শ্রদ্ধাঞ্জলি-নজরুলময় কুমিল্লা by গাজীউল হক
শিক্ষা-সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লার সঙ্গে কবি নজরুলের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। নজরুল আর কুমিল্লা যেন এক সূত্রে গাঁথা। এখানকার স্নিগ্ধ, শ্যামল পরিবেশে কবি তারুণ্যকে জয় করেছেন। কবির প্রেম, প্রণয়, লুকোচুরি, পরিণয়, কাব্যচর্চা আর সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায়জুড়ে জড়িয়ে আছে কুমিল্লার নাম। রাজপথের আন্দোলন,
সংগ্রাম আর মিছিলের অগ্রভাগে থেকে গেয়েছেন জাগরণের গান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে হয়েছেন গ্রেপ্তার। করেছেন কারাবরণ। কুমিল্লায় পাঁচবার এসে থেকেছেন ১১ মাস। শহর-গ্রাম যেখানেই গেছেন, সেখানেই কবিকে আপন করে নিয়েছেন কুমিল্লাবাসী। কবির সেই পদধূলি আর স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে কুমিল্লা। কবি তাই এখানকার মানুষের গর্ব।
এত কিছুর পরও সংস্কৃতিকর্মীদের আপসোস, রাষ্ট্রীয়ভাবে কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান নেই। বাংলাদেশে কবির সবচেয়ে বেশি স্মৃতি কুমিল্লায়, তবু পিছিয়ে আছে এ জেলা। এই অচলায়তনের সুরাহা চান ভক্তকুল। কবিকে স্মরণ করে শোধ করতে চান পূর্বসূরির ঋণ! জানাতে চান শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বলছিলাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা।
আজ বুধবার দ্রোহ, মানবতা আর সাম্যের কবির ১১২তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি এলেই কবিতীর্থ কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুর নজরুলময় হয়ে ওঠে। কবির লেখা গান, কবিতা, ছড়া নিয়ে চলে কবি-বয়ান।
পাঠক, একটু জেনে নিই কুমিল্লায় কবির আগমনের তথ্য। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা থেকে কুমিল্লা রেলস্টেশন দিয়ে কবি নজরুল কুমিল্লা শহরে আসেন। তাঁর বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে তিনি প্রথমবার কুমিল্লায় আসেন। এরপর ১৯২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচবার কুমিল্লায় আসেন তিনি। অবস্থান করেছেন প্রায় ১১ মাস। কবি প্রথমবার ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস, তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবরে এবং পঞ্চম ও শেষবার ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত কুমিল্লায় ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ নেতা প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা আগমনের দিন ছিল ওই দিন। এ উপলক্ষে ওই দিন ভারতীয় কংগ্রেসের ডাকা হরতাল ছিল। ওই হরতালের মধ্যে কবি নজরুল কুমিল্লায় গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে প্রতিবাদী গানে মিছিল করেন। ওই অপরাধে কবিকে কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জনতার দাবির মুখে কবিকে কোতোয়ালি থানায় কয়েক ঘণ্টা আটক রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য কবিকে শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। কবি কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে, নজরুল এভিনিউ, ফরিদা বিদ্যায়তন, দারোগা বাড়ি, ঝানু মিয়ার বাড়ি, শচীন দেব বর্মণের বাড়ি, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার ও প্রমীলার বাড়ি ও কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে বসে সংগীত চর্চা করেছেন; কাব্য রচনা করেছেন। সংস্কৃতি-পাগলদের সঙ্গে মিশে গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন। প্রেম করেছেন। দুটি বিয়েও করেছেন কুমিল্লায়। আবার বাসরশয্যাও ত্যাগ করেছেন। ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নজরুল স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিফলক বসানো হয়। এরপর আর সেগুলো সংস্কার করা হয়নি। উল্টো নজরুল এভিনিউর স্মৃতিফলক হয়েছে ডাস্টবিন।
জানা গেছে, কুমিল্লায় নজরুলের নামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলাম হল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে কবি নজরুল ছাত্রাবাস, দৌলতপুরে নার্গিস-নজরুল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, নার্গিস-নজরুল সংগীত একাডেমি, নজরুল নিকেতন পাঠাগার, নজরুল মেমোরিয়াল স্কুলসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নজরুলের নাম জুড়ে দিয়ে কবির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। কিন্তু কুমিল্লায় কবির জাতীয় অনুষ্ঠান হয় না। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সব মহলেই।
কুমিল্লায় কবি বিজয়িনী, প্রিয়ার রূপ, পরম পূজা, মনের মানুষ, অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, ভাঙ্গার গান, বিষের বাঁশি, অনাদৃতা, প্রলয়োল্লাস, লিচু চোর, ছায়ানট, ঝিঙে ফুল ও পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তা ছাড়া মুরাদনগরের দৌলতপুরেও নার্গিসকে নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রেম ও বিরহের কবিতা রচনা করেন।
নজরুল পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুক আলতাফ চৌধুরী বলেন, ১৯৯২ সালে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মজয়ন্তী পালিত হয়। তখনকার প্রধানমন্ত্রী জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে ‘চেতনায় নজরুল’ নামের একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। প্রতিবছর বিশেষ দিনে সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। কবি কুমিল্লায় যে ধরনের স্বীকৃতি পাওয়ার কথা, সেটি পাননি। কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো দিন দিন মুছে যাচ্ছে। নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ শেষ হলে কবিকে নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হবে।
