সমকালীন প্রসঙ্গ-নদীবক্ষে ভূমিদস্যুতা এবং অপরাধের জগৎ by বদরুদ্দীন উমর
চুরি-দুর্নীতি সব দেশেই অল্পবিস্তর হয়ে থাকে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও সমাজ থেকে অপরাধ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয় না। কাজেই অপরাধহীন সমাজ বলে বাস্তবত কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে ও যত বিচিত্র ক্ষেত্রে চুরি-দুর্নীতি হতে দেখা যায়, এমনটা খুব কম দেশেই দেখা যায়।
বাঙালিরা এমনিতেই চুরি-দুর্নীতিতে কোনো সময়েই খুব পিছিয়ে থাকেনি। এ কারণে বাংলায় 'পুকুরচুরি' বলে একটা কথা আছে। যতদূর মনে হয়, পুকুর ভরাট করে জমি তৈরি ও দখলের থেকেই এ কথার জন্ম। আসলে আগে কালেভদ্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও এ ধরনের চুরিকেই চৌর্যকর্মের সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত মনে করা হতো। অন্য ভাষায়, এমনকি অন্য ভারতীয় ভাষাতেও এ রকম কথার প্রচলন আছে কি-না জানা নেই। যদি না থাকে তাহলে বোঝা যাবে, ভূমিদস্যুতা বাংলায় যেভাবে হয়ে এসেছে, এমন আর কোথাও হয়নি। শব্দ ও কথার উৎপত্তি সমাজের বাস্তবজীবন ও কাজ-কারবারের মধ্যে। পুকুরচুরির কথা যদি অন্য ভাষায় না থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে, অন্য সমাজে সেই ধরনের ব্যাপার নেই। সেসব সমাজে বড় বড় চুরি-দুর্নীতির ঘটনা থাকলেও পুকুর ভর্তি করে জমি দখলের মতো চুরি-দুর্নীতির ফায়দা সেখানে নেই। তা না থাকার জন্য বড় মাপের চুরি-দুর্নীতিকে পুকুরচুরি না বলে তারা অন্য কিছু বলে।পুকুরচুরির কথা এখানে বলার কারণ, জলাভূমি দখল করে জমি বানানোর যে ব্যাপার আগে ছিল তার তুলনায় এখনকার অবস্থা এতই খারাপ যে, শুধু পুকুর বা ছোটখাটো খাল-বিলই নয়, দেশজুড়ে এখন ছোট-বড় নদী নিয়মিত ভরাট করে দখল করা হচ্ছে। অন্য জায়গার কথা বাদ দিলেও খোদ রাজধানী ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী যে চারটি নদী আছে, সেগুলো পর্যন্ত নিয়মিতভাবে ভরাট হয়ে অপরাধীদের দখলভুক্ত হচ্ছে। পরিস্থিতি এদিক দিয়ে এত খারাপ যে, ভূমিদস্যুরা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত দখল করে সেখানে ঘরবাড়ি খাড়া করে হোটেল ও দোকানপাট তৈরি করছে!
ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুড়িগঙ্গার অবস্থা শোচনীয়। এই নদীতে নানা ধরনের শিল্প-কারখানা থেকে বর্জ্য পদার্থ পড়ে এককালের এই সুন্দর ও জীবন্ত নদীটিকে এখন কৃষ্ণবর্ণ ও মৃত নদীতে পরিণত করেছে। এ নদীতে মাছসহ নানা জলজ প্রাণী নিশ্চিহ্ন হতে হতে এখন প্রায় শেষ হয়েছে। শিল্প-কারখানাগুলোকে তাদের বর্জ্য পদার্থ পরিশোধনের জন্য এবং সে সঙ্গে অনেক কারখানাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার নির্দেশ দিয়ে থাকে। কিন্তু এসব নির্দেশ কেউ মান্য না করার কারণে সেগুলোকে কাগুজে ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। কাজেই শিল্পবর্জ্য বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগে নিয়মিতভাবে নিক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিটির হাল একই রকম করেছে। এসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে; কিন্তু এর কোনো ফল আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
নদীর পানি দূষিত হওয়ার এই ব্যাপার ছাড়া এখানে নদী সম্পর্কিত যে বিষয়টি আলোচনার প্রয়োজন তা হলো, নদী ভূমিদস্যুদের দ্বারা নিয়মিতভাবে ভরাট হয়ে দখল হতে থাকা। ঢাকার পত্রিকাগুলোর মধ্যে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রায়ই খুব জোরালোভাবে এর ওপর অনেক সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশ করে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই তারা নদী দখলের বিরাট ছবি ছাপে, দখলকর্মের অনেক বিবরণও তাতে থাকে। কিন্তু এর কোনো প্রভাব সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর পড়ে বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে