ধানমণ্ডির ৩৪১ ভবন খাতায় আবাসিক, বাস্তবে বাণিজ্যিক by অমিতোষ পাল

রাজধানীর বনেদি আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ি। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর হিসেবে সুপরিচিত ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পশ্চিমে কয়েকটি ভবনের পরেই বাড়িটির অবস্থান। বাড়িজুড়ে নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। নিচতলায় গলপিয়া বার্গার নামের একটি ফাস্টফুডের দোকান।


চার তলা ভবনের কেবল চতুর্থ তলা ছাড়া সব কয়টিতেই চলছে রমরমা বাণিজ্যিক কার্যক্রম। কোনোটিতে এনজিওর অফিস, কোনোটিতে অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। দেখে বোঝার উপায় নেই এটি আবাসিক ভবন। অথচ রাজউকের নকশায় এটি আবাসিক হিসেবেই অনুমোদিত। কিন্তু নিয়ম লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর এটাতে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
সরেজমিনে গিয়ে ভবনের মালিক হাজি শরফুদ্দিনকে পাওয়া যায়নি। ভবনের কেয়ারটেকার নেয়ামত হোসেন বলেন, 'তিনি (মালিক) পুরান ঢাকায় থাকেন। মাঝেমধ্যে এখানেও থাকেন। তবে তাঁর কোনো ফোন নম্বর আমার কাছে নেই।'
ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, ভবনটির গায়ে সাঁটানো আছে অন্তত ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। এগুলো হলো রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, নাগরিক উদ্যোগ সহায়তা প্রকল্প, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে তাঁরা অফিস হিসেবে তলাগুলো ব্যবহার করছেন। ভবনটি বাণিজ্যিক না আবাসিক হিসেবে অনুমোদিত, সেটা তাঁদের দেখার বিষয় নয়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভাড়াটিয়া বলেন, 'বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার অনুমতি যে এই ভবন মালিকের নেই, সেটা আমরাও জানি। কিন্তু ধানমণ্ডিতে এ রকম শত শত ভবন আছে, যেগুলো আবাসিক হিসেবে অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।'
কেবল এই ভবন নয়, রাজউকের হিসাব মতে ধানমণ্ডিতেই এ ধরনের আবাসিক ভবনের সংখ্যা ৩৪১টি, যেগুলোতে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এর ফলে আবাসিক এলাকাটি অনেক আগেই তার পুরনো চেহারা হারিয়েছে। এলাকায় সব সময় যানজট আর হাঙ্গামা লেগেই থাকে।
গত ১১ জুন উচ্চ আদালত ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা থেকে তিন বছরের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে ফেলতে রাজউককে নির্দেশ দেন। এর পরই রাজউক ধানমণ্ডি এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলা আবাসিক ভবনগুলোর তালিকা করতে শুরু করে। সম্প্রতি রাজউক সেই তালিকা চূড়ান্ত করেছে। তাতে দেখা যায়, আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে গার্মেন্ট, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, শপিং মল, বাজার, হাসপাতালসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রমই চলছে। এ ক্ষেত্রে কেউ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। রাজউকের হিসাবেই ধানমণ্ডি এলাকায় ৭৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে আবাসিক ভবনে। বিভিন্ন সময়ে রাজউক নোটিশ দিলেও মালিকরা আমলে নেননি। বরং নতুন গড়ে ওঠা ভবনগুলোতেও শুরু হচ্ছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
