লিবিয়া-গণতন্ত্রই হোক চূড়ান্ত লক্ষ্য
আরব বিশ্বে যে দেশটি গণবিস্ফোরণের প্রথম আঘাতে সহসা বহু বছরের ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল, তার নাম তিউনিসিয়া। তিউনিসিয়ার গণজাগরণ বলে দিয়েছিল, এর ঢেউ শুধু আফ্রিকার উত্তর প্রান্তে থেমে থাকবে না; পুরো আরব বিশ্বকেই নাড়িয়ে দেবে। সে কথার সত্যতা মিলল অতিদ্রুত। তিউনিসিয়ার পাশের দেশ লিবিয়াতে আন্দোলনের ঢেউ লাগল।
মিসর থেকে শুরু করে সিরিয়া-ইরান পর্যন্ত আরব বিশ্বের একেকটি দেশ বিপ্লব-জ্বরে কাঁপতে থাকল। মিসরে হোসনি মোবারকের তিন দশকের শাসনের অবসান হলো দ্রুত। আর মোবারকের পতনের পর সতর্ক হয়ে গেল গেড়ে বসা শাসকরা। লিবিয়ায় শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলন দমিত হলো সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। শত শত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। আক্ষরিক অর্থেই নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন দেশটির চার দশকের শাসক কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি। এ যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলল তার নিষ্ঠুরতায়। গাদ্দাফির বর্বরতা থামাতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এলো। সে দেশের বিদ্রোহীরাও প্রস্তুতি নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দিল। ন্যাটো বাহিনীর হামলা এবং বিদ্রোহীদের প্রচেষ্টার পরও দীর্ঘ সাত মাস যুদ্ধ চলেছে। অবশেষে রাজধানী ত্রিপোলি এখন বিদ্রোহীদের দখলে। গাদ্দাফি প্রাসাদ ছেড়ে এখন নিরুদ্দেশ। অর্থাৎ গাদ্দাফির চার দশকের শাসন এখন অবসিত। লিবিয়ার মানুষ গাদ্দাফির পতনে উল্লসিত। রীতিমতো উৎসব পালন করছে তারা। তারা বলছে, স্বৈরাচারের অচলায়তন ভেঙে লিবিয়া এবার 'স্বাধীন' হলো। লিবিয়ার মুক্তিকামী মানুষের হাতে এখন নতুন পতাকা। যারা এই মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যারা মুক্তিকে সম্ভব করে তুলেছেন শত প্রাণের বিনিময়ে_ তাদের অভিনন্দন। তবে দেশটির ভেতরে-বাইরে অনেকেই মনে করেন, গাদ্দাফিমুক্ত লিবিয়াই শেষ কথা নয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দেশটিতে বসবাস করে। তাদের মধ্যে মতভিন্নতা আছে, স্বার্থদ্বন্দ্বও আছে। এগুলো অতিক্রম করে দেশটিকে গণতান্ত্রিক শাসনাধীনে আনা ভীষণ কষ্টকর একটি প্রক্রিয়া। পরবর্তী শাসকদের এ সত্য মেনে নিয়েই শুরু করতে হবে। তবে গাদ্দাফিবিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কিছু আশার সঞ্চারও করছে। মিসর ও তিউনিসিয়ার মতো সেখানেও হঠাৎ গণজাগরণ ঘটেছে সত্য, কিন্তু সাত মাসের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। পরবর্তী নেতৃত্ব কাদের হাতে থাকবে_ তা অনেকটাই স্পষ্ট। সিভিল সোসাইটির একটি বড় অংশ আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বে এসেছে। আশা করা হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তী কাউন্সিল একটি অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারবে। তবে সে জন্য দেশটিকে স্থির হতে হবে। নতুন নেতৃত্বকে জনপ্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগিয়ে যেতে হবে। মিসরের ঘটনা এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। সেখানে গণজাগরণের ফলে মোবারকের পতন হয়েছে সত্য, কিন্তু মোবারকের পর ক্ষমতাসীন হয়েছে তারই দীর্ঘদিনের সহযোগী সেনানেতৃত্ব। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সেখানে এখনও সুদূরপরাহত। তিউনিসিয়াতেও প্রত্যাশিত পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে লিবিয়া এক ধাপ এগিয়ে আছে। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে, সংগঠিত আন্দোলন ও আন্দোলনের কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন আছে। আন্তর্জাতিক সমর্থনও জরুরি। আরব বিশ্বে হয়তো আরও অনেক দেশেই এমন জাগরণ দেখব আমরা। সেগুলোর ফল হয়তো ভিন্ন হবে। কিন্তু কারণটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অপশাসন, বন্দিত্ব ও পরাধীনতা থেকে মানুষের মুক্তির যে চিরায়ত আকাঙ্ক্ষা, তাতে প্রথমবারের মতো সাড়া দিল আরব। ঘটনাটি ঘটাল তারুণ্যের শক্তি। তরুণরা পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করতে পারে, রাস্তায় নেমে প্রাণ দিতে পারে। কিন্তু পরিবর্তনকে স্থিত করার উপায়ও তাদের আবিষ্কার করতে হবে। দেশগুলো যাতে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে, তার কর্মপন্থাও তৈরি করতে হবে তরুণদেরই।
No comments