শূন্য হাতের প্রার্থনা by সানাউল হক খান
বুকপকেটে ভাঁজ করে রেখেছিলাম তালিকাটি। বেশ কদিন আগেই। আনন্দ-বেদনার ওই তালিকাটি আমার এক ঝলক দীর্ঘশ্বাসের। পদক তালিকা। অলিম্পিক শেষে, অর্থাৎ লন্ডন অলিম্পিক-উত্তর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট প্রদত্ত তালিকা: সেখানে অংশগ্রহণ করা দুই শতাধিক দেশের মধ্যে সাকল্যে ৮৪টি দেশের নাম লিপিবদ্ধ, যারা শূন্য হাতে ফেরেনি।
একটি তাম্রপদক জুটলেও জুটেছে।
মাত্র একটি করে তাম্রপদকের বাঁ দিকে লেখা সাতটি দেশের নাম: আফগানিস্তান, বাহরাইন, হংকং, সৌদি আরব, কুয়েত, মরক্কো ও তাজাখস্তান। মাত্র একটি করে রুপা পাওয়া ছয়টি দেশ হচ্ছে বতসোয়ানা, সাইপ্রাস, গ্যাবন, গুয়েতেমালা, মন্টেনিগ্রো ও পর্তুগাল। একটি করে রুপা ও একটি করে ব্রোঞ্জপদক পাওয়া দেশ হচ্ছে পাঁচটি: বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, মালয়েশিয়া, পুয়ের্তোরিকো ও চীনা তাইপে।
একাধিক রুপা/ব্রোঞ্জপদকে সম্মানিত দেশগুলোর নাম আর উল্লেখ করলাম না। শুধু এটুকুই বলব, বাংলাদেশ তো বটেই, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এক ভারত (প্রায় ১২৫ কোটির কাছাকাছি জনসংখ্যা) ছাড়া ১৮ কোটির পাকিস্তান, প্রায় সাড়ে তিন কোটির নেপাল, তিন কোটির শ্রীলঙ্কা, এবং সাত-পাঁচ লাখের ভুটান-মালদ্বীপ এসেছে একেবারেই খালি হাতে।
সবার কথা থাক। নিজের চরকাটা ঘোরানোর মতো প্রয়োজনীয় তেলটাই যে নেই, এই মহা সত্যটা কি হিসাবের খাতায় লিপিবদ্ধ রাখা ফরজ নয়? বেইজিং অলিম্পিকের তুলনায় লন্ডন অলিম্পিকে ভারতের অর্জনটা ‘আহামরি’ না হলেও ‘ফেলনা’ নয়, এই কথা বোঝার এবং বোঝানোর মতো কজনই বা আছেন এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মাটিতে?
জনগুরুত্বের বিষয় নিয়ে অনেক জ্ঞানী-গুণী, সাধু-সন্ত-বাউল অনেক ধরনের গীতকথন করে যা রেখে গেছেন, তা কোনো ধরনের সমীকরণেই পড়ে না। এক-দুটি উদাহরণই যথেষ্ট: এই পাকিস্তান কি কোনোকালে (অলিম্পিকের পর অলিম্পিক) সোনা-রুপা পায়নি? এখন ভারতীয়-মঙ্গোলীয়-থাইল্যান্ডের মেয়েরা বক্সিং করছে কীভাবে? ওয়েটলিফটিং করছে কীভাবে? একজন সাইনা নেহওয়াল জাপানি, কোরীয়, সিঙ্গাপুরি, হংকংয়ের মেয়েদের ব্যাডমিন্টনে হারায় কীভাবে? আসলে ব্যাপারটা সাধারণ। গণিতশাস্ত্রকে বিদায় জানিয়ে ক্রীড়াবিজ্ঞানের মূলমন্ত্রকেই প্রাধান্য দিয়েছে। সেখানে একটি কাব্যচরণই যথেষ্ট, ‘লেখাপড়া শিখে যখন নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই/ পৃথিবীর ছয় শ কোটি মানুষের মতো সেও একজন মানুষ/ আর সকল মানবাধিকার নিয়েই জন্মেছে সে/ এ কথা বলতেই তার ‘আপন’ হয়ে যায় পর আর ‘পর’ হয়ে যায় আপন। (সৌজন্য: ‘ন্যায় যুদ্ধের অপেক্ষা’)
এ রকম অনেক চরণই উদ্ধৃত করা যায়। কিন্তু এটা কী করে উদ্ধৃত করি ‘সব শিক্ষিত (?) স্বজনই প্রবহমান রক্তের মানুষ’! কে কার কথা শোনে?
আজ কিছু পেলাম না। ক্ষতি কী? কাল পাব—এই ‘কাল’ শব্দটি মহাকালকে সাক্ষী করেও বলতে পারবে না, ‘আজ’ এসেছি। সোনা-রুপা-তামা নয়, লড়াই তো করেছি। খোদার কসম, লড়াই তো করেছি। নামাজ শেষে মোনাজাত নিতে গিয়ে যেন না বলি: ‘প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম গুরু হে।’ বিদেশ দেখাও আলোয়-আলোয়, স্বদেশ থাকুক অন্ধকারে।
ক্রীড়াঙ্গনের নাব্যতা যদি বছরের পর বছর গিলে খায় স্থলের ক্ষুধার্ত হাঙরে, তাহলে কোরআন-বাইবেল-ত্রিপিটক, বেদ-বেদান্ত ছুঁয়ে বলতে পারি—আমাদের দৌড় খোকা, ও. কা., পটল-আহাদ পর্যন্তই...আলীম-বকুল-ডলিক্রুজদের রাস্তাটাই পাব না, আজ বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেই যাঁরা বাতিলের খাতায়। আজ সেখানে বাংলাদেশের ছেলে-ফুটবল জাপানি মেয়ে-ফুটবলের কাছে ছত্রখান হতে বাধ্য (অনুমান যদিও পাপ), সেখানে কোন সাহসে বলি—হবে। এই তো হলো বলে...। গুল্লি মারি এসব আপ্তবাক্যের।
হ্যাঁ, অংশগ্রহণই বড় কথা। নইলে ইজ্জত পাংচার। অ্যাফিলিয়েশন কাটা যাবে।
আমি সেই তীব্র কাব্য-আকাঙ্ক্ষার কথা কীভাবে লুকিয়ে রাখতে পারি:
`How are my powers fore-spoke? What strange
-distaste in this?
Hence, cruel hate of that which sweetest is:
Come, come delight, make my dull brain
Feel once heat of joy again¤
-Thomas Campion
আমার আত্মবিশ্বাস এখনো জীবনের চেয়ে বেশি গোলাকার, ভুবনের মতো ভারী। এই দ্রোহসত্য কে বুঝবে?
No comments