ধানমণ্ডি এলাকার দায়িত্ব পালনকারী রাজউকের অথরাইজড অফিসার আমিনুর রহমান সুমন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেই মামলায় রাজউক জিতেছে। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে এভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো যাবে না। কিন্তু আদালতের আদেশ আমরা এখনো পাইনি। পেলেই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করব।'
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আদালতের রায় আমাদের পক্ষে যাওয়ার পরপরই মালিকদের নোটিশ দেওয়া শুরু হয়েছে। নোটিশে একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাঁরা বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ না করলে রাজউক অ্যাকশনে যাবে। তবে স্কুল বা একটি হাসপাতাল ইচ্ছা করলেই এক দিনের মধ্যে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এ ধরনের ভবন মালিককে এক-দুই বছর সময় দিচ্ছি। অন্যগুলোর জন্য দু-এক মাস সময় দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে সরিয়ে না নিলে অভিযান চালিয়ে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে।'
যেভাবে চলছে বাণিজ্যিক ব্যবহার : ধানমণ্ডি এলাকার বিভিন্ন আবাসিক ভবন অবৈধ বাণিজ্যিক ব্যবহারের ওপর রাজউকের প্রণীত তালিকায় এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। রাজউকের তালিকায় দেখা যায়, ধানমণ্ডি ১ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলাটি মালিক শেহজাত আলী একটি অফিসের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। ৬ নম্বর ভবনের মালিক আনোয়ার হোসেন ভবনের একাংশ একটি টেঙ্টাইল অফিসের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। ডা. মনোয়ার রহমান ১১ নম্বর প্লটের ভবনটির একাংশ স্কিন কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। ১০ নম্বর প্লটের মালিক শহিদুল ইসলাম তাঁর ভবনের একাংশ দোকান হিসেবে ব্যবহার করছেন। ১৬/১ প্লটের মালিক রেজাউল করিম একটি হোমিওপ্যাথিক ক্লিনিকের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। ২৬ নম্বর প্লটের মালিক মো. নাসির উদ্দিন গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করছেন। ১৭ নম্বর প্লটের মালিক সালমান এফ রহমান বেঙ্মিকো গ্রুপের অফিস হিসেবে ব্যবহার করছেন। ডা. মোহাম্মদ সাইফুল আজম গং ২৯ নম্বর প্লটটি দোকান ও ডেন্টাল কেয়ারের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। শহিদুল ইসলাম ৩৩ নম্বর প্লটের নিচতলা বিউটি পারলারের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। প্রফেসর আমিরুল ইসলাম ৩৫ নম্বর প্লটটি ফার্মেসি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ৩৭/এ প্লটের মালিক ফাহিদুল ইসলাম অফিস হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন।