তারা নদীর দখল উচ্ছেদ করলেও কয়েকদিন পর পূর্ব দখলকারী আবার একই জায়গা দখল করে তার ওপর বাড়িঘর তৈরি করে! কাজেই সরকারের এই উচ্ছেদ প্রচেষ্টাকে প্রকৃতপক্ষে লোক দেখানো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে ডেইলি স্টারে বুড়িগঙ্গা নদী দখলের ওপর প্রথম পৃষ্ঠায় এক বিরাট ছবিসহ একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, জলাভূমি দখলের জন্য গত ১০ বছরে কারও জেল হয়নি। ২০০০ সালে ডবঃষধহফ ধহফ ড়ঢ়বহ ংঢ়ধপব পড়হংবৎাধঃরড়হ অপঃ জারি হলেও এ আইনের আওতায় গত ১০ বছরে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি, কাউকে শাস্তি দিয়ে জেলে পাঠানো হয়নি। শহরের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোকে ভূমিদুস্যদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকার অনেক প্রতিজ্ঞা করলেও কোনো ক্ষেত্রে নদী ভরাট করা মাটি সরানো হয়নি। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো বেআইনি স্থাপনা ভেঙে ফেললেও ভরাট করা যে মাটির ওপর এ কাজ করা হয়, সেটা না সরানোর ফলে অতি সহজেই আবার দখলকারীরা নতুনভাবে একই জায়গায় বাড়িঘর তৈরি করে নিজেদের দখল কায়েম করে। শুধু তা-ই নয়, ভূমি দফতরের অসৎ সরকারি কর্মচারীদের সাহায্যে অনেকেই নদীর ওপর নিজেদের 'বংশগত' মালিকানার দলিল পর্যন্ত তৈরি করে মামলা চালায়! শুধু নদী নয়, সমুদ্র-তীরবর্তী জায়গাও এভাবে 'বংশগত' সম্পত্তি হিসেবে দখল করার ব্যাপার কক্সবাজারে দেখা গেছে! এসব দলিলের ভুয়া চরিত্র সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব হলেও সরকারি সহায়তার বলেই এ ভূমিদস্যুরা অদমিত ও বেপরোয়া থাকে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, শুধু ভূমিদস্যুরাই নয়, সরকারি কর্তৃপক্ষও এ কাজ করে থাকে। ঢাকার সদরঘাটে পর্যন্ত এভাবে বুড়িগঙ্গার তীর ভরাট করে সরকারি স্থাপনা তৈরির দৃষ্টান্ত আছে। এসব স্থাপনা ভেঙে ফেলার পরিবর্তে সেগুলোতে সরকারি কাজকর্ম পরিচালনা করা হয়। কাজেই সরকার নিজেই যখন ভূমিদস্যুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের তৈরি আইন লঙ্ঘন করে, তখন তার মধ্যেই ভূমিদস্যুরা অপরাধ করার শক্তির জোগান পায়। ২০০০ সালে ডবঃষধহফ ধহফ ড়ঢ়বহ ংঢ়ধপব পড়হংবৎাধঃরড়হ অপঃ করার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের পরিবেশ রক্ষা করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এ আইনের কোনো যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায়নি। জলাভূমি, খালবিল ও নদী ভরাটের জন্য আজ পর্যন্ত কারও কোনো শাস্তি হয়নি। ২০০০ সালের উপরোক্ত আইন ভঙ্গের জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়ই হওয়ার কথা। কিন্তু এ ধরনের কোনো শাস্তি কারও হয়নি। উপরন্তু একে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভূমিদস্যুরা নিয়মিতভাবেই নদীসহ সব ধরনের জলাধার দখল করেই চলেছে।
আগেই বলা হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি কর্তৃপক্ষ নদী ভরাট করা জায়গার ওপর স্থাপনা ভাঙার পর আবার পূর্ববর্তী দখলকারী নতুন করে সেই জায়গা দখল করে তার ওপর স্থাপনা তৈরি করে। দ্বিতীয়বার এই একই অপরাধের জন্য যে বর্ধিত শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা হলো ১০ বছরের জেল, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। এ আইনও ভূমিদস্যুদের তাদের অপরাধ থেকে নিরস্ত করে না। কারণ কোনো আইনের কোনো প্রয়োগ ও কার্যকারিতা নেই। ঢাকা শহরের আশপাশে নদী দখলকৃত অন্তত একশ' জায়গার ওপর বেআইনি স্থাপনা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা হয় না। কারণ সরকারি কর্তৃপক্ষ ছাড়াও আইনের নানা ফাঁকফোকর দেখিয়ে আদালতও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে এদের রক্ষা করেন! অর্থাৎ শুধু সরকারি কর্মচারীরাই নয়, আদালতও দুর্নীতির মাধ্যমে এই ভূমিদস্যুদের তাদের দখল বজায় রাখতে সাহায্য করে!
কিন্তু মজার ব্যাপার এই, যে ইধহমষধফবংয ওহষধহফ ডধঃবৎ ঞৎধহংঢ়ড়ৎঃ অঁঃযড়ৎরঃু (ইওডঞঅ) নদী দখলকারীদের উচ্ছেদের কথা বলে ও চেষ্টা করে, তারা নিজেরাও আদালতের রায় অমান্য করে বুড়িগঙ্গার উভয় তীরে মাটিভর্তি করে তার ওপর স্থাপনা তৈরি করেছে! ২৫ জুন ২০০৯ সালে হাইকোর্ট নদীর ওপর সব স্থাপনা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়ার পরও কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা ভরাট করে সেখানে একটি জেটি তৈরি করা হয়েছে! এ ক্ষেত্রে আবেদনপত্রে ইওডঞঅ নিজেদের পক্ষে আদালতের রায় পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম পর্যন্ত ব্যবহার করেছে! হাইকোর্টের নির্দেশ মান্য না করে সরকার নিজেই স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলার পরিবর্তে সেগুলো আরও দু'বছর রাখার জন্য হাইকোর্টের কাছে আপিল করেছে!
যে দেশে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ নদীসহ সব ধরনের জলাশয় ভূমিদস্যুদের দ্বারা দখল হয় এবং সরকার এ ব্যাপারে তাদের সহায়তা করে, সেখানে অপরাধের মাত্রা কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা সহজেই বোঝা যায়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল থেকে লুণ্ঠন, চুরি-দুর্নীতি যেভাবে বিস্তার লাভ করে অপরাধ সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ ছড়িয়ে দিয়েছে, এর চেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার কোনো দেশের পক্ষে আর কী হতে পারে? হাজার রকম অন্য দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও জলাশয় ও নদী দখল সম্পর্কিত যেসব ঘটনার উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে তার থেকে বোঝা যায়, অপরাধের বিস্তার ও তার মাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ বাংলাদেশে অপরাধীর জন্য কার্যত শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। তাছাড়া সরকার নিজেই যেখানে অনেক ধরনের অপরাধের ঘটক, সেখানে তো অবস্থা 'বেড়ায় ধান খাওয়ার' চেয়েও অনেক খারাপ।
অপরাধের জন্য শাস্তির কোনো ব্যবস্থা না থাকা, বিশেষত সরকার ও সমাজের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের অপরাধ শাস্তিযোগ্য না হওয়ায় দেশে যে অপরাধের বেপরোয়া বিস্তার ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিশন রিপোর্ট হাতে পেয়ে অর্থমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তা খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, যাদের নাম এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের নাম প্রকাশ করা এ মুহূর্তে যাবে না। কারণ তারা অনেকেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোক। তাদের নাম প্রকাশিত হলে সরকারের জন্য তা বড় রকম বিড়ম্বনার কারণ হবে! যে দেশে অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি লোক এ ধরনের কথা প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের কাছে বলতে পারেন, সে দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ যে শাসকশ্রেণী ও তাদের কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব, এটা মনে করার চেয়ে অবাস্তব চিন্তা আর কী হতে পারে।
১০.৪.২০১১
ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুড়িগঙ্গার অবস্থা শোচনীয়। এই নদীতে নানা ধরনের শিল্প-কারখানা থেকে বর্জ্য পদার্থ পড়ে এককালের এই সুন্দর ও জীবন্ত নদীটিকে এখন কৃষ্ণবর্ণ ও মৃত নদীতে পরিণত করেছে। এ নদীতে মাছসহ নানা জলজ প্রাণী নিশ্চিহ্ন হতে হতে এখন প্রায় শেষ হয়েছে। শিল্প-কারখানাগুলোকে তাদের বর্জ্য পদার্থ পরিশোধনের জন্য এবং সে সঙ্গে অনেক কারখানাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার নির্দেশ দিয়ে থাকে। কিন্তু এসব নির্দেশ কেউ মান্য না করার কারণে সেগুলোকে কাগুজে ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। কাজেই শিল্পবর্জ্য বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগে নিয়মিতভাবে নিক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিটির হাল একই রকম করেছে। এসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে; কিন্তু এর কোনো ফল আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
