বাঙালি বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক অবদান ও সমাজচিন্তা' নামক প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশ এবং সীমিত সুযোগে কোনো রকম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, কুদরত-এ-খুদার অসামান্য অবদানের কথা। 'বিজ্ঞানী কুদরত-এ-খুদা : জীবন ও সাধনা' নামে লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও এতে তার অসামান্য অবদানের ওপর অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ড. আবদুস সালাম তার আবিষ্কারের মাধ্যমে কীভাবে বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠলেন, এর ওপরে লেখা প্রবন্ধটি বইয়ের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। লেখক 'দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্যা ও সম্ভাবনা' নামক পাঁচ নম্বর প্রবন্ধে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিজ্ঞান, গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক চেতনা বিকাশের অন্তরায় হিসেবে দেখেছেন। জার্মান বিজ্ঞানীদের উন্নত দার্শনিক চেতনা দ্বারা প্রভাবিত লেখক ড. জাকারিয়া যে বার্তাটি দিতে চেয়েছেন তা হলো, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য অপরিহার্য।
শফিক উজ জামান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যে কোনো দেশের অগ্রগতির সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীতে এমন একটি দেশও পাওয়া যাবে না, যে দেশটি উন্নত অথচ বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তিতে পশ্চাৎপদ। অন্যদিকে একটি দেশ যত দরিদ্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও ততই অনগ্রসর। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বিজ্ঞানের কয়েকটি মৌলিক আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার হাজার বছরের পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে মাত্র কয়েক দশকেই সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নত জীবন সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে মানুষ হয়ে উঠেছে যুক্তিবাদী ও আত্মসচেতন। উন্নত সমাজ সৃষ্টির পরও এসব দেশে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রয়াস থেমে নেই। প্রকৃতিকে জয় করে জীবনযাত্রা আরও সচ্ছল এবং সহজতর করার প্রেরণা থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অনুন্নত বিশ্বের যেসব দেশ এখনও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হতে পারেনি তার অন্যতম কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনগ্রসরতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতেও স্বাধীনতার ৪১ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। অতীতের বন্যা, খরা আর দুর্ভিক্ষপীড়িত পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের গ্গ্নানি থেকে অনেকাংশে মুক্ত। কিন্তু আজও দেশের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য। অনেকের ধারণা, দারিদ্র্যপীড়িত দেশে বিজ্ঞান চর্চায় বিনিয়োগ অর্থহীন বিলাসিতা। দারিদ্র্য বিমোচনই সমগ্র উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে গত ৪১ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের নামে হাজার হাজার কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান এলেও আজও ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, ৫০ শতাংশ নিরক্ষর, ৫২ শতাংশ বিদ্যুতের সংযোগবিহীন আর ৭০ শতাংশ নূ্যনতম আধুনিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও সার্বিক দিক দিয়ে এ পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যর্থতা। যারা বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন ব্যয়বহুল এবং ফলাফল প্রাপ্তি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার; তাই দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতা অর্জনের পরই কেবল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে দৃষ্টি দেওয়া উচিত, তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি কেবল ভ্রান্তই নয়, চরম সুবিধাবাদী এবং দেশকে চরম পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে রাখার অপচেষ্টা।
আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন সমার্থক। শুধু দারিদ্র্য বিমোচনই নয়, দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ড. আবদুস সালামের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সংবর্ধনা সভায় বলেছিলেন, 'অর্থের সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে জিডিপির অন্তত এক শতাংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ব্যয় করা প্রয়োজন।' দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করেই তৃতীয় বিশ্বের কাতারে থেকেও আশির দশকেই চীন বিজ্ঞান গবেষণায় মনোনিবেশ করেছে। বছরে চীনের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা বাড়ছে ১৮ শতাংশ হারে। বিজ্ঞান গবেষণা খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দুই দশমিক চার শতাংশ। বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণা খাতে প্রকৃত ব্যয় মাত্র ০.০৩। শুধু চীন নয়, ভারত, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম অনেক আগেই জিডিপির এক শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করে বিজ্ঞান গবেষণা এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