আরো যেসব প্লট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে : ২ নম্বর সড়কের ৩২/এ, ৩৭/১, ৩৪ ও ৩৩ নম্বর হোল্ডিং; ২/এ সড়কের ৬২, ৫২ ও ৫০ নম্বর হোল্ডিং; ৩ নম্বর সড়কের ৩২/এ, ২৭, ২৩, ২৩/এ, ২২, ১৯/এ, ১৫/২, ১২, ৬ ও ৫ নম্বর হোল্ডিং; ৩/এ সড়কের ৪২, ৪৭, ৫২/এ, ৪১, ৪৪ ও ৫২ নম্বর হোল্ডিং; ৪ নম্বর সড়কের ১২/বি, ১১, ১১/এ, ১৩/এ, ১৪, ১২, ১৩, ১৫/বি, ১৫, ১৭, ২৮, ৩৫, ৩৩, ১৫/এ, ১৯/এ, ৩৩, ৩৩/বি ও ৩৪ নম্বর হোল্ডিং; ৪/এ সড়কের ৫১, ৪৯,৩৯, ৫২, ৪৩, ৪১/ক, ৪০, ৬১/এ, ৬০/১ নম্বর হোল্ডিং; ৫ নম্বর রোডের ৫, ১২, ৪৩, ৩৮/এ, ২৯, ২৫/বি ও ২০ ও ৬ নম্বর হোল্ডিং; ৫/এ সড়কের ৬০, ৫৭, ৫৬, ৭৫/১, ৭/১৩ ও ৭৩ নম্বর হোল্ডিং; ৬ নম্বর রোডের ২, ৪, ১৯/১, ১০, ১০/বি, ২৫/এ, ৩২/এ, ১৬, ২৫/বি, ৩০, ৩১/এ, ৩৪/১, ৩৩, ২৮ ও ২৮/বি ও ১৬/১ নম্বর হোল্ডিং; ৬/এ নম্বর সড়কের ৫৭, ৫৭, ৫৯, ৫১, ৪১, ৪০, ৪৬, ৬৮/এ, ৭০/এ, ৬৫ ও ৬৯ নম্বর হোল্ডিং; ৭ নম্বর সড়কের ২৮, ২৯, ২৬ ও ২৩/ক, ৩৪, ৪২, ১৫, ১৬, ১৩, ১৪, ১২, ১১, ১০, ৮ ও ৮/এ নম্বর হোল্ডিং; ৭/এ নম্বর সড়কের ৫৯/এ, ৬১, ৬৩, ৫৯, ৬০, ৬২, ৬৫/এ, ৬৬, ৬৯, ৭২, ৬৯/২, ৭৮/১, ৮২, ৭৫, ৭৭/বি, ৮০, ৭১, ৬০/এ, ৫২, ৫৮ ও ৮৮/এ নম্বর হোল্ডিং; ৮ নম্বর সড়কের ৩১/এ, ৪১ , ৮৭, ৩৩, ৩৯/এ, ৩৭, ৩/১, ৪/এ, ৬, ১৬, ৭, ১৪ ও ১৭/২০ নম্বর হোল্ডিং; ৮/এ সড়কের ৭৮, ৭২, ৬৭ , ৫৪, ৬৯, ৬৫, ৫৫/১, ৫১, ৪৭, ৫২, ৬৬/এ, ৮৯, ৮৭/এ ও ৬৪ নম্বর হোল্ডিং; ৯ নম্বর সড়কের ১০/১ নম্বর হোল্ডিং; ৯/এ সড়কের ২১, ১৫, ১৬, ৩৬, ২৫/বি, ২৯, ৩১, ২৯, ৩০, ৩১/এ, ৩৩, ৩৩/এ, ৩৪/এ, ৩৫, ৩৮, ৩৭, ৩৯, ৪৩/বি, ৩৮/এ, ৪৬, ৪২, ৪৪, ৩২, ৩৪, ১২৪, ১২৫, ১২৮, ১১৯, ১১৮, ১১৭, ১১৩, ১০৭, ১০৫, ১০৩, ১০৪, ৯৫, ৯১, ৮১/এ, ৭৫, ৭৩, ৭১, ৬৯, ৭০, ৬৭/বি, ৬৭/এ, ৬৪, ৯১, ৫৯, ৬০, ৫২/এ, ৫৫ ও ৫৭/এ নম্বর হোল্ডিং; ১০ নম্বর সড়কের ১৭, ১৫, ১৩, ৫, ৩/১ নম্বর হোল্ডিং; ১০/এ সড়কের ৫১/এ, ৫১, ৪৯, ৪১, ৩৪/এ, ৩২, ৪২, ৩৪, ৩০, ২৯/এ, ২৩, ২৬ ও ৩৮ নম্বর হোল্ডিং; ১১ নম্বর সড়কের ৬, ১২, ১৮সি নম্বর হোল্ডিং; ১১/এ নম্বর সড়কের ৪৮/এ, ৪৬/সি, ৪৬/এ, ৪৪, ৭৮/বি, ৮৩/এ, ৬৭, ৭৪, ৮৫, ৯১, ৮৫/এ, ৮৮, ৯৫, ৯৬, ৮৪, ৬৮/এ, ৬৬ ও ৯১ হোল্ডিং; ১২ নম্বর সড়কের ৮৯/২, ১৯, ৮/এ, ১০, ১২, ৪৮, ১১/এ, ১১/বি, ১/আর নম্বর হোল্ডিং; ১২/এ সড়কের ২৭/বি, ৮৯/এ, ৮৭, ৮১, ৯৯, ৮৬, ৭২, ৭৯, ৭৭/এ, ৬৬/৪, ৬৭/বি, ৬৪, ৫৫/এ, ৪৭, ৬৭/এ, ৬০/১, ৫৩, ৪৫/এ, ৫৭, ৫৯ নম্বর হোল্ডিং; ১৩ নম্বর সড়কের ৭, ১১, ৯/ঘ, ৩ নম্বর হোল্ডিং; ১৩/এ সড়কের ১৫, ২৭, ২৩, ২৭/এ নম্বর হোল্ডিং; ১৪ নম্বর সড়কের ৮/৩, ৩, ৭ নম্বর হোল্ডিং; ১৪/এ সড়কের ৪০/এ, ৩৬, ৩৭/এ, ৩১, ৩৪, ২৩ নম্বর হোল্ডিং; ১৫ নম্বর সড়কের ৫, ৭, ১১, ৩৫, ২০/১, ৯/এ, ১৮ নম্বর হোল্ডিং; ১৫/এ সড়কের ৪২, ৫৪, ৫৮, ৫৭/সি, ৬৮/৬৬, ৬৭/বি, ৭০ নম্বর হোল্ডিং; ১৬ নম্বর সড়কের ১৯/এ নম্বর হোল্ডিং।
রাজউকের প্রতিবেদনে কিছু হোল্ডিং নম্বর সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করে কেবল রোড ও মালিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.