কুমিল্লার নজরুলভক্ত অধ্যক্ষ আমীর আলী চৌধুরী ও নজরুল গবেষক আলী হোসেন চৌধুরীর মতে, তাঁর সাহিত্যচর্চা কুমিল্লাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। নিয়ে গেছে উন্নত শিরে। এ প্রজন্মের কাছে নজরুলের কুমিল্লার সাহিত্যকর্ম, প্রেম-বিরহসহ নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরতে হবে। তবেই জেগে উঠবে তারুণ্য। বিকশিত হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। জন্মদিনে কবির প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
গাজীউল হক
এত কিছুর পরও সংস্কৃতিকর্মীদের আপসোস, রাষ্ট্রীয়ভাবে কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান নেই। বাংলাদেশে কবির সবচেয়ে বেশি স্মৃতি কুমিল্লায়, তবু পিছিয়ে আছে এ জেলা। এই অচলায়তনের সুরাহা চান ভক্তকুল। কবিকে স্মরণ করে শোধ করতে চান পূর্বসূরির ঋণ! জানাতে চান শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বলছিলাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা।
আজ বুধবার দ্রোহ, মানবতা আর সাম্যের কবির ১১২তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি এলেই কবিতীর্থ কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুর নজরুলময় হয়ে ওঠে। কবির লেখা গান, কবিতা, ছড়া নিয়ে চলে কবি-বয়ান।
পাঠক, একটু জেনে নিই কুমিল্লায় কবির আগমনের তথ্য। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা থেকে কুমিল্লা রেলস্টেশন দিয়ে কবি নজরুল কুমিল্লা শহরে আসেন। তাঁর বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে তিনি প্রথমবার কুমিল্লায় আসেন। এরপর ১৯২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচবার কুমিল্লায় আসেন তিনি। অবস্থান করেছেন প্রায় ১১ মাস। কবি প্রথমবার ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস, তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবরে এবং পঞ্চম ও শেষবার ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত কুমিল্লায় ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ নেতা প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা আগমনের দিন ছিল ওই দিন। এ উপলক্ষে ওই দিন ভারতীয় কংগ্রেসের ডাকা হরতাল ছিল। ওই হরতালের মধ্যে কবি নজরুল কুমিল্লায় গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে প্রতিবাদী গানে মিছিল করেন। ওই অপরাধে কবিকে কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জনতার দাবির মুখে কবিকে কোতোয়ালি থানায় কয়েক ঘণ্টা আটক রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য কবিকে শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। কবি কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে, নজরুল এভিনিউ, ফরিদা বিদ্যায়তন, দারোগা বাড়ি, ঝানু মিয়ার বাড়ি, শচীন দেব বর্মণের বাড়ি, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার ও প্রমীলার বাড়ি ও কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে বসে সংগীত চর্চা করেছেন; কাব্য রচনা করেছেন। সংস্কৃতি-পাগলদের সঙ্গে মিশে গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন। প্রেম করেছেন। দুটি বিয়েও করেছেন কুমিল্লায়। আবার বাসরশয্যাও ত্যাগ করেছেন। ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নজরুল স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিফলক বসানো হয়। এরপর আর সেগুলো সংস্কার করা হয়নি। উল্টো নজরুল এভিনিউর স্মৃতিফলক হয়েছে ডাস্টবিন।
জানা গেছে, কুমিল্লায় নজরুলের নামে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলাম হল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে কবি নজরুল ছাত্রাবাস, দৌলতপুরে নার্গিস-নজরুল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, নার্গিস-নজরুল সংগীত একাডেমি, নজরুল নিকেতন পাঠাগার, নজরুল মেমোরিয়াল স্কুলসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নজরুলের নাম জুড়ে দিয়ে কবির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। কিন্তু কুমিল্লায় কবির জাতীয় অনুষ্ঠান হয় না। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সব মহলেই।
কুমিল্লায় কবি বিজয়িনী, প্রিয়ার রূপ, পরম পূজা, মনের মানুষ, অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, ভাঙ্গার গান, বিষের বাঁশি, অনাদৃতা, প্রলয়োল্লাস, লিচু চোর, ছায়ানট, ঝিঙে ফুল ও পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তা ছাড়া মুরাদনগরের দৌলতপুরেও নার্গিসকে নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রেম ও বিরহের কবিতা রচনা করেন।
নজরুল পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুক আলতাফ চৌধুরী বলেন, ১৯৯২ সালে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মজয়ন্তী পালিত হয়। তখনকার প্রধানমন্ত্রী জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে ‘চেতনায় নজরুল’ নামের একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। প্রতিবছর বিশেষ দিনে সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। কবি কুমিল্লায় যে ধরনের স্বীকৃতি পাওয়ার কথা, সেটি পাননি। কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো দিন দিন মুছে যাচ্ছে। নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ শেষ হলে কবিকে নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হবে।
কুমিল্লার নজরুলভক্ত অধ্যক্ষ আমীর আলী চৌধুরী ও নজরুল গবেষক আলী হোসেন চৌধুরীর মতে, তাঁর সাহিত্যচর্চা কুমিল্লাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। নিয়ে গেছে উন্নত শিরে। এ প্রজন্মের কাছে নজরুলের কুমিল্লার সাহিত্যকর্ম, প্রেম-বিরহসহ নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরতে হবে। তবেই জেগে উঠবে তারুণ্য। বিকশিত হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। জন্মদিনে কবির প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
গাজীউল হক
No comments