খ্যাতনামা বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন বিজ্ঞান গবেষণাকে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতির কথা তার লেখনীর মাধ্যমে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার আবেদনে রাষ্ট্র সাড়া দিয়েছে তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আশার কথা, আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনের মতোই বিজ্ঞান চর্চাকে জনপ্রিয় ও প্রসারিত করার জন্য ড. আলি আসগর, ড. জাফর ইকবাল, ডা. কায়কোবাদ ও ড. জামাল নজরুল ইসলামের মতো বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রচেষ্টার সঙ্গে আরও যোগ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন প্রবাসী বিজ্ঞানী। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি অত্যাবশ্যক তা প্রবাসী বিজ্ঞানীরা বিদেশে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় কাজ করে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। তাই তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে গবেষণার পাশাপাশি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। ড. গোলাম আবু জাকারিয়া তাদেরই একজন। ড. জাকারিয়ার লেখা 'বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চা : প্রবাসী বিজ্ঞানীর ভাবনা' নামে বইটি তার বিভিন্ন সময়ের লেখা সংকলিত করে প্রকাশিত করা হয়েছে। বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধ প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর আগে লেখা, কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তার প্রাসঙ্গিকতা অম্লান। বইটিতে মোট ১৫টি প্রবন্ধ সংকলন করা হয়েছে। প্রবন্ধগুলোতে বিশ্বের খ্যাতনামা কয়েকজন বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট ও মানবকল্যাণে তাদের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এতে খ্যাতিমান ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণাও স্থান পেয়েছে।
গ্রন্থকারের প্রথম প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে বইয়ের শিরোনাম অর্থাৎ 'বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চা' দিয়ে। শুধু প্রকৃতিবিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ রেখে বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা বাংলাদেশে বিদ্যমান। বাংলাদেশে বিজ্ঞান বলতে শুধুই প্রকৃতিবিজ্ঞান অর্থাৎ রসায়ন, জীববিদ্যা, অঙ্ক শাস্ত্র ইত্যাদিকে বোঝানো হয়। সাহিত্য, সমাজবিদ্যা এগুলো বিজ্ঞান নয়। লেখকের ভাষায়, 'অর্থনীতিও যে বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যাও বিজ্ঞান, শুধু প্রকৃতিবিজ্ঞানই বিজ্ঞান নয়, এই অজ্ঞতার দেয়াল ভাঙতে হবে।' সমাজবিজ্ঞানের সঠিক ধারণার অভাবে অনেক বিজ্ঞানী সমাজ বিকাশের ধারাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখতে না পেরে সংকীর্ণ গলিতে চলাফেরা করেন। আবার প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্পর্কে নূ্যনতম জ্ঞান না থাকায় একই অবস্থার ফাঁদে পড়েন সমাজবিজ্ঞানীরা। এ সীমাবদ্ধতাই প্রথম প্রবন্ধে ড. জাকারিয়া স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় প্রবন্ধে লেখক নিউক্লিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি এর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব দিয়েছেন তা পড়ে যে কোনো পাঠকই শিউরে উঠবে।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞান হলো জ্ঞান আর প্রযুক্তি হলো প্রয়োগ বা ব্যবহার। জ্ঞান নিরপেক্ষ হলেও প্রযুক্তি নিরপেক্ষ নয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার মানুষের কল্যাণে না এসে উল্টো ধ্বংসাত্মক হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিহার করে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন পণ্য আবিষ্কার করেছেন, যা মানুষের কল্যাণ তথা সমাজের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। এমনই কয়েকজন কীর্তিমান বিজ্ঞানী_ রোন্টগেন, আইনস্টাইন, ফ্রিডরিখ হুড, ফ্রাউনহোফার, আবদুস সালাম প্রমুখ যেমন ছিলেন বৈজ্ঞানিক, তেমনি ছিলেন মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ। বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তোলা, সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এসব নিবেদিতপ্রাণ গবেষকের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এসব বিজ্ঞানী জীবনের সব ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে নির্মোহ জীবনযাপন করেছেন। কখনও কখনও আবার উদ্দেশ্য সাধনে মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেও এসব বিজ্ঞানী পিছপা হননি। এমনই কয়েকজন বিজ্ঞানীর জীবন ও গবেষণার বিষয়বস্তু অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে, যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়নের এ অপরিণামদর্শী পরিণামের কথা স্মরণ করেই ড. জাকারিয়া পরিবেশ ও উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষার উপায় তুলে ধরেছেন 'পরিবেশ ও প্রতিবেশ' নামক প্রবন্ধে। 'জীবের উৎপত্তি, বিবর্তনবাদ ও ডারউইন' নামে প্রবন্ধটিতে বিবর্তনবাদের সূত্র আলোচনা করতে গিয়ে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে বিরোধের ব্যাপারটি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে 'নাৎসি বুটের তলার জার্মান বিজ্ঞান' নামে প্রবন্ধটি বইয়ে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সংযোজন। হিটলারের বর্বর অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষার্থে বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানী দেশত্যাগ করলেও বেশ কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও কীভাবে লুকিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন তার অজানা চিত্তাকর্ষক বর্ণনা এসেছে এ প্রবন্ধে।
ইউরোপের বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি 'বাঙালি বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক অবদান ও সমাজচিন্তা' নামক প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশ এবং সীমিত সুযোগে কোনো রকম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, কুদরত-এ-খুদার অসামান্য অবদানের কথা। 'বিজ্ঞানী কুদরত-এ-খুদা : জীবন ও সাধনা' নামে লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও এতে তার অসামান্য অবদানের ওপর অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ড. আবদুস সালাম তার আবিষ্কারের মাধ্যমে কীভাবে বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠলেন, এর ওপরে লেখা প্রবন্ধটি বইয়ের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। লেখক 'দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্যা ও সম্ভাবনা' নামক পাঁচ নম্বর প্রবন্ধে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিজ্ঞান, গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক চেতনা বিকাশের অন্তরায় হিসেবে দেখেছেন। জার্মান বিজ্ঞানীদের উন্নত দার্শনিক চেতনা দ্বারা প্রভাবিত লেখক ড. জাকারিয়া যে বার্তাটি দিতে চেয়েছেন তা হলো, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার জন্য অপরিহার্য।
শফিক উজ জামান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments