নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-তেজস্ক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার ও লিবিয়া যুদ্ধ by পিটার কাস্টার্স
জনগণের চোখে কোনো যুদ্ধের বৈধতা দিতে বহু ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে পশ্চিমারা লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তৎপরতা শুরু করেছে মার্চ মাসের মাঝামাঝি। তারও আগে লিবীয় নেতার বিরুদ্ধে শুরু হয় তীব্র আক্রমণাত্মক প্রচারণা—তাঁকে উন্মাদ হিসেবে জাহির করা হয়।
যুদ্ধের সপক্ষে অজুহাত দেওয়া হয়, ‘উড্ডয়ন নিষিদ্ধ’ এলাকা বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিবীয় জনগণকে তাদের স্বৈরশাসকের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আর পশ্চিমা জনগণকে গেলানো হলো, লিবীয় সাধারণ নাগরিকদের মানবিক স্বার্থ সুরক্ষাই পশ্চিমের বিশেষ লক্ষ্য। তবে এখন প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর লিবিয়ার ঘটনাবলি নিয়ে পশ্চিমা জনগণের উদ্বেগ কমেছে। সেই সঙ্গে কমেছে যুদ্ধাকাঙ্ক্ষাকে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে আড়াল করার প্রয়োজনীয়তাও। শেষ পর্যন্ত মুয়াম্মার গাদ্দাফির বাসভবন ও সদর দপ্তরে বোমা হামলা চালিয়েছে ন্যাটোর যুদ্ধবিমান। অথচ তারা বিবৃতি দিচ্ছে, লিবীয় নেতাকে উৎখাত তাদের লক্ষ্য নয়। কী বৈপরীত্য! তা ছাড়া ওয়াশিংটনে মাত্র কদিন আগে বসেছিল এক যুদ্ধ পরিষদ। সেখানে পেন্টাগন-প্রধান রবার্ট গেটসের উপস্থিতিতে আমেরিকান ও ব্রিটিশ শীর্ষ কর্মকর্তারা ত্রিপোলির ওপর বিমান থেকে বোমা হামলা তীব্রতর করার ব্যাপারে আলোচনা করলেন।
পশ্চিমা হস্তক্ষেপের দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি তুলে ধরার সময় হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বারা নিঃশেষিত বা ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিও উঠেএসেছে। যদিও ব্রিটিশ ও মার্কিন কর্মকর্তারা বলে এসেছেন, লিবিয়ায় এমন অস্ত্র এখনো ব্যবহার করা হয়নি, তবে গাদ্দাফিকে উৎখাতে শুরু থেকেই মার্কিন ও ন্যাটো যে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করছে, তাতে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম রয়েছে—এমন ধারণা চাউর হয়েছে।
প্রথমত, ‘নিঃশেষিত’ বা লুপ্ত শব্দ ব্যবহার করায় মনে হতে পারে, অস্ত্রে এমন ধরনের ইউরেনিয়াম থাকা তেমন বিপজ্জনক নয়। কিন্তু আদতে পারমাণবিক উৎপাদনের দুর্ধর্ষ চরিত্রের দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত এই নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম। এসব অস্ত্র থেকে ছড়ানো তেজস্ক্রিয়ার প্রভাব আক্ষরিক অর্থেই চিরস্থায়ী: যত দিন পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্ব থাকবে, প্রায় তত দিন অর্থাৎ সাড়ে চার বিলিয়ন বছর ধরে এই তেজস্ক্রিয়া ছড়াতে থাকবে। তথাপি দুটি কারণে মার্কিন ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো চিরস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটায় এমন অস্ত্র তৈরির পথে এগিয়েছে। নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম অত্যন্ত শক্ত ও ঘাতসহ হওয়ায় তা দিয়ে সামরিক যান ও অস্ত্র মজবুত করা যায়। তা ছাড়া নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র দিয়ে কম শক্তিশালী অস্ত্রসজ্জিত শত্রুর রণসজ্জা ভেদ করা যায় সহজেই। ১৯৯১ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এভাবেই ভড়কে দেওয়া হয়েছিল ইরাকি সেনাবাহিনীকে। সেই যুদ্ধে হঠাৎই মার্কিন ট্যাংক থেকে এমন শেল নিক্ষেপ শুরু হয় যেগুলোকে পরে ইউরেনিয়াম শেল বলে শনাক্ত করা হয়। সাধারণ শেলগুলোর চেয়ে এগুলোর পাল্লা এক হাজার মিটার বেশি। এগুলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইরাকি ট্যাংকে আঘাত হানতে সক্ষম ছিল। উপসাগরীয় যুদ্ধ ও পরে সাবেক যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধেও একই ধরনের বর্মভেদী শেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