নদীর পানি দূষিত হওয়ার এই ব্যাপার ছাড়া এখানে নদী সম্পর্কিত যে বিষয়টি আলোচনার প্রয়োজন তা হলো, নদী ভূমিদস্যুদের দ্বারা নিয়মিতভাবে ভরাট হয়ে দখল হতে থাকা। ঢাকার পত্রিকাগুলোর মধ্যে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রায়ই খুব জোরালোভাবে এর ওপর অনেক সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশ করে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই তারা নদী দখলের বিরাট ছবি ছাপে, দখলকর্মের অনেক বিবরণও তাতে থাকে। কিন্তু এর কোনো প্রভাব সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর পড়ে বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে তারা নদীর দখল উচ্ছেদ করলেও কয়েকদিন পর পূর্ব দখলকারী আবার একই জায়গা দখল করে তার ওপর বাড়িঘর তৈরি করে! কাজেই সরকারের এই উচ্ছেদ প্রচেষ্টাকে প্রকৃতপক্ষে লোক দেখানো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে ডেইলি স্টারে বুড়িগঙ্গা নদী দখলের ওপর প্রথম পৃষ্ঠায় এক বিরাট ছবিসহ একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, জলাভূমি দখলের জন্য গত ১০ বছরে কারও জেল হয়নি। ২০০০ সালে ডবঃষধহফ ধহফ ড়ঢ়বহ ংঢ়ধপব পড়হংবৎাধঃরড়হ অপঃ জারি হলেও এ আইনের আওতায় গত ১০ বছরে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি, কাউকে শাস্তি দিয়ে জেলে পাঠানো হয়নি। শহরের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোকে ভূমিদুস্যদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকার অনেক প্রতিজ্ঞা করলেও কোনো ক্ষেত্রে নদী ভরাট করা মাটি সরানো হয়নি। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো বেআইনি স্থাপনা ভেঙে ফেললেও ভরাট করা যে মাটির ওপর এ কাজ করা হয়, সেটা না সরানোর ফলে অতি সহজেই আবার দখলকারীরা নতুনভাবে একই জায়গায় বাড়িঘর তৈরি করে নিজেদের দখল কায়েম করে। শুধু তা-ই নয়, ভূমি দফতরের অসৎ সরকারি কর্মচারীদের সাহায্যে অনেকেই নদীর ওপর নিজেদের 'বংশগত' মালিকানার দলিল পর্যন্ত তৈরি করে মামলা চালায়! শুধু নদী নয়, সমুদ্র-তীরবর্তী জায়গাও এভাবে 'বংশগত' সম্পত্তি হিসেবে দখল করার ব্যাপার কক্সবাজারে দেখা গেছে! এসব দলিলের ভুয়া চরিত্র সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব হলেও সরকারি সহায়তার বলেই এ ভূমিদস্যুরা অদমিত ও বেপরোয়া থাকে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, শুধু ভূমিদস্যুরাই নয়, সরকারি কর্তৃপক্ষও এ কাজ করে থাকে। ঢাকার সদরঘাটে পর্যন্ত এভাবে বুড়িগঙ্গার তীর ভরাট করে সরকারি স্থাপনা তৈরির দৃষ্টান্ত আছে। এসব স্থাপনা ভেঙে ফেলার পরিবর্তে সেগুলোতে সরকারি কাজকর্ম পরিচালনা করা হয়। কাজেই সরকার নিজেই যখন ভূমিদস্যুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের তৈরি আইন লঙ্ঘন করে, তখন তার মধ্যেই ভূমিদস্যুরা অপরাধ করার শক্তির জোগান পায়। ২০০০ সালে ডবঃষধহফ ধহফ ড়ঢ়বহ ংঢ়ধপব পড়হংবৎাধঃরড়হ অপঃ করার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের পরিবেশ রক্ষা করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এ আইনের কোনো যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায়নি। জলাভূমি, খালবিল ও নদী ভরাটের জন্য আজ পর্যন্ত কারও কোনো শাস্তি হয়নি। ২০০০ সালের উপরোক্ত আইন ভঙ্গের জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়ই হওয়ার কথা। কিন্তু এ ধরনের কোনো শাস্তি কারও হয়নি। উপরন্তু একে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভূমিদস্যুরা নিয়মিতভাবেই নদীসহ সব ধরনের জলাধার দখল করেই চলেছে।
আগেই বলা হয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি কর্তৃপক্ষ নদী ভরাট করা জায়গার ওপর স্থাপনা ভাঙার পর আবার পূর্ববর্তী দখলকারী নতুন করে সেই জায়গা দখল করে তার ওপর স্থাপনা তৈরি করে। দ্বিতীয়বার এই একই অপরাধের জন্য যে বর্ধিত শাস্তির ব্যবস্থা আছে তা হলো ১০ বছরের জেল, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। এ আইনও ভূমিদস্যুদের তাদের অপরাধ থেকে নিরস্ত করে না। কারণ কোনো আইনের কোনো প্রয়োগ ও কার্যকারিতা নেই। ঢাকা শহরের আশপাশে নদী দখলকৃত অন্তত একশ' জায়গার ওপর বেআইনি স্থাপনা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা হয় না। কারণ সরকারি কর্তৃপক্ষ ছাড়াও আইনের নানা ফাঁকফোকর দেখিয়ে আদালতও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে এদের রক্ষা করেন! অর্থাৎ শুধু সরকারি কর্মচারীরাই নয়, আদালতও দুর্নীতির মাধ্যমে এই ভূমিদস্যুদের তাদের দখল বজায় রাখতে সাহায্য করে!
কিন্তু মজার ব্যাপার এই, যে ইধহমষধফবংয ওহষধহফ ডধঃবৎ ঞৎধহংঢ়ড়ৎঃ অঁঃযড়ৎরঃু (ইওডঞঅ) নদী দখলকারীদের উচ্ছেদের কথা বলে ও চেষ্টা করে, তারা নিজেরাও আদালতের রায় অমান্য করে বুড়িগঙ্গার উভয় তীরে মাটিভর্তি করে তার ওপর স্থাপনা তৈরি করেছে! ২৫ জুন ২০০৯ সালে হাইকোর্ট নদীর ওপর সব স্থাপনা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়ার পরও কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা ভরাট করে সেখানে একটি জেটি তৈরি করা হয়েছে! এ ক্ষেত্রে আবেদনপত্রে ইওডঞঅ নিজেদের পক্ষে আদালতের রায় পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম পর্যন্ত ব্যবহার করেছে! হাইকোর্টের নির্দেশ মান্য না করে সরকার নিজেই স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলার পরিবর্তে সেগুলো আরও দু'বছর রাখার জন্য হাইকোর্টের কাছে আপিল করেছে!
যে দেশে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ নদীসহ সব ধরনের জলাশয় ভূমিদস্যুদের দ্বারা দখল হয় এবং সরকার এ ব্যাপারে তাদের সহায়তা করে, সেখানে অপরাধের মাত্রা কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা সহজেই বোঝা যায়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল থেকে লুণ্ঠন, চুরি-দুর্নীতি যেভাবে বিস্তার লাভ করে অপরাধ সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ ছড়িয়ে দিয়েছে, এর চেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার কোনো দেশের পক্ষে আর কী হতে পারে? হাজার রকম অন্য দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও জলাশয় ও নদী দখল সম্পর্কিত যেসব ঘটনার উল্লেখ ওপরে করা হয়েছে তার থেকে বোঝা যায়, অপরাধের বিস্তার ও তার মাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ বাংলাদেশে অপরাধীর জন্য কার্যত শাস্তির ব্যবস্থা না থাকা। তাছাড়া সরকার নিজেই যেখানে অনেক ধরনের অপরাধের ঘটক, সেখানে তো অবস্থা 'বেড়ায় ধান খাওয়ার' চেয়েও অনেক খারাপ।
অপরাধের জন্য শাস্তির কোনো ব্যবস্থা না থাকা, বিশেষত সরকার ও সমাজের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের অপরাধ শাস্তিযোগ্য না হওয়ায় দেশে যে অপরাধের বেপরোয়া বিস্তার ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিশন রিপোর্ট হাতে পেয়ে অর্থমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তা খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, যাদের নাম এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের নাম প্রকাশ করা এ মুহূর্তে যাবে না। কারণ তারা অনেকেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোক। তাদের নাম প্রকাশিত হলে সরকারের জন্য তা বড় রকম বিড়ম্বনার কারণ হবে! যে দেশে অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি লোক এ ধরনের কথা প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের কাছে বলতে পারেন, সে দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ যে শাসকশ্রেণী ও তাদের কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব, এটা মনে করার চেয়ে অবাস্তব চিন্তা আর কী হতে পারে।
১০.৪.২০১১
No comments