ভেজাল দুধ- রবীন্দ্রনাথ ও রাউতারার গোয়ালারা by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

পূর্ববঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর জমিদারির ইউসুফশাহি পরগনা পাবনার সাজাদপুরে কবি-জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম আসেন ১২৯৬ বঙ্গাব্দে। এখানকার জমিদারি এস্টেট ভাই গিরীন্দ্রনাথের ভাগে পড়লে, সাজাদপুরে তাঁর আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সাজাদপুরের জমিদারিতে রবীন্দ্রনাথের অবস্থানকাল একেবারে কম নয়, প্রায় নয় বছর।


এখানে তিনি সর্বশেষ এসেছিলেন ১৩০৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে। এই কয় বছরেই অনেক কীর্তির স্বাক্ষর সাজাদপুরে রেখে গেছেন কবি-জমিদার।
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ এস্টেটে যেমন রেশমের চাষসহ বিভিন্ন কৃষি কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন, পতিসরে যেমন হিতৈষী সভা গঠন করে গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন, পাট ব্যবসার কেন্দ্র আত্রাইয়ে যেমন পাটের ব্যবসায় শুরু করেছিলেন, তেমনি সাজাদপুরে তিনি যুক্ত হন গো-পালন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।
সাজাদপুরের দুধ ও দুধের তৈরি ঘি, মিষ্টান্ন ও দধি যে রবীন্দ্রনাথের খুবই প্রিয় ছিল, তা স্বজনদের কাছে পাঠানো চিঠিপত্র থেকে জানা যায়। ১৩৭২ বঙ্গাব্দে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ৮ সংখ্যক চিঠিতে আছে সাজাদপুর থেকে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে পাঠানো ঘিয়ের প্রসঙ্গ। কবি লিখেছেন:
‘আচ্ছা, আমি তোমাকে এই সাজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখনমারা ঘেত্ত সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্মন্ধে কোন রকম উল্লেখমাত্র করলে না তার কারণ কি বল দেখি?’
ঘি-দুধের প্রতি অপরিসীম আকর্ষণের কারণেই হোক আর প্রজার হিতার্থেই হোক, রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুরের অদূরে রাউতারার ঘোষদের সহায়তায় গো-খামার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাউতারার বনেদি দুগ্ধ ব্যবসায়ী গিরি ঘোষ তাঁকে ওই গো-খামার প্রতিষ্ঠায় নানাভাবে সহায়তা করেন বলে একটি সূত্র থেকে জানা যায়।
রবীন্দ্রনাথ পাঞ্জাবের শাহিওয়াল থেকে উন্নত জাতের ষাঁড় এনে স্থানীয় গাই-গরুর সঙ্গে ক্রস করে ‘পাবনা ব্রিড’ নামে এক নতুন গো-প্রজাতির উদ্ভাবন করেন। রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুর ছাড়ার কয়েক বছর পর গো-খামারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তবে, রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব জমিদারি পতিসর এস্টেটের সর্বশেষ ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীর এক চিঠি থেকে জানা যায়, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হওয়ার পর একবার সাজাদপুর গিয়েছিলেন কেবল পিতার গো-খামারের জায়গা ঘুরে দেখতে। সাজাদপুরের উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় রবীন্দ্রভক্তদের উদ্যোগে সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের ওই গো-খামারের ৬০০ বিঘা জমির কাগজপত্র পাওয়া গেছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। সাজাদপুরের দুধের প্রাচুর্য ও খ্যাতির কারণে জনৈক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সাজাদপুরের অদূরে লাহিড়ী মোহনপুরে ১৯৪২ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি এনে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যে কারণেই হোক, কারখানাটি চালু হয় অনেক পরে ১৯৫০ সালে ‘ইস্টার্ন মিল্ক প্রডিউসার লিমিটেড’ নামে। প্রশাসনিক নানা জটিলতার কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সমবায় বিভাগকে চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। বস্তুত এটি এখন বাঘাবাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত ‘মিল্ক ভিটা’য় রূপান্তরিত হয়েছে। এই মিল্ক ভিটায় বছরে ২.১৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়, যা থেকে দেশের শতকরা ১৪ ভাগ দুধের চাহিদা মেটানো হয়। একটি তথ্য সূত্র থেকে অবহিত হওয়া যায়, সাজাদপুরের দুধের প্রাচুর্যের কারণে মিল্ক ভিটার পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বেশ কটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপিত হয়েছে। ওই কারখানাগুলো হয়ে উঠেছে ভেজাল দুধের আখড়া। একশ্রেণীর অসাধু দুগ্ধ উৎপাদক ছানার পানি, ময়দা ও চিনি জ্বালিয়ে তাতে ফরমালিন, কাটিং অয়েল, পার-অক্সাইড, খাওয়ার সোডা ও ননি মিশিয়ে কৃত্রিম দুধ তৈরি করছে। এই ভেজাল দুধই বেসরকারি ডেইরি প্রজেক্টের কুলিং সেন্টারে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকাসহ সারা দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই দুধ নামীদামি ব্র্যান্ডের মোড়কে চলে যাচ্ছে ক্রেতাদের কাছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, এ দুধ মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পেটের পীড়া, ডায়রিয়া ছাড়াও কিডনি এবং যকৃতের ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে।
সাজাদপুর ও আশপাশে এই ভেজাল দুধ প্রস্তুতকারীর সংখ্যা অনেক। বলা যায়, প্রায় নির্বিবাদেই এ অঞ্চলের গোয়ালারা এই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। যে রাউতারা একসময় উৎকৃষ্ট মানের গো-দুগ্ধ উৎপাদন করে অবিভক্ত বঙ্গে খ্যাতি লাভ করেছিল, যে খ্যাতির কারণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও শুরু করেছিলেন খাঁটি গো-দুগ্ধের জন্য গো-খামার প্রতিষ্ঠার কাজ, সেখানে এখন কতটা অধঃপতন! এসব দেখার জন্য কোথাও কি কেউ নেই! জানা গেছে, এ ভেজাল দুধ উৎপাদনকারীদের জন্য শক্তিশালী আইন না থাকায় প্রচলিত আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন কঠোর আইন প্রণয়ন করে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। যুগপৎ সরকারের সঙ্গে এলাকার জনগণকেও সংঘবদ্ধভাবে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।
জানি না, কবিগুরু বেঁচে থাকলে এ অবস্থায় রাউতারার বনেদি গোয়ালারা কী জবাব দিতেন?
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: অধ্যাপক, গবেষক ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.