যুদ্ধে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহার আসলে কতটা ক্ষতিকর? পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে বিপুল পরিমাণ নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম বর্জ্য হিসেবে পরিত্যাজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এগুলো অস্ত্রে ব্যবহার পারমাণবিক বর্জ্যের নতুন ব্যবস্থাপনার পথ করে দিল। আগে অপেক্ষাকৃত কম তেজস্ক্রিয়বাহী উপকরণের ক্ষতিকারক প্রভাব কয়েক দশক ধরে উন্মুক্তই ছিল। তারপর তা পশ্চিমা অস্ত্রভান্ডারে ব্যবহার শুরু হলো। এসব অস্ত্রের প্রভাব ভালোভাবে দেখা যায় ইরাকের দিকে দৃষ্টি দিলে। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে নিক্ষিপ্ত মার্কিন শেল ও বোমায় নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ছিল। ২০০৩ সালের দখলদারির যুদ্ধেও এমন অস্ত্র ব্যবহূত হয়েছে। ফরাসি যাজক জঁ-মারি বেনইয়ামিনের অনুসন্ধান বলছে, ইরাকি শিশুদের ত্রুটিপূর্ণ গঠন, যেমন—মগজ মাথার বাইরে থাকা অথবা দুই চোখের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়া ইত্যাদি আগের চেয়ে ৩৫০ শতাংশ বেড়েছে। তা ছাড়া ব্লাড ক্যানসার, লিউকেমিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বহু গুণ বেড়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একাডেমিক গবেষণায়, এমনকি রক্ষণশীল আমেরিকান র্যান্ড করপোরেশনের প্রতিবেদনেও একইভাবে বলা হয়েছে, বাছবিচারহীনভাবে ফুসফুস ও পাকস্থলী রোগের ঝুঁকি বেড়েছে। এই ঝুঁকি যোদ্ধাদের যেমন, তেমনি বেসামরিক নাগরিকদেরও। নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম শেল বিস্ফোরিত হলে তেজস্ক্রিয় কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যেতে পারে কিংবা যুদ্ধাঞ্চলে অবিস্ফোরিত শেলের সংস্পর্শে যে কেউ তেজস্ক্রিয়ার শিকার হতে পারে। নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্রের প্রভাবে মানুষের বিকলাঙ্গতার খবরও পাওয়া গেছে।
তৃতীয়ত, পশ্চিমা শক্তি কর্তৃক নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র ব্যবহারের বিপদকে যেমন নানাভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, আবার অন্যদিকে গত দশকে যুদ্ধবিরোধী জোটের অব্যাহত প্রচারণার ফলে এসব অস্ত্র ব্যবহার অবৈধ করা সম্ভব হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এসব অস্ত্রের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে তিনবার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২০১০ সালের শেষ নাগাদ তৃতীয় গৃহীত প্রস্তাবে অন্তত ১৪৮টি সদস্য রাষ্ট্র দাবি জানায়, যখনই কোনো ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র ইউরেনিয়াম ব্যবহারকারী রাষ্ট্রের কাছে এ ধরনের ‘অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে’ জানতে চাইবে, তখনই তারা যেন খোলামেলাভাবে তা প্রকাশ করে। চার সদস্য রাষ্ট্র—যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এদের মধ্যে তিন দেশ এখন লিবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ। আর বিশ্বের বিপুলসংখ্যক রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ইসরায়েল।
গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধের শুরু থেকেই মূলত দুই ধরনের অস্ত্রে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহূত হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন সমালোচকেরা—ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মুখ বা যে অংশে বিস্ফোরক থাকে অথবা আর্মার এলহেলসিংয়ের উপাদান হিসেবে এবং এ-১০ সামরিক বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত শেলের মধ্যে। এ-১০ থান্ডারবোল্ট বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত শেলে ইউরেনিয়াম ব্যবহারের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। উপসাগরীয় যুদ্ধ ও যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধে আমেরিকান যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষিপ্ত শেল থেকে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়েছে। আজ ন্যাটো দলিলাদি হাজির করে জোর দিয়ে বলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহারের ফলে মানুষের ক্ষতির ঝুঁকি নগণ্য। যদিও পশ্চিমা কর্মকর্তারা লিবিয়া যুদ্ধে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহারের কথা বরাবরই অস্বীকার করে চলেছেন, তবে তার সম্ভাবনা তাঁরা খারিজও করে দেননি। বহু কিছু অস্বীকার করা যুদ্ধকৌশলেরই অংশ। যেমন শুরুতে পশ্চিমারা গাদ্দাফি সরকারকে হটানো তাদের লক্ষ্য নয় বলে প্রচার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সেনাপতিরা বিমান হামলার আওতা বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছেন। তাই লিবীয় বেসামরিক নাগরিকেরা তাঁদের ভূখণ্ডের ওপর ব্যবহূত নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র ব্যবহারের ফলে দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয়ার মুখোমুখি পড়বেন, এমন শঙ্কা খুব যৌক্তিক।
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
পশ্চিমা হস্তক্ষেপের দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি তুলে ধরার সময় হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বারা নিঃশেষিত বা ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিও উঠেএসেছে। যদিও ব্রিটিশ ও মার্কিন কর্মকর্তারা বলে এসেছেন, লিবিয়ায় এমন অস্ত্র এখনো ব্যবহার করা হয়নি, তবে গাদ্দাফিকে উৎখাতে শুরু থেকেই মার্কিন ও ন্যাটো যে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করছে, তাতে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম রয়েছে—এমন ধারণা চাউর হয়েছে।
প্রথমত, ‘নিঃশেষিত’ বা লুপ্ত শব্দ ব্যবহার করায় মনে হতে পারে, অস্ত্রে এমন ধরনের ইউরেনিয়াম থাকা তেমন বিপজ্জনক নয়। কিন্তু আদতে পারমাণবিক উৎপাদনের দুর্ধর্ষ চরিত্রের দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত এই নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম। এসব অস্ত্র থেকে ছড়ানো তেজস্ক্রিয়ার প্রভাব আক্ষরিক অর্থেই চিরস্থায়ী: যত দিন পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্ব থাকবে, প্রায় তত দিন অর্থাৎ সাড়ে চার বিলিয়ন বছর ধরে এই তেজস্ক্রিয়া ছড়াতে থাকবে। তথাপি দুটি কারণে মার্কিন ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো চিরস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটায় এমন অস্ত্র তৈরির পথে এগিয়েছে। নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম অত্যন্ত শক্ত ও ঘাতসহ হওয়ায় তা দিয়ে সামরিক যান ও অস্ত্র মজবুত করা যায়। তা ছাড়া নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র দিয়ে কম শক্তিশালী অস্ত্রসজ্জিত শত্রুর রণসজ্জা ভেদ করা যায় সহজেই। ১৯৯১ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এভাবেই ভড়কে দেওয়া হয়েছিল ইরাকি সেনাবাহিনীকে। সেই যুদ্ধে হঠাৎই মার্কিন ট্যাংক থেকে এমন শেল নিক্ষেপ শুরু হয় যেগুলোকে পরে ইউরেনিয়াম শেল বলে শনাক্ত করা হয়। সাধারণ শেলগুলোর চেয়ে এগুলোর পাল্লা এক হাজার মিটার বেশি। এগুলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইরাকি ট্যাংকে আঘাত হানতে সক্ষম ছিল। উপসাগরীয় যুদ্ধ ও পরে সাবেক যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধেও একই ধরনের বর্মভেদী শেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
যুদ্ধে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহার আসলে কতটা ক্ষতিকর? পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার উপজাত হিসেবে বিপুল পরিমাণ নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম বর্জ্য হিসেবে পরিত্যাজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এগুলো অস্ত্রে ব্যবহার পারমাণবিক বর্জ্যের নতুন ব্যবস্থাপনার পথ করে দিল। আগে অপেক্ষাকৃত কম তেজস্ক্রিয়বাহী উপকরণের ক্ষতিকারক প্রভাব কয়েক দশক ধরে উন্মুক্তই ছিল। তারপর তা পশ্চিমা অস্ত্রভান্ডারে ব্যবহার শুরু হলো। এসব অস্ত্রের প্রভাব ভালোভাবে দেখা যায় ইরাকের দিকে দৃষ্টি দিলে। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে নিক্ষিপ্ত মার্কিন শেল ও বোমায় নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ছিল। ২০০৩ সালের দখলদারির যুদ্ধেও এমন অস্ত্র ব্যবহূত হয়েছে। ফরাসি যাজক জঁ-মারি বেনইয়ামিনের অনুসন্ধান বলছে, ইরাকি শিশুদের ত্রুটিপূর্ণ গঠন, যেমন—মগজ মাথার বাইরে থাকা অথবা দুই চোখের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়া ইত্যাদি আগের চেয়ে ৩৫০ শতাংশ বেড়েছে। তা ছাড়া ব্লাড ক্যানসার, লিউকেমিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বহু গুণ বেড়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। একাডেমিক গবেষণায়, এমনকি রক্ষণশীল আমেরিকান র্যান্ড করপোরেশনের প্রতিবেদনেও একইভাবে বলা হয়েছে, বাছবিচারহীনভাবে ফুসফুস ও পাকস্থলী রোগের ঝুঁকি বেড়েছে। এই ঝুঁকি যোদ্ধাদের যেমন, তেমনি বেসামরিক নাগরিকদেরও। নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম শেল বিস্ফোরিত হলে তেজস্ক্রিয় কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যেতে পারে কিংবা যুদ্ধাঞ্চলে অবিস্ফোরিত শেলের সংস্পর্শে যে কেউ তেজস্ক্রিয়ার শিকার হতে পারে। নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্রের প্রভাবে মানুষের বিকলাঙ্গতার খবরও পাওয়া গেছে।
তৃতীয়ত, পশ্চিমা শক্তি কর্তৃক নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র ব্যবহারের বিপদকে যেমন নানাভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, আবার অন্যদিকে গত দশকে যুদ্ধবিরোধী জোটের অব্যাহত প্রচারণার ফলে এসব অস্ত্র ব্যবহার অবৈধ করা সম্ভব হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এসব অস্ত্রের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে তিনবার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২০১০ সালের শেষ নাগাদ তৃতীয় গৃহীত প্রস্তাবে অন্তত ১৪৮টি সদস্য রাষ্ট্র দাবি জানায়, যখনই কোনো ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র ইউরেনিয়াম ব্যবহারকারী রাষ্ট্রের কাছে এ ধরনের ‘অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে’ জানতে চাইবে, তখনই তারা যেন খোলামেলাভাবে তা প্রকাশ করে। চার সদস্য রাষ্ট্র—যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এদের মধ্যে তিন দেশ এখন লিবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ। আর বিশ্বের বিপুলসংখ্যক রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ইসরায়েল।
গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধের শুরু থেকেই মূলত দুই ধরনের অস্ত্রে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহূত হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন সমালোচকেরা—ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মুখ বা যে অংশে বিস্ফোরক থাকে অথবা আর্মার এলহেলসিংয়ের উপাদান হিসেবে এবং এ-১০ সামরিক বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত শেলের মধ্যে। এ-১০ থান্ডারবোল্ট বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত শেলে ইউরেনিয়াম ব্যবহারের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। উপসাগরীয় যুদ্ধ ও যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধে আমেরিকান যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষিপ্ত শেল থেকে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়েছে। আজ ন্যাটো দলিলাদি হাজির করে জোর দিয়ে বলছে, যুদ্ধক্ষেত্রে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহারের ফলে মানুষের ক্ষতির ঝুঁকি নগণ্য। যদিও পশ্চিমা কর্মকর্তারা লিবিয়া যুদ্ধে নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম ব্যবহারের কথা বরাবরই অস্বীকার করে চলেছেন, তবে তার সম্ভাবনা তাঁরা খারিজও করে দেননি। বহু কিছু অস্বীকার করা যুদ্ধকৌশলেরই অংশ। যেমন শুরুতে পশ্চিমারা গাদ্দাফি সরকারকে হটানো তাদের লক্ষ্য নয় বলে প্রচার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সেনাপতিরা বিমান হামলার আওতা বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছেন। তাই লিবীয় বেসামরিক নাগরিকেরা তাঁদের ভূখণ্ডের ওপর ব্যবহূত নিঃশেষিত ইউরেনিয়াম-সংবলিত অস্ত্র ব্যবহারের ফলে দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয়ার মুখোমুখি পড়বেন, এমন শঙ্কা খুব যৌক্তিক।
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।
No comments